ফিরে আয় আগুন পাখি

 ফিরে আয় আগুন পাখি

রবীন ভাবুক 


পারবো না! ওর সাথে শুরু হয়েছিল এই কথা দিয়েই। কিন্তু তারপর সবই পারবো। সেও এবং আমিও পেরেছি। দুজনেই কাছাকাছি আসতে পেরেছি। অনেকদিন বাদে ওকে রাস্তায় দেখলাম। একবার ডাক দিয়েছিলাম, কিন্তু সাড়া দেয়নি। ওদের মহল্লা ছাড়ার পর আরো একবার দেখেছিলাম, সেও দেখেছে। কিন্তু কথা হয়নি। হবেই বা কি করে, কেউই মনে হয় সেদিনের নিঃস্বার্থ কমিটমেন্টের কথা মনে করিনি। ওকে আমি আগুন পাখি বলে ডাকতাম। ও ছিলই আসলে একটা পাখির মতো উড়ন্ত গাংচিল। যেন আগুনের ফুলকি ছুটিয়ে চলা একটা পাখি। তাই আগুন পাখি বলতাম। তখন ওর স্বভাবের সাথে মিশেছিল নামটা। কিন্তু সেদিন যখন দেখলাম, মনটা হুহু করে উঠলো। এই আগুন পাখি কি এই আগুন পাখি। কেমন যে বৃষ্টির শেষ ধারাটার মতো ধরে এসেছে। কিন্তু, ও তো ছিল উচ্ছল বৃষ্টি। খুব মায়া লাগছিল ওকে। সত্যি বলতে আমি কখনোই ওকে ভুলিনি। ও যে ভুলে গেছে তাও জানি না। ওকে ভালোবাসাটা আমার প্রথমে ভুল মনে হয়েছিল, কিন্তু এরপর সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলে গেছে। এভাবেও যে মানুষকে ভালোবাসা যায়, তা আগুন পাখিই শিখিয়েছিল।

 ফিরে আয় আগুন পাখি


সেদিন হাল্কা বৃষ্টি হয়েছিল। বিকেলে গলির সামনে দেখেছিলাম দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও যাবে বলে মনে হয়। ওর চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি একটা হাসি দেয়। এমনিতেই দিনে বৃষ্টি, তাই আবহাওয়াটা একটু ঠাণ্ডা। হালকা ফ্যান চালিয়ে বুকের উপর একটা কাঁথা দিয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছি। রাত বারোটার মতো বাজে। হুট করে ফোনে আওয়াজ এলো। ফোন ধরে দেখি একটা লাইক ইমোজি। দুইদিন আগে আগুন পাখিকে একটা প্রোগ্রামের ফরমেট লিখে দিয়েছিলাম। সেটার উত্তরেই এই লাইক ইমোজি। আমিও একটু রসিকতা করে লিখলাম, পারবো না। সে একটা হাসি ইমোজি দিয়ে বললো, কি পারবেন না? আমি বললাম, যে আঙ্গুল দিয়েছেন, তা আমি খাই না! সেও তখন মজা করা শুরু করেছে। জানতে চাইলো ঘুমাইনি কেন। বলেছিলাম এমনিতেই। একটু কাজ ছিল তা শেষ করে যয়ে শুয়ে টিভি দেখছি। কফি হলে ভাল হতো। সে বললো, সাধ্যে থাকলে দিয়ে আসতাম তারপর সে বললো, ঠিক আছে, কাল একটা গিফট দিব। এভাবেই শুরু আগুন পাখির ডাকে নতুন সুরে কিচিরমিচির।


অনেক কথা, অনেক শেয়ারিং। পরের দিন শুয়ে আছি, হুট করে দরজা খোলার শব্দ। চোখে ঘুম, আবার ঘুমিয়ে গেলাম। হঠাৎ নরম হাতের স্পর্শে চোখ খুললাম। অনেকটা অবাক এবং ভরকেও গেলাম। একি। সামনেই গতকালের সেই মানুষটাই তো মনে হয়। স্বপ্ন দেখছি নাতো। লাল কাপড়ে, পিঠ ছড়িয়ে চুলগুলো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। একটা পরি যেন মাথার কাছে দাঁড়িয়ে দু'হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে টানছে। যেন নিয়ে যাবে সেই কল্পনার সুখের রাজ্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেও কপালে চুমো দিয়ে বললো- শুভ সকাল!


