সাংসারেক রীতিতে খ্রিস্টানদের ওয়ানগালা উৎসব করা কতখানি যৌক্তিক?
মানুয়েল চাম্বুগং
“এথেন্সের মানুষেরা, আমি দেখতেই পাচ্ছি যে, সব দিক দিয়েই আপনাদের মধ্যে যথেষ্ট দেবভক্তি রয়েছে! আপনাদের এই শহরে ঘুরতে-ঘুরতে আমি যখন আপনাদের নানা পুণ্যনির্মিত লক্ষ্য করছিলাম, তখন এমন একটি বেদীও আমার চোখে পড়লো, যার গায়ে লেখা আছে, ‘এক অজ্ঞাত দেবতার প্রতি নিবেদিত।’ তাই শুনুন; যাঁকে আপনারা না জেনেও ভক্তি করেন, আমি এখন তাঁর কথাই আপনাদের সকলকে জানিয়ে দিচ্ছি! পরমেশ্বর যিনি এই জগত ও তার মধ্যে যা কিছু রয়েছে, তার সমস্তই গড়ে তুলেছেন, সেই স্বর্গ-মর্তের প্রভু যিনি, মানুষের হাতে তৈরি মন্দিরে তিনি তো বাস করেন না...। তিনি নিজেই তো সকলকে প্রাণ, প্রাণবায়ু, সমস্ত কিছুই দান করে থাকেন” (শিষ্যচরিত ১৭:২২-২৫)। বাইবেলে বর্ণিত এই এথেন্সবাসীদের মতো গারো জাতিও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পূর্বে তাতারা-রাবুকা, সুসিমী-সালজং ও আসিমা-দিংসিমা প্রভৃতি অজ্ঞাত দেবতাদের পূজা-অর্চনা করতো। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর তারা এসব অজ্ঞাত দেবতাদের বাদ দিয়ে ঈশ^র প্রভুকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। তত্ত্বানুসারে জানা যায় যে, সেসময় গারোরা সাংসারেক ধর্ম ছেড়ে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তারা তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিসহ আরো অন্যান্য কিছু ছাড়তে পারছিল না। যার কারণে ধর্মযাজকগণ তাদেরকে বকাবকি করতেন। শাস্তি দিতেন। এমনকি হিন্দুদের পূজা-পার্বণে যেতেও নিষেধ করতেন।
একসময় ধর্মযাজকরা তাদের এই ভুল ধর্মশিক্ষা দেয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় ভাতিকান মহাসভার সংবিধানের শিক্ষার আলোকে বুঝতে পারেন যে, প্রত্যেকটি জাতিগোষ্ঠীরই প্রার্থনানুষ্ঠানে নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি চর্চা করার ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে। ১৯৬৩-১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে রোমে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ভাতিকান মহাসভা সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্ট বর্ণিত আছে, “যেসব বিষয় মণ্ডলীর কল্যাণের সাথে তথা ইহজগতে জনকল্যাণের সাথে জড়িত অর্থাৎ যেসব বিষয় সবসময় সকল স্থানে নিরাপদে সংরক্ষণ ও সকল প্রকার ক্ষতি থেকে রক্ষা করা আবশ্যক, তাদের মধ্যে সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ হলো এই যে, খ্রিস্টমণ্ডলী কাজের সেই স্বাধীনতা উপভোগ করে, যা মানুষের পরিত্রাণ সাধনে মণ্ডলীর দায়িত্বের জন্য প্রয়োজন।” এই শিক্ষায় প্রবুদ্ধ হয়ে ধর্মযাজকরা গারোদেরকে অনুমতি দেন উপাসনা অনুষ্ঠানে তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে। এতে গারোরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে দলে-দলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন।
কিছু ইতিবাচক বিষয় হলো, খ্রিস্টমাতামণ্ডলী অনেক উদার, জগতের বস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে নিজ-নিজ মাতৃভাষায় ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রভুর প্রশংসা-গান করতে। বলা হয়ে থাকে যে, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ার অনেক আগে থেকেই গারোদের ওয়ানগালা উৎসব বিলুপ্তপ্রায় ছিলো; সেই প্রাণের উৎসব ওয়ানগালাকে পুনর্জ্জীবিত করার জন্য বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলী দ্বিতীয় ভাতিকান মহাসভার ধর্মীয় স্বাধীনতার শিক্ষানুসারে চিন্তা করলেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মান্দি উপাসনা উপকমিশনের উদ্যোগে, তৎকালীন ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের মহামান্য আর্চবিশপ মাইকেল রোজারিও’র অনুমোদনে খ্রিস্টরাজার মহাপর্ব দিনে বিড়ইডাকুনি ধর্মপল্লীতে খ্রিস্টরাজার ওয়ানগালা উৎসব সর্বপ্রথম আয়োজন করা হয়।
![]() |
সাংসারেক রীতিতে খ্রিস্টানদের ওয়ানগালা উৎসব করা কতখানি যৌক্তিক? |
খ্রিস্টরাজার পর্বদিনে ওয়ানগালা অনুষ্ঠান করার অর্থ হলো, খ্রিস্টান হওয়ার পর আমরা এখন ঐশ সত্য ঈশ্বর প্রভুকে জানতে পেরেছি। তাই তো আমরা এখন সালজং নামক সূর্যদেবতাকে বাদ দিয়ে এই বিশভ্রহ্মাণ্ড যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই প্রভু যীশুকে কেন্দ্র করে ওয়ানগালা আন্দোৎসব করে থাকি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমানে গারোদের মধ্যে ৯৯ ভাগ খ্রিস্টান হওয়ার পরও দেখা যায়, মধুপুরের কয়েকটি গ্রামে ও ঢাকার কিছু জায়গায় ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে সাংসারেক রীতিতে ওয়ানগালা উদ্যাপন করা হচ্ছে। এটা বুঝে ওঠা কঠিন যে, তারা আগের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য সাংসারেক রীতিতে ওয়ানগালা উৎসব করছে, না-কি লোক দেখানোর জন্য করছে, না-কি সত্যিকার অর্থে ওয়ানগালানুষ্ঠান করছে। যদি লোক দেখানোর জন্য কিংবা ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য সাংসারেক রীতিতে ওয়ানগালা অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা নেতিবাচকতো বটেই। কারণ বর্তমানে খ্রিস্টান হিসেবে আমরা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি; দেবমূর্তিকে পূজা করি না। যে ঐতিহ্যে বিশ্বাসের কোনো সত্যতা বা ভিত্তি নেই, সেই সালজং মিত্তিকে আমরা কেন ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা কতখানি যৌক্তিক তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যাই। সালজং দেবতাকে সবাই সূর্যদেবতা হিসেবে জানেন। তারপরও এক শ্রেণির লোকেরা এধরনের ভুল শিক্ষাকে চর্চা করছেন এবং অন্যদের অনুপ্রাণিত করছেন যা সমাজের জন্য অশনি সংকেত।
লেখাটি তথ্যবহুল ও সময়োপোযোগী
ReplyDelete