বাংলা ভাষায় খ্রিস্টভক্তদের অবদান

লেখক: ফাদার কমল কড়ায়া


বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা। জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালির রয়েছে মাতৃভাষার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা। যেকোন মূল্যে মাতৃভাষার সম্মান অক্ষুন্ন রাখার জন্যে বাঙালি বদ্ধপরিকর। মোট জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশী খ্রিস্টানদের সংখ্যা নিতান্তই কম হলেও বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও অবদান সময় ও যুগের ধুলায় মলিন হবার মতো নয়। এ মহান দিনে আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত স্মরণ করি যাতে আগামী দিনে আমাদের কর্তব্য ও মাতৃভাষার যথাসাধ্য অবদান রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা পেতে পারি। 





বাংলায় সংবাদপত্রের যাত্রা হলো শুরু:


এ উপমহাদেশে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম ‘দিগদর্শন’ নাম নিয়ে শ্রীরামপুরে মাসিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে শ্রীরামপুরেই সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ আত্মপ্রকাশ করে। প্রতি শনিবারে এ সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। সুসংবাদ হলো যে, এ উভয় সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিলো খ্রিস্টভক্তদের উদ্যোগে জেসি মার্শম্যানের সম্পাদনায়। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে সংবাদপত্র ও প্রয়োজনীয় পুস্তকাদির প্রয়োজনীয় কাগজ সরবরাহ করার জন্যে স্থাপিত হয় বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত একটি কাগজের কল। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অঙ্গে প্রাণ সঞ্চারণের যে প্রয়াস তৎকালীন খ্রিস্টভক্তগণ ও মার্শম্যান ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে আরম্ভ করেছিলেন তা বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে সপ্তম ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। 


আরো পড়ুন: একুশ শতকে একুশের চেতনা


বাংলার শাখায় নতুন কিশলয়: 


বালাদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হয়েছে পর্তুগীজ খ্রিস্টভক্তদের মাধ্যমে। তাদের আদান-প্রদান, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, জিনিস-পত্র ইত্যাদির সংস্পর্শে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আরও উন্নত ও উৎকর্ষতা লাভ করেছে। সংযোজিত হয়েছে অনেক নতুন শব্দ। সাবান, বোমা, চা, বিস্কুট, পিরিচ, আচার, সাগু, ‘কাল্দ’ (তরকারীর ঝোল), বিন্দালু, গির্জা, আলতার, বাপ্তিস্ম, নভেনা, ‘পাদু-মাদী’ (ধর্ম পিতা-মাতা), প্রচলিত বিভিন্ন পদবী যেমন কস্তা, কোড়াইয়া, গমেজ, ডি’ক্রুশ, ছেড়াও, রোজারিও ইত্যাদি আরও অনেক নতুন শব্দ বাংলা ভাষায় সংযোজিত হয়ে বাংলা ভাষার শব্দ-ভা-ার সমৃদ্ধশালী করেছে। তাছাড়াও, অনেক নতুন দ্রব্যসামগ্রীর সাথে পর্তুগীজরা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশে জনপ্রিয় গাদাফুল তারাই আফ্রিকা দেশ থেকে এনেছে। পাউরুটি (ফিরিঙ্গিরুটি), আলমারী, আলপিন, ফিতা, চাবি, বোতাম, বয়েম, বোতল, বালতি, বাসন প্রভৃতি পর্তুগীজ ভাষাও তাদের অনীত দ্রব্য। আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, কামরাঙ্গা, জামরুল, নোনা আতা, চীনে বাদাম, রাংগা আলু, সফেদা, বিলম্বি, ভুট্টা, মরিচ ইত্যাদি আমরা পর্তুগীজদের কাছ থেকেই পেয়েছি। উল্লিখিত হয়নি এরূপ আরও অনেক কিছু আছে, যার জন্যে আমরা পর্তুগীজ ভক্তদের কাছে আজীবন দায়বদ্ধ থাকবো।


আরো পড়ুন: সবকিছুর উর্ধ্বে আমাদের উত্তম মানসিকতা


ঔঔ. অ. ঈঅগচ০ঝ যথার্থই বলেছেন: “ঞযব চড়ৎঃঁমঁবংব রহঃৎড়ফঁপবফ রহ ঃযব ঊধংঃ, হবি সবঃযড়ফং ড়ভ ধমৎরপঁষঃঁৎব, হবি রহফঁংঃৎরবং, হবি পঁংঃড়সং ধ হবি ৎবষরমরড়হ, ঈড়ঁহঃবহধহপরহম ধহ ঁহৎবংঃৎরপঃবফ ঢ়ড়ষরপু ড়ভ রহঃবৎ-সধৎৎরধমবং নবঃবিবহ ঃযবসংবষাবং ধহফ ঃযব হধঃরাবং, ঃযব ৎবংঁষঃং ড়ভ যিরপয রহ ঃযবরৎ ঃড়ঃধষরঃু ধৎব সধহরভবংঃ বাবহ ঃড়ফধু.” এ দেশবাসীর ওপর পর্তুগীজদের এতো বেশি প্রভাব থাকার বড় কারণ হলো, তারা মানুষের মর্যাদা দিতেন, মানুষের সমতা স্বীকার করে সবার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন।


