বার্ধ্যক্য দুর্বলতা নয় বরং অনুপ্রেরণার উৎস

 বার্ধ্যক্য দুর্বলতা নয় বরং অনুপ্রেরণার উৎস


বার্ধ্যক্য মানব জীবনের চরম বাস্তবতা যা অনস্বীকার্য। প্রতিটি ব্যক্তিজীবনে পর্যায়ক্রমে শৈশব থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে তারুণ্য, তারুণ্য থেকে প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে বার্ধ্যক্যে পদার্পণ করতে হয়। মানব জীবনের এই চক্রাকার নিয়মে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলেই আবদ্ধ। অদ্ভূতধাঁধাঁময় জীবন থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় নেই। যার ফলে, ব্যক্তিজীবনে এই বার্ধ্যক্যকে সাদরে বরণ করে নেয়ার চেয়ে বড় কোন বাস্তবতা নেই। বাস্তব জীবনে মানুষ মাত্রই যুগ-যুগ ধরে যৌবনের পূজা করে আসছে, গেয়েছে যৌবনের বন্দনা। কেননা যৌবনে মানুষ থাকে প্রাণচঞ্চল, সুগঠিত চেহারা ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের অধিকারী, তিক্ষè দৃষ্টিশক্তি, লাগামহীন চিন্তা-ভাবনার অধিকারী এবং টগবগে যৌবনের উদ্যমতায় ভরপুর এবং আরো কতো কি! যৌবনকাল এমন একটা সময় যে সময় ক্লান্তিও তাদের ক্লান্ত করেনা, বৃথা চেষ্টার বোঝা যেন তাদের ক্ষান্ত করে না, এবং ভীতিও তাদের মনে বাসা বাঁধেনা। তারাইতো দেশ ও জাতির সম্পদ। এই যুক্তিবলেই প্রচলিত সমাজে দুনিয়ার সকল ক্ষেত্রেই যৌবনদীপ্ত মানুষের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু জীবনের মাত্র কয়েকটি বছরের ব্যবধানেই সেই যৌবনদীপ্ত মানুষগুলোই কেমন পরিবার, সমাজ ও গোটা দুনিয়ার কাছে অকেজো হয়ে যায়। বোঝাসম হয়ে পড়ে নিজের পরিবার, আপনজন ও সমাজের কাছে। যে পরিবার ও সমাজ একসময় নিরুদ্যম, অচল, কুচকে যাওয়া দুর্বল দেহখানি সেই একই পরিবার, সমাজ ও গোটা সংসারের নিকট হয়ে ওঠে নিতান্তই অবহেলার পাত্র। সংসারের উপেক্ষিত ও পরিত্যক্ত চিলেকোঠা হয় প্রবীণদের জীবনের বাকিটা সময় কাটানোর উপযুক্ত স্থান। পরিচিত পৃথিবী ও আপনজনের সাথে সব সম্পর্ক ঘুচিয়ে প্রবীণেরা আত্মীয়তা করে নিরব বিষন্নতার সাথে। সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা গুটিকয়েক মানুষের উদার ধরণীতে স্থান হয় না প্রবীণদের। যা সত্যিই পরিতাপের এবং লজ্জার বিষয়। 
                                        
                                                                       

বার্ধ্যক্য দুর্বলতা নয় বরং অনুপ্রেরণার উৎস

 প্রবীণেরা হলো জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া সৈনিক, যারা জীবনের নানান চড়াই-উৎরাই পার করে নিজেদের দক্ষতা ও সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছে নিজ পরিবার এবং সমাজের কাছে। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যেকোন ব্যক্তিই তরুণ-তরুণীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। কিন্তু বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রবীণদের কটাক্ষ করা হচ্ছে, বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানে। তরুণ-তরুণীরা জ্ঞান ও দক্ষতার কদর যে করে না তা নয়, কিন্তু তারা আধুনিক সমাজে পুরানো চিন্তাধারাকে পিছনে ফেলে অগ্রসর হতে যায়। আর সেটাই মূলত তাদের অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পুরানো ধ্যান-ধারণার আলোকে তারা তাদের চিন্তুার সংমিশ্রণ ঘটাতে অনিচ্ছুক। কিন্তু আগামী প্রজন্মকে দক্ষ ও সক্ষমতা অর্জন করতে হলে প্রবীণদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ মূল্যায়ন করতে শিখতে হবে। বর্তমান সমাজে বয়স বৈষম্যেরও শিকার হতে হচ্ছে প্রবীণদের। আধুনিক সমাজে বার্ধ্যক্যের ভারে কুজো হওয়া মানুষদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চায় বর্তমান তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে, এই প্রবীণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও লব্ধ জ্ঞান ছাড়া নতুন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আদর্শ সমাজ গঠনের কাজকে বেগবান করতে হলে প্রবীণদের পরামর্শ মূল্যবান গ্রহণ ও অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া অত্যন্ত আবশ্যক। কাজেই প্রবীণদের প্রতি তরুণদের সংকীর্ণ মানসিকতা প্রত্যাহার ও বার্ধ্যক্যের মত কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার মানসিক প্রস্তুতির কোন বিকল্প নেই। প্রবীণদের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের পাশাপাশি বিশ^ব্যাপী প্রবীণদের সুরক্ষা, কল্যাণ ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারী ও সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং দায়িত্বশীলতাও কাম্য। মানবিকতার খাতিরে হলেও যেন তারা তাদের যোগ্য সম্মানটুকু নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকতে পারে এটাই সকলের প্রত্যাশা। স্মরণে রাখতে হবে যে, বার্ধ্যক্য কোন মানুষের যোগ্যতা পরিমাপের দাড়িপাল্লা নয়, দুর্বলতাও নয় বরংঅনুপ্রেরণার অসীম উৎস। কাজেই এই সীমাবদ্ধতা উত্তরণে সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।



                                                                                                                                           জাসিন্তা আরেং



Post a Comment

Previous Post Next Post