সেদিনের শিহরণ আজো হৃদয়ে দোলা দেয়। ভুলতে পারি না। আসলে সবকিছুর পর একটা প্রশ্ন মনে আসে, সত্যি কি আগুন পাখি সব ভুলে গেছে? সত্যি কি ভালোবেসেছিল নাকি স্বার্থপরতা ছিল? ও কি আসলেই স্বার্থপর একজন মানুষ। ভাবতে চাই না, কিন্তু ওর নিরুত্তর উত্তরগুলো তাই বলে দেয়।


সেদিন আসলে সকালটা ছিল আমার জন্য অন্যরকম। ওর স্পর্শ, ওর চাহনি, এর দেহের প্রতিটা বন্ধ যেন আমাকে মাতাল করে রাখতো। এক সন্ধ্যায় এসেছিল আমাকে বুকে। মাথা রেখে বলেছিল, তুমি থেকো প্রিয় আমার হয়ে। কপালে ছোট টিপ, মুখে দুষ্ট হাসি, লাল রংয়ের সেই কাপড়টা, চুলগুলো মুখের উপর ছুয়ে দিয়ে আমাকে করেছিল মাতাল প্রেমিক। ওটা যেন এক অবচেতন ঘুম, আর ভাঙ্গে না, কুল নেই, কোনো অবসাদ নেই। যেন ৩টিনির ছায়ায় পথিক আজ শান্ত। এভাবে আগুন পাখি বার বার ফিরে আসে, নিয়ে যায় নতুন স্বপ্নের দেশে। আমি ভাবতাম, এই হাতটা কখনোই ছাড়বো না, তাতে যত ঝড়ই আসুক। আগুন পাখিও কথা দিয়েছিল, কোনোভাবে সে আমাকে হারাতে দেবে না। সারা জীবন হাতটা ধরে রাখবে। ওকে নিয়ে কিছু সৃষ্টিশীল কাজ করারও ইচ্ছে ছিল। এর কিছু গুণ ছিল, যা আমাকে ভাবাত। কিন্তু সেগুলো আর ডানা মেলেনি ওর একগুয়েমি এবং নির্লিপ্ত মানসিক নির্ভাবনার জন্য। ওর চুলগুলো ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। একদিন দেখি কিছুটা চুল ছেটে ফেলেছে, সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিল। ওর ঠোঁট সব সময় যেন কথা বলতো। আসলে আমাকে ওর হাঁটা-চলা, কথা বলা, ওর চলে যাওয়ার বাতাসও আমার হয়ে গিয়েছিল। ওর জন্য মায়া লাগতো খুব। অনেক পরিশ্রমী ফুটফুটে আগুন পাখি, সেই সকালে বের হয়ে যেত। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে, ঘর পরিষ্কার, রান্নাবান্না, টুকিটাকি নানান কাজ করে যেত এক নাগারে। কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি। তার কাছের মানুষগুলো যেন দেখে দেখতো না। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওকে নিয়ে দূরে চলে যাই, যেখানে ওর প্রতিমা মুখটি সব সময় উচ্ছল থাকবে। কিন্তু সমাজ সংসার তো তা দেবে না। তাই, এভাবেই দু'জনে চিরকাল পাশাপাশি পথ চলার স্বপ্ন সাজিয়ে নেই। এটাও ভেবেছিলাম ওকে নিজে দূরদেশেই এক সুন্দর আকাশ তলে উড়ে বেড়াবো। যেখনে সমাজ-সংসারের কোনো বাঁধা থাকবে না।


সবই ঠিক ছিল, চলছিল আমাদের মতোই। হঠাৎ একটা ঝড় চলে আসে অলক্ষে। একটা মিথ্যে ঝড় এসে দাঁড়ায়। ওদের বাসার দ্বিতীয় লোলুপ পিচাছটা যে ওর দিকে আগেই নজর দিয়েছে, তা বুঝেছিলাম। টাকার গরমে সে আগুন পাখিটাকে বার বার হাতছানি দিচ্ছিল। সেদিন বাড়ির মালিক নিয়ে এসে, ঘরের লোক নিয়ে লোলুপ টাকার পিচাছটি আমার আগুন পাখির সামনেই আমাকে অপদস্ত করলো। আমার পাশে থেকে কোনো কিছুতো বলেইনি, বরং ওদের হয়েই কিনা আমাকে এভাবে চড়াও হলো। সেদিন রাতে অনেক কেঁদেছিলাম আমার পবিত্র ভালোবাসা কি তা হলে মিথ্যে ছিল। আগুন পাখি কি টাকার কাছে বিক্রি, নাকি তার উদ্যাত অহমিকা তাকে মাতাল করে দিয়েছে অনিশ্চয়তার বিদেশ বিভূঁই পথে। রাতে জ্বর চলে আসে, ভেবেছিলাম একবার হয়তো খোঁজ নেবে। কিন্তু অনিশ্চিত আগুন পাখি, সেদিনই যেন ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে একটা নিকশ কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এরপর আর আমার আগুন পাখিকে যেন দূরন্ত আকাশে ছুটতে দেখিনি। যেদিন চলে এলাম ওদের মহল্লা ছেড়ে, সেদিন লিখেছিল-

