নারী ॥ কাব্যিক জগতে এক অপূর্ব সৃষ্ট

নারী ॥ কাব্যিক জগতে এক অপূর্ব সৃষ্ট


কবির কল্পনার উর্বর ভূমিতে খননকার্য চালিয়ে যে নারী কে পাওয়া যায়, সে নারী রুপজ ও কামজ রহস্য-মহিমার এক অপরুপ চিত্র। এ রমণী বরাবরই রহস্যমধুরা। এর বর্ণ ও লাবণ্য জীবনের সজীবতাকেই প্রকাশ করে। ঈশ্বর এই বিশ্ব ব্রক্ষান্ড তৈরির কাজ শেষ করে মানুষ রচনায় হাত দেন। তিনি প্রথমে পুরুষ তৈরি করলেন অতপর নারী। স্বভাবতই নির্মাণের দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাতার অভিনিবেশ প্রগাঢ় ও পরিপূর্ণ থাকে। তাই পুরুষের চেয়ে নারী সুন্দর তথা শিল্পকর্মের চূড়ান্ত নিদর্শন। দেহের উপস্থাপন, গতিভঙ্গির আবেদন, চাহনির কটাক্ষ, সাঙ্গীতিক উচ্চারণ ইত্যাদি অনুশীলনের মাধ্যমে নারী শুধু নন্দন-প্রতিমা হয়নি, হয়ে উঠেছে সাহিত্য জগতে এক বিশাল আলোড়ন। 




বাংলা কবিতায় আদিপর্ব থেকে বিশ শতক পর্যন্ত রচিত কাব্যকর্মে লক্ষ্য করা গেছে বেশিরভাগ কবিই নারীর রুপ ও আবেদনময়তা নিরীক্ষণে তুমুল অনুরাগী। কবিরা নারীকে সৌন্দর্যের আধার, দেহমন্দির ইত্যাদি হিসেবে তুলে ধরে প্রশংসা ও নিন্দার ভাগী হয়েছেন। কবি হল নারীর দেহমন্দিরের নিমগ্ন পূজারী। এরা স্তবকীর্তনের ভেতর দিয়ে নারীর প্রতিধ্বনি করেছেন ভিন্ন ভাষায় ও ভিন্ন ভঙ্গিতে মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তনে নারী সৌন্দর্যের যে আবেদন তৈরি হয়েছে,  তাতে কবির ভূমিকা কমবেশি ক্রিয়াশীল ছিল সব যুগে। অধিকাংশ বৈষ্ণব কবির কবিতা নায়িকাদের রুপ ও কাম বর্ণনার জন্য প্রসিদ্ধ। এতে আধুনিক যুগের কবির ভাষা আরো বেশি নান্দনিক, চিত্রকলা সমৃদ্ধ, শব্দপ্রয়োগে চাতুর্জে সমুজ্জ্বল। যেমন কবি বুদ্ধদেব লিখেছেন,

“...মুক্তি শুদ্ধতা, এক ভূষণহীন স্বদীপ্তনগ্ন
যার সামনে এসে জগৎবাসী বলতে
বাধ্য হয় তোমার কাছে আর কিছু
চাই না, তুমি যে আছো, হতে
পেরেছো তারই জন্যে তুমি মূল্যবান।”

কাব্যিক জগতে এক অপূর্ব সৃষ্ট


প্রাচীন কবিরা বলে গেছেন, নারী শুধু দেহ, তার মন নেই। পক্ষান্তরে, আধুনিক কবিপুরুষ সেই ধারণা থেকে সরে এসেছেন সামান্য। বলেছেন, “নারীর মন সহস্র বছরের সাধনার ধন।” আবার এ মন নিয়ে মাতামাতি না করে বেশিরভাগ কবি আশ্রয় নিয়েছেন নারীকান্তির মাধুর্যে। রবীন্দ্রনাথের সমকালীন বা পরবর্তীকালের কবিদের কবিতার মর্মসার হল,“নারীকে অবলোকন করা যায়, স্পর্শ করা যায়, বন্দি করা যায় প্রেমে অথবা কামজ আলিঙ্গনে, কিন্তু তার মন দুর্লভ।” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত নান্দনিক যুক্তি আরোপ করে নারীকে অর্ধেক কল্পনা হিসেবে উপস্থিত করেছে- 

“শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
মানুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
 সোনার উপনাসূত্রে বনিছে বসন...”




