জীবন ও সমাজ : মা মানেই আবেগ, মা মানেই ভালোবাসা। যতই সময় যায়, ততই আমরা মায়ের আত্মত্যাগ ও অবদানের কথা উপলব্ধি করতে পারি। য কবির কাছে ভাবনার যেমন প্রয়োজনীয়তা ফুরায় না, তেমনি সন্তানের কাছে মায়ের প্রয়োজনীয়তা কখনই শেষ হয় না। যাদের এই প্রিয়জনটি নেই, তারা বুঝেন যে, এই শূন্যতা কখনও পূরণীয় নয়। এবারের মা দিবসের বিশেষ আয়োজনে আমরা মিসেস জেনিফার গমেজ (মলিনা)র কাছে জানবো তার নিজের মা ও তার নিজের সন্তানদের সাথে মা দিবস উদযাপনের কথা। তিনি চট্টগ্রামের অধিবাসী এবং তিনি দুই সন্তানের গর্বিত জননী।
মা দিবসটির গুরুত্বের কথা জানতে চাইলে মিসেস জেনিফার বলেন, মা দিবসটির গুরুত্ব আমার কাছে অনেকখানি। একজন মা হিসেবে আমি বলতে চাই, মাতৃত্বেই নারীদের আসল পরিচয়। এই বিশেষ দিনটি আরও বিশেষত্ব পায়, যখন নিজের সন্তানেরা আমাকে নতুন করে উপলব্ধি করতে শিখায়। দিনটিকে ঘিরে দূরে থাকা সন্তান যখন ফোন করে শুভেচ্ছা জানায়, কাছে থাকা সন্তান যখন জড়িয়ে ধরে বলে, মা আমার মা, তখন কি যে শান্তি ও সুখ অনুভূত হয় তা বলে বুঝানো যাবে না।
মিসেস জেনিফার একজন সন্তান হিসেবে তার মায়ের সাথে খুবই আনন্দের সাথে মা দিবসটি উদযাপন করতেন বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন যে, কাজের চাপে ব্যস্ত থাকলেও তার মা তাদের জন্য কাকন চালের পায়েশ রান্না করে খাওয়াতেন। আমরা সব ভাই-বোন মিলে মা’কে গান শোনাতাম ও আনন্দ করতাম। আমাদের আনন্দে মা-ও আনন্দিত হতেন। তবে, মা মারা যাবার পর আমার ভাই–বোনেরা আমাকে বড় বোন হিসেবে কম বরং মা হিসেবেই দেখতো বেশি ও শ্রদ্ধা করতো। তাদের কারণে আমিও মাতৃত্বের স্বাদ আগেই পেয়েছি। মা চলে যাওয়ার পর আমিও মায়ের মতই তাদের আগলে রেখেছি এবং দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি।
এছাড়ও, আমার বড় ছেলে মা দিবসে আমাকে জড়িয়ে ধরতো, খোঁপায় ফুল লাগিয়ে দিতো, ভালো-মন্দ এনে খাওয়াতো। সব মিলেয়ে খুবই দারুণ কাটতো। ছোট ছেলে সেমিনারীতে পড়ালেখার কারণে তার সাথে সময় কাটানো হতো না। যেহেতু, বাসায় একা থাকা লাগে, সন্তানেরা চাকরী নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাই বর্তমানে অবসর সময়ে সেলাই, বাগান করা, রান্না করা ইত্যাদি ঘরোয়া কাজগুলি করে সময় ব্যয় করি। তারা সব সময় চেষ্টা করে আমার প্রয়োজনে তাদের প্রতি আমার তেমন কোন প্রত্যাশা বা আকাঙ্ক্ষা নেই। কারণ ঈশ্বর যা দিয়েছেন, আমি তাতেই খুশী। একটুখানি কুশল যেন জিজ্ঞেস করে এটাই শুধু চাওয়া । আমাকে ভালো বা নতুন কাপড় দিতেই হবে, এমন কোন আশা নেই আমার। আমি অল্পতেই খুশী। আমি চাই, আমার সন্তানেরা যে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক, উন্নতি করুক ও সামনের দিকে এগিয়ে যাক। আমি তাদের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে গর্ব করতে চাই। একজন গর্বিত মা হতে চাই।
