লালন সাঁই : জীবন দর্শন ( পর্ব ১ )

রনি গোমেজ ও পলাশ সরেন :

“পারে লয়ে যাও আমায়

আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়।

নাই আমার সাধন ভজন

চিরদিন কুপথে গমন

নাম শুনেছি পতিত পাবন

তাই তো দেই দোহাই।”

একটি আলোর জন্ম। মহাত্মার আবির্ভাব। তমসার বক্ষ বিদীর্ণ করে সত্য, সুন্দর, জ্যোতির্ময়ের দিব্য পুতি বহন করে আবির্ভূত হলেন ঈশ্বরপ্রেমে দিশাহারা এক বাউল ফকির, নাম তার লালন। ভক্তির মন্দাকিনী ধারায় প্রবাহিত হল সঙ্গীত লহরীত বাংলার পল্লী প্রাঙ্গণ । শান্তির অমৃত প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ল দিকে-দিকে। জগজ্জ্যোতির্ময় সুধাকরের সুধা মাতোয়ারা সাঁইজির কণ্ঠের আনন্দ ধারায় মানুষ হলে আত্মহারা ভাড়ারার পল্লী প্রাঙ্গন হল পবিত্র পাঠস্থান। 


আরো পড়ুন: দেহ ব্যবসায়িদেরও জীবনের মূল্য আছে


জীবনের গভীরতম তলদেশের নিগুঢ় রহস্য ভেদ করে সাঁইজির আলোকময় জগতে গাইলেন জীবনের গান । উদাসী ফকির বিশ্ব মানবকে আহ্বান জানিয়ে বললেন, ‘‘আমি এসেছি তোরা ছুটে আয় আমার পাশে, আলো দেখবি আয় আনন্দ পূর্ণিমায় ভূবন মোহীনির আলো ছটা দেখে যা তোরা।।’’

এই ভাবের ভাবুক, রসের রসিক কী পরশ পাথর খুঁজে পেয়েছিল? যার প্রেমের ঝর্ণনার সুধা পানের জন্য মিলিত হল বহু প্রাণ। যারা নিজ নিবাস ছেড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল ভাড়ারার পল্লী প্রান্তরে।



লালনের সংক্ষিপ্ত জীবন :

‘‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে

লালন ভারে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।’’

লালন ফকির শাহ কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার ছেউড়িয়া গ্রামে তার নিজস্ব আখড়ায় ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর, বাংলা ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক, শুক্রবার মৃত্যুবরণ করেন। এ বিষয়ে সকল গবেষক, সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন পণ্ডিতদের মতামত মোটামুটি এক। কিন্তু তাঁর জন্ম সম্পর্কে কোন তথ্য বা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কারা লালন জীবিত অবস্থাটিই কারো কাছে তাঁর জন্ম সম্পর্কে কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। এমনকি তাঁর গানের মধ্যেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তিনি বলতেন :


আরো পড়ুন: সুস্থ থাকতে মানসিক চাপ কমান


‘‘সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন

লালন বলে আমার আমি জানি না সন্ধান।’’

তাঁর গানের উল্লিখিত বিভিন্ন নামের ব্যবহারের ভিত্তিতে কেউ মনে করেন, তিনি হিন্দু ছিলেন কেউ বা বলে তিনি মুসলিম ছিলেন। অনেকে মনে করেন তিনি হিন্দু কায়স্থের সন্তান জন্ম কুষ্টিয়া জেলার কুমার খালির ভাড়ারা গ্রামে। আবার অনেকে মনে করেন, তিনি মুসলিম সন্তান জন্ম ঝিনাইদহ জেলার হুরিনাকুম্ভুর হরিশপুর গ্রামে। উক্ত বিষয়ের উপর স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হলে আমাদের দুটি বিষয়ের সম্পর্কে গবেষণা করতে হবে এবং জানতে হয় তা হল :

