অন্যরকম ভালবাসা

ব্রাদার নির্মল ফ্রান্সিস গমেজ সিএসসি : কথায় বলে, ‘ভালবাসা শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলে’। তেমনি আবার বলে ‘ভালবাসা কোন কিছু দাবী করে না শুধু দিয়ে যায়’। এখন কথা হলো এই দেওয়াতো দু’রকমও হতে পারে। একটা হলো পুরষ্কার বা ভাল কিছু, অন্যটা হলো শাস্তি। একজন যদি অন্যজনকে সত্যিই ভালবাসে, তবে সেই পাত্র/পাত্রী ভালকিছু করুক বা না করুক মাঝে-মধ্যে ভালবাসার চিহ্ন হিসেবে কিছু দেয়। তেমনি যদি সেই পাত্র/পাত্রী অন্যায় কিছু করে এবং তা শাস্তিযোগ্য হয়, তবে তাকে শাস্তি দেয়াওতো স্বাভাবিক। অবশ্য স্বাভাবিক তখনই যদি ব্যক্তিটির মধ্যে ন্যায়বোধ কাজ করে ও অপরজনের মঙ্গল চায়। আর এটাই বোধহয় অন্যরকম একটা ভালবাসা। এমনিভাবে আমারও অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার অতি কাছের ও প্রিয়জনদের কাছ থেকে এই অন্যরকম ভালবাসার স্বাদ আস্বাদন করার।

অন্যরকম ভালবাসা


তখন স্কুলে ভর্তি হয়েছি কিনা মনে নেই। তবে ভাল-মন্দ বুঝার বুদ্ধি হয়েছে এটা নিশ্চিত। আবার চুরি করার কায়দাও মোটামুটি আয়ত্ত্ব হয়েছিল। সাথীদের সাথে এর মধ্যেই এবাড়ি-ওবাড়ি ও কিছু বাগানে পদধূলি দিয়ে ফেলেছি।

পশ্চিম বাড়ির জ্যাঠার বাগানে মাত্র চারটি আনারস হয়েছে। অন্তরে শয়তানের আনাগোনা টের পেলাম। তবে কাউকে নিয়ে নয় একা যাব। জাগলো লোভ কিন্তু স্বার্থপর লোভ; ‘লোভে পাপ’ আর ‘পাপে ছাড়ে না বাপেরে’। ঘটল তা-ই। জ্যৈষ্ঠ মাস রবিবার দিন পাকা পরিকল্পনা হলো। ছোট ভাইকে আমি বাড়িতে রাখব আর মাকে গির্জায় পাঠাবো এটাই হবে পরম ও চরম সময়। হলোও তাই। বড় দেখে কেটে আনলাম একটা। ভাল করে কাটতেও পারলাম না। কিছু অংশ খেতে না খেতেই জিহ্বা ছুলে গেল। ওটার সাথে লড়তে-লড়তে সময় অনেক হয়ে গেল। হঠাৎ মেজো দিদি গির্জা থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখে আমি বারান্দায় টেবিলের নিচে বসে এই কাজ করছি। শাসন করেননি তা নয় কিন্তু তেমন কিছু বলেননি। মনে করলাম বেঁচে গেলাম। কিন্তু রেহাই নাই! মা বাড়িতে আসার পর দিদিমাকে বলে দিলেন। মা আমাকে কিছুই বলেননি তবে গোপনে খোঁজ রাখলেন আমি অবশিষ্ট অংশ কোথায় রেখেছি।

