মুগ্ধময়ী : ভাষার মাস ফেব্রুয়ারী। যে মাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সেই শহীদ ভাইয়েদের কথা; যারা বায়ান্ন সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই বাংলা ভাষা, বাঙালিরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। আমাদের ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে পুরো বিশ্ব এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের বাংলা ভাষা ধীরে-ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
একুশ শতকে একুশের চেতনা |
যে ভাষার জন্য এত আন্দোলন, আত্মত্যাগ এত কিছু সেই ভাষার মূল্য আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে কতটুকু? বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব তাদের জীবনে কতটুক পড়ছে আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি? বিষয়টি চমকে উঠার মতই, হ্যাঁ এই একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্মের কাছে ভাষা দিবস হলো সাদা কালো জামা পড়ে ছবি তুলে ঘুরাঘুরির মাস। তারা কি শধুই ঘুরছে, ফুল দিচ্ছে নাকি আসলেই হৃদয়ে ধারণ করছে? এই মাসের ইতিহাস জানানেই অধিকাংশের কাছে, শিশুদের মধ্যে অনেকে বাংলা বর্ণই চেনে না যা মোটেও কাম্য নয়। অভিভাবকদের এ বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া উচিত। প্রতিবছর বিভিন্ন টিভি চ্যানেল-এর সাক্ষাতকার, পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এর নজির পাওয়া গেছে, আবার অনেকেই জানে না ২১ ফেব্রুয়ারিতে আসলে কি হয়েছিলো; যা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক ও দুঃখজনক একটি বিষয়।
আমাদের সমাজব্যবস্থা এবং জীবন যাপন এখন পুরোপুরি পাশ্চাত্য অভিমুখী। খুব কম সংখ্যকই আছে, যারা নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করে চলছে, অনেকেই পশ্চিমাদের অনুকরণ করে কথা বলতে চেষ্টা করে। এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম ও শিশুদের মধ্যে। আমাদের ভাষা যেন আমাদেরই কাছেই অসহায়। বিদেশী ভাষা শিখতে গিয়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে এক কথায় ধ্বংস করছি। অন্য ভাষা রপ্ত করা দোষের কিছু নয়, অবশ্যই তা দক্ষতা বাড়ায় কিন্তু মাতৃভাষাকে অসম্মান করার অধিকার কোন নাগরিকেরই নেই অথচ কেউ কি তা মান্য করছেন? বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে একটা জগাখিচুড়ি ভাষা আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি। বর্তমান সময়ে দেশ ও বিদেশের সংবাদ জানার জন্য আমরা অনেকাংশে নির্ভরশীল রেডিও, টেলিভিশন ও সামাজিক গণমাধ্যমগুলোর ওপর। ব্যাপক প্রচারণার জন্য এসব গণমাধ্যমের উচিত শুদ্ধ বাংলা ভাষায় তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করে বাংলাকে মানুষের হৃদয়ের আরো গভীরে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু বাস্তবে যা হচ্ছে তা অনেকটাই হতাশাজনক। সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলো বাদ দিয়ে দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি প্রচারমাধ্যমগুলো যে ভাষায় তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এফএম রেডিও’র জকিরা তাদের ইচ্ছামতো ভাষার ব্যবহার করেন। বাংলা এবং ইংরেজির ভাষা মিশ্রণে তারা নতুন এক ভাষার সৃষ্টি করে ফেলেন যা প্রতিনিয়ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের অগণিত মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। শুধু এফএম রেডিও চ্যানেলই নয়, আমাদের দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও ভাষা বিকৃতির জন্য দায়ী। তাদের উপস্থাপকগণ মনোমুগ্ধকর বাচনভঙ্গির মাধ্যমে বিকৃত বাংলা ভাষা জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করেন নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের ওপর। ভাষার জন্য যে জাতির বুকের রক্ত ঝরেছে, সেই জাতির কাছে এমনটা কোনোমতেই কাম্য হতে পারে না। বিশেষ করে সোশাল মিডিয়াতে দেখা যায় তরুণ প্রজন্ম বাংলা দেশাত্ববোধক, লালন ও সাংস্কৃতিক গানগুলোকে বিকৃত করে তৈরি করছে নতুন এক সৃষ্টি এবং সেখানে হাজার-হাজার ব্যাঙ্গাত্ত্বক বিরূপ মন্তব্য করা হয়।
২১শে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবসের মতো দিনগুলো বাঙালি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সে দিবসগুলোতে ভাষাকে উদযাপন করার নামে চলে অশ্লীল উন্মাদনা ও বিকৃত নোংরামী। গুটিকয়েক দেশাত্ববোধক গান দিয়ে সকাল শুরু হলেও দিন শেষ হয় হিন্দি, ইংরেজি গান দিয়ে রাস্তাঘাট, গাড়ি, ট্রাক এ উচ্চস্বরে বাজাতে-বাজাতে চলে যায় একদল ছেলে-মেয়ে। এর দ্বারা আমাদের ভাষাকে এক প্রকার অপমান করা হচ্ছে। এ বোধটি বর্তমান প্রজন্মের ভেতরে একদমই নেই বলেলেই চলে। সারাবছর দেশের সম্মান প্রদর্শন নিয়ে কেউ ভাবে না অন্তত এই বিশেষ দিনগুলোতে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা একজন উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
মাতৃভাষার জন্য আমাদের ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছেন, তাদের সেই ত্যাগ আমাদের প্রজন্মকে আলোকিত করবে, সে প্রত্যাশা নির্মূল নয়। বর্তমান প্রজন্ম প্রকৃত বাংলা শুদ্ধ ভাষাকে বিকৃত করে অন্য এক হাইব্রিড ভাষা সৃষ্টি করছে, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ভাষার রূপান্তর ঘটবে, পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম, কিন্তু সেটা যেন হয় প্রয়োজনের তাগিদে। বাহিরের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমরা যেন দিন-দিন আমাদের মাতৃভাষা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি, তবুও আশার বাণী যে এখনও দেশের বেশ কিছু তরুণ এ তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও মাতৃভাষাকে হৃদয়ে লালন করে সাহিত্যের মননশীল চর্চা করে যাচ্ছেন।
তরুণ প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য ভালোভাবে অনুশীলনে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। এতেই বাংলা ভাষার মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মই আমাদের দেশ ও সংস্কৃতিকে পুরো বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করবে। একুশের চেতনা জেগে উঠুক সবার প্রাণে, নতুন প্রজন্ম, যুবসমাজদের মাঝে দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থাকুক চির অটুট এতটুকুই কাম্য। শহীদ মিনারে গিয়ে শুধু ফুল দিয়েই নয়, নতুন প্রজন্মের প্রত্যেককে মনে-প্রাণে একজন ভাষা সংগ্রামী হতে হবে। আবেগ দ্বারা আত্মপোলব্ধি সবচেয়ে বেশি জরুরি। নিজস্ব সংস্কৃতির চেয়ে কোনো সংস্কৃতি কখনই বড় নয়, তাদের জানানো আমাদের দায়িত্ব। আবার বাংলাকে শুধু আবেগের ভাষা হিসেবে রাখলে চলবে না। এর উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং সর্বস্তরে ব্যবহারের বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মের মনে একুশের চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে, যেন ভাষার যথার্থ মর্ম তারা উপলব্ধি করতে পারে।
শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়