১। সমকালীন পত্র-পত্রিকাতে লালন জীবনীর উপাদান।

২। লোকশ্রুতি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ।

আর তাই এগুলোর উপর ভিত্তি করে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস লালন প্রথম জীবনে জাতিতে কায়স্থ ছিল। কুষ্টিয়ার চাপড়া ভৌমিক বংশের লোক। তিনি নাকি তীর্থে যাবার সময়ে পথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন এবং তাঁর সাথের লোকদের দ্বারা পরিত্যাক্ত হন এবং তাকে নদীতে ভেলায় করে ভাসিয়ে দেয় হয়। ছেউড়িয়া গ্রামের মলম শাহের স্ত্রী মতিজান কালিগঙ্গা নদীতে পানি নিতে এসে লালনকে অজ্ঞান অবস্থায় পানিতে ভাসতে দেখতে পান এবং বাড়িতে এনে সেবা-শুশ্রুষা করে ভালো করেন। এবং তারা যেহেতু সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্য ছিল, তাই পরবর্তীতে সেও তার দ্বারা দীক্ষালাভ করেন। এবং ছেউড়িয়া গ্রামেই বসবাস করেন। মলম জমি-জমার এক অংশ লালনের নামে উইল করে দেন। এবং এই জমিতেই তাঁর আখড়া নির্মাণ করেন। তিনি বিশখা নামে এক মহিলাকে বিবাহ করেন এবং তার সাথেই আমৃত্যু বসবাস করেন। সাঁইজি বলেছিলেন, তিনি নাকি আগে আরেকটি বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু তাকে তিনি তার সঙ্গে আনতে পারেননি বলে দুঃখ করতেন। লালনের আখড়ার প্রধান খাবার ছিল খিচুরি, তাছাড়া তিনি সিদ্ধি খেতেন। লালন শাহ গেরুয়া বসন পরিধান করতেন। পরনে কাপনি থাকিত তার উপর পা পর্যন্ত লম্বা গেরুয়াবসন পরতেন। তিনি নিজের হাতেই এই কাপড় সেলাই করতেন। তাছাড়া তার হাতে একটি লাঠি থাকত। এবং এর হাতলের দিকটি দেখতে ধলশার পাখির ঠোঁটের মত ছিল। তিনি রাতে গান তৈরি করতেন এবং মধ্যরাত পর্যন্ত সেই গান গাওয়া হতো। এরপর সকালে ধ্যান করতেন। তখন তিনি কারো সাথে দেখা করতেন না। এভাবেই এক সময়ে ধীরে-ধীরে বয়সের ভারে নুয়ে পড়েন। মৃত্যুর একমাস পূর্বে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন এ সময়েও গানে উন্মত্ত হতেন এবং ধর্মালাপ পেলে নব বলে বলিয়ান হয়ে রোগের যাতনা ভুলে যেতেন। মৃত্যুর আগের রাতেও ভোর ৫টা পর্যন্ত গান করে শিষ্যদের বললেন, ‘আমি চললাম’। এরপর দিনের বেলায় তিনি প্রাণত্যাগ করলেন। তাঁর শিষ্য বলতেন,‘‘সাঁইজি খাঁচা বদলাইয়া স্বর্গে গেছেন’’। তৎকালিন পাক্ষিক হিতকারী পত্রিকার মত অনুসারে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১১৬ বছর বয়সে।


আরো পড়ুন: মন পরিবর্তমানের পাঁচটা পথ


জীবনাদর্শন :

ঈশ্বরের সৃষ্টির মাঝে মানুষ ছাড়া আর কিছুই শ্রেষ্ঠ নয় আর মানুষের মাঝে মন ছাড়া কিছুই শ্রেষ্ঠ নয়। লালন সাঁইজির জীবন দর্শনের মূখ্য হচ্ছে মানুষের এই দেহ ও মনকে কঠোর কৃচ্ছ্রতা-সাধনায় ঈশ্বরের উপস্থিতি ও অস্তিত্ব উপলব্ধি করা। মানুষের দেহ ও মন এমন একটি ঈশ্বরের সৃষ্ট যা দিয়ে মানুষ দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করলে সবকিছু সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব। আর গহীন সমুদ্রের ডুব দেয়ার ন্যায় উপলব্ধি করলে লালন সাঁইয়ের অন্তসার উপলব্ধি আমাদের কাছে খুবই প্রতিভাত হয়। সত্যের ও ন্যায়ের সংগ্রামী দার্শনিক সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি ‘‘KNOW THYSELF’’ অর্থাৎ নিজেকে জানা। যদিও এটি বিশ্বের সকল দার্শনিকবাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম উক্তি। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ সুবিশাল এবং গবেষণা সাপেক্ষ বিষয়। আজকের জগতের মানুষ ঈশ্বরকে জানার জন্য খুবই ব্যাকুল। কিন্তু কখনো কী সম্ভব শারীরিক বা বাহ্যিক ঔষধ সেবন করে মানসিক রোগ নিরাময় লাভ করতে? ঠিক তেমনি নিজের দেহের এবং মনের ঈশ্বরের অস্তিত্ব সন্ধান না পেলে তা বাহ্যিকতায় পাওয়া খুবই দুষ্কর। তাই তো লালন সাঁই বলেন, ‘‘যে নেই ভাণ্ড, সে নেই ভ্রমাণ্ডে।’’ এখানে ভাণ্ড অর্থ এই শরীর।


বিশ্বাঙ্গনে বাউল দৃশ্যপট :