দুপুরে গোসল সেরে খেতে বসেছি, এমন সময় বাবা এলেন স্কুল থেকে। বাবা স্কুল মাস্টার। তখনকার দিনে রবিবারে ছুটি থাকত আর তাই বাবা দুপুরে বাড়িতে আসতেন। আমার খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় তথ্যাদিসহ সব সংবাদ মা-ই বাবার কাছে পৌঁছে দিলেন। খাওয়া শেষে বাবা আমাকে ডাকলেন। বাবাকে আমি অবশ্য শুধু আমি নই আমরা ভাইবোনেরা সবাই বাঘের মত ভয় পেতাম! আস্তে-আস্তে এগিয়ে গেলাম বাবার কাছে। তখন আমি অনুভব করছিলাম ক্রমেই আমার শরীর আগুনের মত গরম হচ্ছিল। পেছনে একহাতে একটা লাঠি লুকানো ছিল তা আমি বুঝতে পারিনি। কাছে যাওয়ার সাথে-সাথেই বাবার অভিজ্ঞ একটা হাত আমার দুটি হাতই ভাল করে ধরে ফেলল। এরপর পেছনের হাতটা সামনে আসতেই দেখলাম, হাতে বড় একটা লাঠি! দেখেই আমার মুখ শুকিয়ে গেল, তবুও ভয় হচ্ছিল কাপড় ভিজে যাওয়ার। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাদের বাগান থেকে আনারস খাইছ?’ আমি কিছুই বলতে পারিনি। শুরু করেছিলেন বাবা তার কাজ। আমি তখন ঘামে ভিজে চপচপ আর ব্যাথায় জোরে-জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। কেউ আসল না আমাকে রক্ষা করতে। আমি সব স্বীকার করলাম। তারপর বাবা ধরে নিয়ে গিয়ে সবগুলি টুকরা আমার হাতে দিলেন। আমি তখনই বুঝতে পেরেছি যে, মা না বললে বাবা জানতেন না, ওখানে ওগুলি রেখেছিলাম। তারপর বাবা আমাকে বললেন, ‘যা এগুলি ঐ বাড়িতে দিয়ে আয় আর জ্যাঠার পায়ে ধরে মাফ চেয়ে বলবি, আমি আর কোনদিন চুরি করবো না।’ 

সেদিন বাবার হাতে ঐ শক্ত লাঠিটা কতবার যে আমায় আঘাত করেছে তা মনে নেই। শেষে আমাকে আর মাফ চাইতে হলো না। সবাই এমনিতেই জেনে গেলো যে, আমি চুরি করেছি। সবাই দেখেছে আমি মার খেয়েছি। বাবা আমাকে ছেড়ে দিলেন কিন্তু দিদি ও মায়ের ওপর রাগ করে আমি সেদিন রাতে আর ভাত খাইনি। মানুষের লজ্জায় রাত পর্যন্ত আমি বাড়ির দূরে পালিয়ে ছিলাম।

সেই ঘটনার অর্থ আমি তখন বুঝিনি। শুধু জানতাম দিদি এবং মা আমার সাথে শত্রুতা করে আমাকে মার খাইয়েছেন এবং অপমান করেছেন। তারা চাইলে বিষয়টা গোপন রাখতে পারতেন অথবা তারাই পারতেন কিছু সাজা দিতে। কিন্তু এরপর থেকে আমি যখন যেখানেই যাই না কেন অন্যের কোন কিছু অন্যায়ভাবে খাওয়া বা নেওয়ার কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে আসে সেই দৃশ্য। আর যেন শরীরেও অনুভব হয় বাবার লাঠির আঘাত। মনে হয় কত অপমান হতে হয়েছিল সেদিন আমাকে। এরপর আর পারিনি এমন অপরাধ করতে।

ধীরে-ধীরে বড় হতে লাগলাম আর ভাল-মন্দ বুঝার জ্ঞানও বাড়তে লাগল। তখন থেকেই বুঝতে পারলাম, মা অথবা দিদি আসলে আমার শত্রু নন, তারা আমাকে ভালবাসতেন প্রচুর আর তাইতো বাবার কাছে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে বাবাও আমাকে ভালবাসেন বলেই কিন্তু শাস্তি ও অপমান দিয়েছেন যেন আমি পরবর্তীতে শাস্তির কথা মনে রেখে ও অপমানের লাজে এমন কাজ কখনও করি। তারা সবাই আমাকে ভালবাসতেন, তাই তারা আমাকে ভাল ছেলেরূপে গড়তে চেয়েছিলেন।

আজ স্পষ্ট উপলব্ধি করি, পরিবারে এমন ভাই-বোন ও পিতা-মাতা প্রয়োজন নেই; যারা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় অথবা অন্যায় গোপন রাখে। বরং প্রয়োজন সেদিনের মত ভাই-বোন, পিতা-মাতা, যারা প্রয়োজনে শাস্তি ও লজ্জা দিতে কুন্ঠাবোধ করে না। আমিও আজ আমার লজ্জাকর ঘটনা বলতে দ্বিধাবোধ করি না, কেননা সন্তানের জীবন আদর্শরূপে গড়ে তোলার জন্য এতো তাদের অন্যরকম ভালবাসা।



[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, সাহিত্য, গল্প ও ফিচার এবং অর্থবহ ও সুচিন্তিত লেখাসমূহ।  

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]


Post a Comment

Previous Post Next Post