যেহেতু, আমি আমার জীবনের ২৬টা বছর আমার বড় সন্তানের সাথে ছিলাম। তবে, আমার শেষ ইচ্ছে এটাই যে, শেষ বয়সে আমি আমার ছোট ছেলের সাথে থাকতে চাই, তার যত্ন নিতে চাই এবং তার যত্নে থাকতে চাই। বিভিন্ন কারণবশত তার কাছাকাছি থাকা হয়ে ওঠেনি। ছোট থেকেই সে আমার থেকে দূরে ছিলো। তাই তার ছত্রছায়ায় সময় কাটাতে ইচ্ছুক। এভাবেই সব মায়েরা চায় তার সন্তানেরা এই পড়ন্তবেলায় কাছে থাকুক, ভালোবাসুক, যত্ন করুক।
প্রকৃতপক্ষে, মা যতখানি একজন সন্তানকে চায়, ভালোবাসে, যত্ন করে, এমনটা কোন বন্ধু-বান্ধব করে না, করবেও না। বন্ধু-বান্ধব আসে-যায়, তাই আমরা তাদের দেখতে পাই । মনে করি যে, তারাই আমাদের চিন্তা বেশি করে। মা-কে আমরা প্রতিদিন দেখি, তাই তার ভালোবাসা আমরা দেখতে পাই না। আমাদের ভালো রাখার ব্যস্ততায় এতোটাই মশগুল থাকেন যে, তার নিজের প্রতি যত্ন নিতে ভুলে যান তিনি। তার কাজের প্রশংসা করি না। সে কি রঙের শাড়ি পরেছে, তা খেয়াল করি না। যখন আমরা অসুস্থ হই, মা নিদ্রাহীনভাবে আমাদের নিদ্রার জন্য শিঁয়রে জেগে থাকে। সেই মা, সন্তান ভুল করলে একবার গায়ে হাত তুললে, নিজে দশবার কান্না করেন। দুনিয়া বদলে গেলেও, মা কখনও বদলায় না। আমরা নিজেদের সংসারে, কাজে ও পড়াশুনায় এতোই ব্যস্ত থাকি যে, আমরা ভুলে যাই, মা আজও আমাদের জন্য পথ চেয়ে থাকে; আজও আমাদের চিন্তায় রাত জেগে থাকে। মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসার ঊর্ধ্বে আর কোন ভালোবাসা নেই। তাই মা-কে অবহেলা নয়, তাকে ভালোবাসি, তাকে বুঝার চেষ্টা করি।
বর্তমানে যেসকল মায়েরা চাকরিজীবী এবং বিভিন্ন পেশাদারী কাজে ব্যস্ত থাকেন সর্বদা, সন্তানকে সময় দিতে পারেন না; তাদের জন্য আমি বলতে চাই, কমপক্ষে ছুটির দিনটুকু সন্তানদের সাথে কাটাতে পারলে সন্তানদের মন ভালো থাকে। ছোটবেলা থেকে মায়ের আদর, ভালোবাসা, গঠন না পেলে সন্তান ও মায়ের মধ্যে একটা বিশাল দূরত্ব সৃষ্টি হয় তা আমরা শুরুতেই উপলব্ধি করি না। কিন্তু একসময় আসে যখন তা এক অপূরণীয় ক্ষত সৃষ্টি করে, ক্ষোভ হয়ে জন্মায় সন্তানদের মনে। তাই এসব বিষয় যেন অবহেলা না করি এবং যতটুকু সম্ভব নিজের সন্তানকে সময় দেয়ার চেষ্টা করি।
সকল মায়ের ইচ্ছে, আশা পূরণ হোক। সকল মা ভালো থাকুক ও সুস্থ থাকুক। পৃথিবীর সকল মা-কে তাদের ত্যাগ, অবদান, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জন্য নতমস্তকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। আপনাদের সকলকে জীবন ও সমাজ-এর পক্ষ থেকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।