বাউল গান আজ কেবল বাংলাভাষী অঞ্চলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নেই তা ছাড়িয়ে পড়েছে দূর দেশেও। ইউনেস্কো (টঘঊঝঈঙ) ২০০৫ এর ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশের বাউল গানকে ‘অ গধংঃবৎঢ়রবপব ড়ভ ঃযব ঙৎধষ ধহফ রহঃধহমরনষব ঐবৎরঃধমব ড়ভ ঐঁসধহরঃু’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। অবশ্য এর বেশ আগেই বাংলার বাউল বিশেষ করে লালনকে নিয়ে বিদেশিদের মধ্যে গত কয়েক দশক ধরে যথেষ্ট আগ্রহ, অনুরাগ ও সন্ধিৎসা জাগে। আলোচনা গবেষণার পাশাপাশি বাউল পদাবলি ও লালনের গান বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত দৃষ্টিপাতে যে চিত্র পাওয়া তা যথেষ্টই আশা সচারী। যেমন- মার্কিন মুল্লুকে চার্লস, ক্যাপওয়েল, এডওয়ার্ড সি. ডিমক এদেঁর বই বেরিয়েছে। ক্যারল সলোমন লালনের গান অনুবাদের পাশাপাশি লালন ও বউলের তত্ত্বদর্শন ব্যাখ্যার কাজেও নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। বিলেতের জন ওপেনশ এর বাউল বিষয়ক কাজ অনেকের মন কেড়েছে। ব্রাদার জেমস্ এর লালন গীতির ইংরেজি ভাষান্তর বিদেশিদের লালন সম্পর্কে মনোযোগি করে তুলতে সহায়ক করেছে। ফরাসি দেশের আন-হেলেন ট্রটটিয়ার এর বই বেরিয়েছে প্যারিস থেকে। ফরাসি ভাষায় বাউল ও লালনের গানের অনুবাদ করেছেন দুই বাঙালি ফরাসিবিদ মাহস্তদ শাহ কোরেশী ও পৃথ্বিন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় দুই জাপানি মাসাউকি ওনিশি এবং মাসাহিকো তোগাওয়া লালনের গান নিজ ভাষায় অনুবাদ করেছেন। জার্মান সংগীতবিদ ম্যান্ড্রিন উইলিয়স নিজ ভাষায় লালনের গান অনুবাদ ও স্বরলিপি রচনা করেন। এছাড়া ফাদার মারিনো রিগন লালনের গান ইতালি ভাষায় অনুবাদ করেন। এছাড়াও আরো অনেক ভাষায় লালনের গান অনুবাদ করা হয়েছে।


আরো পড়ুন: সম্পর্ক প্রসঙ্গ: ব্যক্তির সাথে ব্যক্তি-প্রতিবেশি ও সৃষ্টিকর্তা


উপসংহার :

‘মিলন হবে কত দিনে

আমার মনের মানুষের সনে।’

সবার কণ্ঠে এক গান লালন খাঁচা বদল করেছে। জগতে যখনই তার প্রয়োজন তখনই দেখা দেন। সমাজে যখন ধর্মের গ্লানি ও কুধর্মের উত্থান দেখা যায়, যখনই জাতিতে-জাতিতে ভেদাভেদ দেখা দেয় তখনই তিনি অবতরণ করেন। নতুন বাণী নিয়ে আসেন। ভেদাভেদ মুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে উপস্থিত হন। আর তাই, তাকে বাংলা ভাষায় কবি বেশে নবী বলা যায়।

বর্তমান আধুনিক যুগে দেখা যায় ধর্মের ও জাতির মধ্যে প্রকট ভেদাভেদ। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে কোন এক সময়ে বড় কোন বিপদের সম্মুখীন হব যার দ্বারা শুধু মানবতা ধ্বংস হবে। তাই লালন তার কর্মপন্থা দিয়ে আজকেও আমাদের ঐক্যের পতাকা তুলে এক হওয়ার আহ্বান জানান।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার :

  • উদ্দিন এন্তাজ মো: আলহাজ্ব,‘‘লালন পরিচিতি জীবন দশর্ন সঙ্গীত’’, পড়শী প্রকাশনী, ১৯ জানুয়ারী ২০০৪
  • মাননান আবদেল, ‘‘লালন সমগ্র; নালন্দা, ফেব্রুয়ারী ২০১০
  • উদ্দিন এন্তাজ মো: আলহাজ্ব, ‘‘লালন: ধর্মীয় দর্শনের মহাগুরু; পড়শী প্রকাশনী, ১০ জুলাই ২০০৫
  • মিত্র কল্যাণ, ‘‘লালন ফকির নাটক’’
  • ফাদার মারিনো রিগন, ‘‘আমার প্রিয় লালন গীতি’’
  • ডক্টর করিম আনোয়ারুল, ‘‘বাংলাদেশের বাউল সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত,’’ কর্মায়ন প্রকাশনী, জানুয়ারী ২০০২




Post a Comment

Previous Post Next Post