বাংলা ভাষা সংস্কৃতি সেবায় ব্রতী যারা : 


বাংলাদেশে খ্রিস্টান স্কুল-কলেজগুলো স্থানীয় সমাজ ও সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্য রেখে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। আমরা জানি, বাংলায় সনেটের জনক মাইকেল মধুসূদন একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টভক্ত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব হলেন উইলিয়াম কেরী। সমসাময়িক খ্রিস্টান কয়েকজন বাংলা সাহিত্য-সেবীর কথা আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে পারি। প্রয়াত সুসাহিত্যিক নিধন ডি’রোজারিও, মার্ক ডি’কস্তা, ইসহাক বাড়ৈ, হেবল ডি’ক্রুজ, ফ্রান্সিস গমেজ, সাইমন সরকার ইত্যাদি আরও অনেকে  ক্ষেত্র বিশেষে ভূমিকা রেখেছেন। ব্রাদার জেমস সিএসসি বিদেশী হয়েও একজন রবীন্দ্রভক্ত। তিনি ইংরেজীতে রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়টা কবিতাগ্রন্থ ও ভক্তিমূলক গান অনুবাদ করেছেন। ফাদার রিগ্যান ইতালিয় ভাষায় অনুবাদ করেছেন পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের অনেকগুলো কবিতা, ফলে, বিশ্বে বাংলা সাহিত্যের আসর আরও বিস্তার লাভ করছে। ফাদার মারচেল্লো ও ফাদার ওরলান্দো সরল প্রাঞ্জল বাংলায় মথি, লুক ও মার্ক রচিত সুসমাচার ব্যাখ্যা করেছেন। ফাদার কার্লো ব্যাখ্যা করেছেন সাধু যোহন রচিত সুসমাচার ও পত্রাবলী। তাছাড়াও নিয়মিত বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে, সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, মাসিক নবযুগ ও দ্বি-মাসিক নতুন আশা। অনিয়মিত খ্রিস্টান পত্র-পত্রিকা রয়েছে অনেকগুলো। কোন পার্বণ উৎসবে পত্রিকা প্রকাশের বাতিক রয়েছে। “প্রতিবেশী প্রকাশনী, চাঁদপুর “ব্যাপ্টিষ্ট প্রকাশনী” ও ‘যশোর জাতীয় ধর্ম ও সামাজিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ থেকে প্রকাশিত অনেক গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের বিশেষ সম্পদ হয়ে আছে। সঙ্গীত চর্চায় খ্রিস্টভক্তরা পিছিয়ে নেই। সঙ্গীত পরিচালক সমর দাস, ওস্তাদ পিসি গমেজ, কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, কমল রড্রিক্স, শেখর গমেজ, দীপক বোস, নিপু গাঙ্গুলী অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। বাণীদীপ্তির ক্যাসেট খ্রিস্টান সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। খ্রিস্টভক্তদের মধ্যে প্রচলিত পালাগান, জারিগান, কীর্তন বাংলা সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ।


আরো পড়ুন: বিজয়ের চেতনা থাকুক প্রজন্মের হৃদে


উপসংহার : ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং শ্রেষ্ঠ কলেজ সেন্ট জেভিয়ার্সের সর্বময় কর্তা ফাদার আলবাট হুয়াট বলেন- “আমরা যারা খ্রিস্টান, তাদের কাছে মিশনারী শিক্ষা হচ্ছে দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগের একটি সুন্দর মাধ্যম। খ্রিস্টধর্ম শুধু গ্রীক, রোমান অথবা ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত থাকবে এতো হতে পারে না, দেশীয় সংস্কৃতি ও মানসিকতার সাথে এর যোগাযোগ থাকবে।” দেশীয় সংস্কৃতি ও মানসিকতার সাথে মিল রেখে বাংলাদেশে খ্রিস্টীয় উপাসনা দেশীয়করণ করার প্রচেষ্টা আরম্ভ হয়েছে। মাতৃভাষায় খ্রিস্টযাগ ও খ্রিস্টীয় উপাসনা করা হচ্ছে। দেশীয় রীতি ও দ্রব্যসামগ্রী উপাসনায় ব্যবহার করার ক্ষেত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এখনও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সুবিশাল পথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে। মাঝপথে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে না পেরে মাতৃভূমিতে থেকেও বিদেশী বলে পরিচিত হবো। যার চেয়ে লজ্জা আর হয় না!


লেখক: কার্যনির্বাহী পরিচালক, সেন্ট জন ভিয়ানী হাসপাতাল; 


কৃতজ্ঞতা স্বীকার :

১। তুষার সান্যাল, খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও জাতীয় সংহতি, “দেশ” ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৬, পৃ: ৩০-৩২ 

২। লুইস পেরেরা, শতবর্ষের এক বাণীবৃক্ষ ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশ, “দীপ্ত সাক্ষ্য” ১৯৮৬, পৃ: ২৪।

৩। সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, সংখ্যা-০৭, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা:৬


[জীবন ও সমাজে- পাঠাতে পারেন আপনারও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ] 

Post a Comment

Previous Post Next Post