ভাল থাক, অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। পারলে ভুলে যেও।

আসলেই কি এটা সম্ভব। ও কি ভুলতে পেরেছে? ও কি কখনোই শিহরিত হয়না আমার স্পর্শ, গন্ধ, নির্মল নিঃস্বার্থ ভালোবাসার। নাকি টাকার হাতে স্বার্থের কবলে ও আজ ছটফট করছে। ভালোবাসা কি সত্যিই স্বার্থপর। এত সহজে বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাটা ধ্বংস করা যায়। আসার পর একজন দাবি করে কিছু অর্থ পায়। কিন্তু এটা নিয়েও লোলুপ পিচাছ অনেক নাটক সেরেছে। অবশেষে দাবিদার টাকাওয়ালাকে ডেকে ঠিকই টাকা দিয়েছি। কারণ, হয়তো আগুন পাখির প্রয়োজন। কিন্তু, আমার মনে হয়, তাও আগুন পাখি জানে না। কারণ ওরা তো আগুন পাখিকে সত্যি বলে না। মিথ্যে বেড়াজালে ওকে ঠকিয়ে চলেছিল নানাভাবে। আগুন পাখির প্রিয় মানুষটাও যে তাকে ঠকিয়েছে নানানভাবে, তাও আমি দেখেছি। কখনোই মূল্য দেয়নি ওকে। ওর সৌন্দর্য, ওর চাওয়া-পাওয়ার, ওর অনুভূতির সঠিক মূল্য দিতে কখনোই দেখিনি বরং নানা রংয়ের প্রজাপতি ছুঁয়ে আগুন পাখিকে করেছে অপবিত্র এবং নির্মোহ ৰণ্ডিত মাংস পিণ্ডে। আর আগুন পাখিকে বাঁচায় আটকিয়ে মনভোলানো বুলিতে আবিষ্ট করে জীবনের সরসতা থেকে বঞ্চিত করেছে। পাছে পাখিটা কষ্ট পায়, তাই কখনোই কিছু বলিনি। আর বলবোও না। ওদেরই বা কি দোষ! যে মানুষটা বুকের মাঝে টেনে নিয়ে নতুন সূচনা এনে দিয়েছে, সেই তো সেই সুন্দর সৃষ্টিকে অবহেলা, অপমান আর নিজের হিংসাত্মক অবহেলা দিয়ে ধ্বংস করেছে। আজ হয়তো আমি ভাল আছি, কিন্তু ওকে ভাল থাকার ভাগ দিতে পারি না ওর ভুলের জন্য। আজো ভাবি কেন ও বুঝেনি সত্যি মিথ্যের তফাৎ। কেন ওর কাছে মূল্য পায়। মনভোলানো মিথ্যে ভালোবাসা। কেন বুঝতে পারেনি নিঃস্বার্থ চোখের ভাষা এই আগুন্তুকের চোখে। তুই উড়ন্ত আগুন পাখি, তুই মনভোলানো মাতাল নয়। তোকে শত রং এঁকে দিব নতুন করে! তবু তোর চেতনা হোক! তুই ডানা ঝাপটে মরিস না, তুই আবার উড়ে চল দিগন্ত জুড়ে তোর মতো করে। যে পারবো না দিয়ে শুরু, তুইতো পেরেছিলি, আজো পারবি সব মান-অভিমান ভুলে নতুন করে। কোনো প্রশ্নবোধক নয়, কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নয়, সবকিছু ছাপিয়ে দু'হাতে ফুলের ডালি সাজিয়ে। আমার বিশ্বাস একদিন ভুল ভাঙবে এই রঙ্গশালার। আগুন পাখি তো তেমনই, সব জাল ছিড়ে উড়ে চলে। একদিন ঠিকই উড়বে মুক্তবিহঙ্গে সেই পাখিটা, যে পাখিটা আমি দেখেছি, আমি আবিষ্কার করেছি।


হয়তো একদিন দেখবো, আমার আকাশ জুড়ে উড়ন্ত আগুন পাখি উড়ে আসছে শত রংয়ের ডালি নিয়ে ভুবন সাজাতো।


[জীবন ও সমাজে- পাঠাতে পারেন আপনারও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ] 

Post a Comment

Previous Post Next Post