ব্রাদার নির্মল ফ্রান্সিস গমেজ সিএসসি: ভাদ্র মাস। সকালেই রোদের তেজ খুব তীব্র। স্কুল কেন জানি ছুটি ছিল বেশ কয়েক দিনের জন্য। কিন্তু মার কাছ থেকে ছুটি পেতাম না দুধ নিয়ে বাজার যেতে। এক রকম বাধ্যই করতেন। অবশ্য বাবা বলতেন, আমি ইচ্ছা করলে চার আনা করে নিতে পারি প্রতিদিন। তবুও আমার মনে সুখ ছিল না। কেননা আমি সাইজে খুবই ছোট, মাত্র পড়ি ক্লাশ টু বা থ্রিতে। আমার কাছে ক্রেতারা এসে দাম-দর করে অথচ গোয়ালরা তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে জোর করেই তাদের দুধ দিয়ে দিতো। এতো বিরক্ত লাগত; মাঝে-মাঝে কান্না এসে যেত! যেদিন পৌনে তিন টাকা বা তিন টাকা এক সের বিক্রি হত সেদিন খুব আনন্দ পেতাম। অন্যান্য দিন আড়াই টাকা সের। সেদিনও দুধ নিয়ে বাজারে গেলাম। মনে নেই কত বিক্রি করেছি। কিন্তু মনে আছে সেদিন শুধু মায়ের জন্য পান আর সুপারি নিয়ে বাড়ি ফিরছি।
![]() |
বিপদে সহায় মা ও ঈশ্বর |
তখন বোধহয় বেলা বারোটা কি এর চেয়ে কিছু বেশি হবে। রোদের কারণে মাথায় উপুর করে বালতি দিয়ে হাতে করে পান আর সুপারি নিয়ে হাঁটছি। তখন বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি, আমার খেলার সাথীরা আমার চেয়ে ছোট হলেও একসাথে খেলি। দেখি যে, অপু এবং ভাগ্নে সুবীর আঙ্গুল দিয়ে খুব রহস্যজনকভাবে পানিতে কিছু দেখছে। আমি ভাবলাম হয়তো কোন বড় মাছ বা মাছের পোনা দেখেছে। তাড়াতাড়ি হেঁটে গেলাম তাদের কাছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এই কিরে এ্যানে?
‘এ্যানে নিশু শাপলা তোলবার লিগা ডুব দিছে আর চায় না।’ জবাব দিল তাৎক্ষণিক আমার গায়ে যেন বিদ্যুৎ বেগের মত একটা শক্তি আমাকে ঝাঁকিয়ে দিল। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। এক লাফে পানিতে। সবেমাত্র কিছু সাঁতার জানি। তবুও ঐ সময় কোন ভয় বা তাকে পেলে উঠতে পারব কিনা কিছুই মনে হলো না। শুনেছি শাপলা গাছের নিচে মাছের মত হয়ে ভূত থাকে কিন্তু আমার তখন কিছুই মনে পড়ল না।
পানিতে নেমেই যতটুকু ঠাঁই পেলাম পা দিয়ে ঘেটে-ঘুটে দেখলাম কিন্তু কিছুই ঠেকল না। তারপর ডুব দিলাম অথৈ পানিতে। তার গা আমার পায়ে লাগল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে এলাম। এসো বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার ডুব দিলাম। তার পায়ে ধরে টানলাম কিছুতেই কিছু করতে পারলাম না। কিন্তু জানতাম পানিতে বড় কিছুও হালকা হয়ে যায়। কিন্তু এতো আমার চেয়েও বেশ ছোট কিন্তু পারছি না কেন? ভিতরে ভয় ঢুকে গেল। ভাবলাম হয়তো ভূতে ধরে রেখেছে। আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল। গায়ের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেল এই পানির মধ্যেই। এদিকে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমার কাণ্ড দেখছে। কিন্তু কাউকেই ডাকছে না। আমি ভয়-ভয় মিশ্রিত সাহস নিয়ে এবার ডুব দিলাম। গিয়ে খুঁজে নিলাম তার হাত। তারপর বুঝতে পারলাম নীচে ঘাসের মধ্যে শক্ত করে ধরে আছে। একটানে ছুটিয়ে নিয়ে মাটিতে দু’পা দিয়ে এক ধাক্কা মেরে বের হলাম পানির উপরে। তারপর কোনক্রমে ঠেলে-ঠুলে নিয়ে আসলাম, যেখানে পানি কম সেখানে। আমি আর এক মুহূর্তও ভাবি না এখন কাকে ডাকব। ওরা দু’জন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওদেরও কিছু বলিনি। কেমন করে জানি ভেতর থেকে বের হয়ে আসল মা-মা-ও-মা! বাড়ি থেকে একশ গজের মত হবে স্থানটা। মা রান্নাঘরে ছিলেন আমার কাঁদো-কাঁদো স্বরে ডাক শুনে মা হৈচৈ করে বেরিয়ে এলেন। মায়েরা মনে হয় বুঝতেই পারেন, সন্তানদের কোনদিক থেকে ডাকে। তা না হলে মা সোজা দৌঁড়ে কিভাবে একবারে আমাদের কাছে এলেন? আর সন্তানের জান্তে-অজান্তে সম্ভবত মা-ই স্মরণে আসে বেশি, তাইতো কিছু হলেই মুখে এসে যায় ‘মাগো’। মা এসেই আমার সামনে থেকে নিশুকে কোলে নিয়ে বাড়িতে রওনা হন এবং বাড়ির সবাইকে ডাকতে থাকে। অমনি বাড়ির সবাই এসে পড়লো। নিশুকে মাথায় তুলে অনেকক্ষণ ঘুরানো হয়। পেট থেকে বেশ কয়েক কেজি পানি বেরিয়ে আসে আর সঙ্গে আসে পানির মতো ময়লা ও শ্যাওলা। আর সকালে খাওয়া তাল-মুড়িও পেটে থাকতে পারেনি। হাত-পা ঠান্ডা দাঁত লেগে গেছে, তাই তেল গরম করে তার হাতে-পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগানো হয়। শেষে তার জ্ঞান ফিরে আসে প্রায় দু’ঘন্টা পর। আমি তখন আর কিছুই বলতে পারিনি শুধু বোকার মত দেখছিলাম কে কি করছে আর মাঝে-মাঝে ঘটনা বলতে হল, আমি কি করলাম আর কি দেখেছিলাম।
এরপর থেকে আমি বুঝতে পারলাম, বিপদে ঈশ্বর আমাদের শক্তি ও সাহস যুগিয়ে দেন এবং মা আমাদের সাহায্য করেন। ভাই-বোনেরা তোমারও বিপদের জ্ঞান হারিয়ো না, দেখবে ঈশ্বর শক্তি ও সাহস দিবেন আর তোমাদের মাও সব সময় তোমাদের বিপদে এগিয়ে আসতে প্রস্তুত আছেন।
[জীবন ও সমাজে পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, সাহিত্য, গল্প ও ফিচার এবং অর্থবহ ও সৃজনশীল লেখনীসমূহ।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]