নারীর নির্মাতা ঈশ্বর হলেও সে যেন দ্বিতীয়বারের মতো নির্মিত হয়েছে কবিপুরুষের হাতে। নারীর মধ্যে তারাই সৌন্দর্য সঞ্চার করেছেন। পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্যে নারীর শরীরের বাইরের শোভা, গড়ন, লাবণ্য, মাধুর্য নিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা সাজিয়েছেন এক আশ্চর্য বাস্তব ও কল্পনার জগত। কবিরা বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন নারীর বয়সন্ধিকাল ও যৌবনের ওপর। এর পেছনে প্রেম, কাম, ভালোবাসা, অনুরাগ ইত্যাদি। কবিরা যেন সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে নারীর দেহের বন্দরে ভিড়িয়েছেন কল্পনার তরী। এ কল্পনায় তাদের কোন ক্লান্তি নেই, নেই কোন বিরতি। তারা আবিষ্কার করেই চলছে অফুরান এক সৌন্দর্যের ভুবন। কবিদের মৌলিক প্রেষণাই হচ্ছে কোনো বস্তুর মধ্যে সুন্দর অন্বেষণ এবং তাকে কল্পনার ছাঁচে ঢেলে প্রকাশ করা। কাব্যিক জগতে রমণীর দেহশ্রীকে অমর করে রেখে গেছেন আরেক কবি কালীদাস। তাঁর কবিতায় প্রেয়সীরা চিরযৌবনা ও চিরকুমারী নারীর সৌন্দর্য নিয়ে সাহিত্যের যে বিপুল ভান্ডার গড়ে উঠেছে এর চেয়ে বেশি আর কোনো শাস্ত্র ভান্ডারে পাওয়া যায় বেশ কয়েকজন রূপবতীর নাস যথা-পদ্মাবতী, শকুন্তলা, বেহুলা, তিলোত্তমা, বিদ্যাসুন্দরী আরও কত কাব্যনায়িকা প্রকৃতপক্ষে নারীর শ্রীতে অতুল সৌন্দর্য আরেপের ক্ষেত্রে কবির সস্তান ঈশ্বরের পরেই। সংবেদনশীল কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নারীর শ্রীর রহস্যের মুখোমুখি হয়ে মেতে উঠেন সৃষ্টিশীল কল্পনায়। তার কবিতায় পাওয়া যায়-   

‘বেদনা মাধুর্যে গড়া তেমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না,
আমিই প্রতীক বুঝি এ পৃথিবীর
আবার কখনো বাবি অপার্থিব কিনা!’


আরো পড়ুন: নারী নির্যাতন-ধর্ষণ-খুন থামবে কোথায়


বাংলা কবিতায় নারীর সমার্থক শব্দ হিসেবে পাওয়া যায়-রমণী, কামিণী, বামা, অঙ্গনা, নিতম্বিইধ, রূপসী, পিয়া, শোভনা, সুন্দরী ইত্যাদি। কবিতায় বহুল ব্যবহৃত এশব্দাবলী নারীর শোভাকে আরো নান্দনিক করে তোলে। কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় তার রমণী উপমা নামক কবিতার নারীকে উপস্থাপন করেছেন এভাবে:- “একটু খানি ভেবে দেখলে রমণীর শরীর মানেই পৃথিবী, জল ভাবলেই জল, জাহাজের মত ভাসলে পারো।”

শুধু এসবের মধ্যেই কবিদের সৃজনী সীমাবদ্ধ নয়। এ গন্ডি পেরিয়ে কবির সৃজনী গিয়ে উফেছে মিথলজির নারীদের উপর। মিথ চরিত্রের ঐতিহাসিক নারীচরিত্র, কিংবদন্তির সুন্দরী এবং সমকালীন বিখ্যাত নারী কবিতার বিষয়-বস্তু হয়ে ওঠেছে। বহুক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে এ নারীদের অর্জিত গুণাবলী। মিথ চরিতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- দেবী দূর্গা, পার্বতী, গঙ্গা, ভেনাস, উর্বশী, মেনকা, অপ্সরী ইত্যাদি। বাংলা কবিতায় দূর্গার প্রতীক অশুভ শক্তিনাশিনী হিসেবে। পাশব ও দানবীয় শক্তিকে পরাহত করার জন্যে তিনি স্বর্গ থেকে নেমে আসেন মর্ত। বাংলা শারদীয় পূজার যে দূর্গা প্রতিমা নির্মিত হয় তাতে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামী নারীর তেজ- বীর্য দেখতে পান কবি কাজী নজরুল ইসলাম:- 

“পদতলে লুটে মহিষাসুর
মহামাতা ঐ সিংহবাহিনী
জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে
শ্বাশত নহে দানবশক্তি
পায়ে পিষে যায় শির পশুর।” 




গ্রিক মিথের সুন্দরী রমনীদের মধ্যে সম্ভবত বাংলা কবিতায় ‘হেলেন’ সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নাম। আধুনিক যুগের কবিতায়ও হেলেনের রুপের বিপুল খ্যাতি। তার ঊক্ষশোভা নিয়ে একাধিক কবিতা রচেছেন কবি বুদ্ধদেব বসু:- 
                                                                                                                                      
“...হেলেনের বুকে মনের
বাসনা বেঁধেছে বাসা...”

ইতিহাসের আরো অনেক নারীও অমর হয়ে আছে কবিদের মধুর কবিতায়। সে নারীগুলোর মধ্যে অন্যতম:- নূরজাহান, মমতাজ, চাদ সুলতানা, জাহানারা, সুলতানা রাজিয়া ইত্যাদি। 

 লেখক : জ্যাষ্টিন গোমেজ

Post a Comment

Previous Post Next Post