একজন ফরমান আলী!

লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইয়া  :


স্টেশনে পা রাখতেই বিকট শব্দে ট্রেনটা ছেড়ে দিল।ভাগ্যদোষ বলে একটা কথা আছে,উহা কারো কারো বেলায় কাকতালীয় ভাবে সঠিক বলে প্রমাণ হয়ে যায়।আর এই বচনটি যথার্থই সত্য, ইহা প্রমাণ করার জন্যই  বুঝি শাহাবুদ্দিন সাহেব অল্পের জন্য ট্রেন ফেল করলেন।কি আর করা, পরবর্তী ট্রেনের আশায় ১১ টা পর্যন্ত স্টেশনে বসে মশা মারা ছাড়া কোনো উপায় নাই।

টিকেট কাউন্টারে গিয়ে রাত ১১টার ট্রেনের টিকিট কিনে ওয়েটিং রুমের দিকে এগুতেই দ্রুত বামদিকে সরে গেলেন। কোথা থেকে ধাওয়া খেয়ে শুকনো এক কুকুর সামনে দিয়ে চলে গেল। কুকুরটির পায়ে লেগে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা  কোকের বোতল পাশের ঝোপে গিয়ে পড়লো। 

সাথে সাথে ম্যাও..... শব্দে একটা নাদুস নুদুস বিড়াল দৌড়ে পালালো।

ও হু, বিড়াল তো না, এক্কেবারে আত্তির বাচ্চা...

শাহাবুদ্দিন সাহেব পিছনে ঘুরে একজন আগন্তুককে দেখতে পেলেন। 

সামান্য হেসে বললেন, ঠিক আপনার উল্টো। 

মন্দ বলেন নাই স্যার,সারাদিন চা, বন-রুটি, পান খাই,তাই এই কেচ্ছার লাহান শরীর! হাসি মুখে বললো আগন্তুক। আর এই বিড়াল যা পায় তা তো খায় ই,আবার চুরি চামারি করেও খায়! হে কথায় হের শরীর আত্তির মতন হইছে।

আগে দর্শনদারী, পরে গুণ বিচারী - এই নীতিমালা ভুলে লোকটাকে ভালো লেগে গেল শাহাবুদ্দিন সাহেবের।




১১টার ট্রেন ঠিক মত আসবে তো?আগন্তুককে জিজ্ঞেস করলেন শাহাবুদ্দিন সাহেব। 

তার ঠিক ঠিকানা নাই। তবে দেরি হইলেও আইবে। বসেন স্যার।আরাম করে চা-পানি খান।সময় কাইট্টা যাইবে।

এখানে চায়ের দোকান কোনদিকে? 

আপনি বসেন, আমি চা লইয়া আহি- মতামতের অপেক্ষা না করেই হাটা শুরু করলো।

৫ মিনিটের মধ্যেই মাটির দুইটা ছোট্ট গ্লাসে চা নিয়ে ফিরে এল।

বাহ! গুড়ের গন্ধ পাচ্ছি। দারুণ তো!

হয় স্যার।মাটির গেলাসে দুধ দিয়ে গুড়ের চা, সেই টেস্ট!

টেস্ট? ভালো ইংরেজি জানেন তো!

জি স্যার। ইয়েস, নো ভেরিগুড, সরি  এইসব সাধারণ ইংরেজি ও জানি।

বেশ ভালো। চায়ের দাম কত?

১৪ টাকা।

এইটা রাখেন। আর বাকি টাকার পান খাবেন।

জি স্যার।বিলটা দিয়া আসি।

এই আগন্তুক না থাকলে বিশ্রী রকমের খারাপ লাগতো এই অপরিচিত স্টেশনে। 

স্যার,বিড়ি খান? বিল পরিশোধ করে মুখভর্তি পান নিয়ে পাশে এসে বসল আগন্তুক। 

না, খাই না।আপনি খেতে পারেন।আমার সমস্যা নাই।

জি স্যার খাইব।তবে একটু পর।

পর কেন? এখনই খান।

জি না স্যার। ভদ্রলোকের সামনে বিড়ি খাই না।

ও আচ্ছা! 

তবে কি জানেন স্যার? পান আর বিড়ি এক লগে খাইতে সেইরাম স্বাদ!

আপনি চাইলে এখনও দুইটা একসাথে খেতে পারেন।

কি যে কন স্যার! তয় বিড়ি একখান কানের পিডে বাজাইয়া রাখলে ভালাই লাগে। যাই লইয়া আহি একখান বিড়ি। বলেই জিরাফের মত লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল।কিন্তু পান-বিড়ির দোকান নজরে পড়ল না।

শাহাবুদ্দিন ভালো ভাবে হেলান দিয়ে বসলেন।

আপনের গাড়ি আজ আসবে না।

কি বলছেন এসব?

জি স্যার। সত্য কথা বলছি। আপনি আমারে চা খাওয়াইলেন, আপনার লগে কি মিছা কতা কইবার পারি?

কিন্তু এ কথা আপনাকে কে বললো? 

চায়ের বিল দিতে গিয়া জানলাম আজ ট্রেন আইবে না। কোথায় নাকি রেললাইনে বড় ধরনের সমস্যা হইছে।

আগন্তুকের কথা শেষ হয় না ট্রেন আসবে না গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েতেই স্টেশন খালি হতে শুরু করল।

এমনিতেই রাতের বেলা ট্রেনের যাত্রী কম থাকে এই এলাকায়। তার উপর ট্রেন আসবে না শুনে মুহূর্তেই স্টেশন শ্মশানের মত  শূন্য  হয়ে গেল।ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন শাহাবুদ্দিন সাহেব। 

স্যার কই যাইবেন?

প্রজেক্টেই ফিরে যাবো।

হে তো মেলা দূর। বহুত টাইম লাগবো। আগাইয়া দিমু? আপনে আমারে চা খাওয়াইলেন... এই রাইতে আপনেরে বিপদের মুখে ক্যামনে ফালাইয়া দেই?

বিপদ মানে?

এই যে এইখান থাইক্কা কত্তদূরে যাইবেন।তার উপর এই রাইতে রিক্সা যাইবে কিনা ওইদিকে...

দেখি বাইরে গিয়ে। দেখা হবে...

জি স্যার, দেখা হইবে! আগন্তুকের মুখটা শুকনো দেখালো। 

স্টেশনের বাইরে জনমানবশূন্য হয়ে গেছে এরই মধ্যে। ঘড়ি দেখলেন শাহাবুদ্দিন সাহেব। মাত্র রাত ৯ টা বেজে ২৫ মিনিট। অথচ এরই মধ্যে মনে হচ্ছে যেন বারোটা  বেজে গেল।

স্যার প্রজেক্টে যাবেন?

হঠাৎ অপরিচিত কণ্ঠ শুনে চমকে পিছনে ফিরে তাকালেন শাহাবুদ্দিন সাহেব। 

স্টেশনের লাইটগুলোর অস্পষ্ট আলো বলে দিচ্ছে তাদের  উপর ময়লার আস্তরণ ভালোই পড়েছে। হালকা আলোতে একজন রিক্সাচালককে দেখতে পেলেন।

হ্যাঁ, প্রজেক্টেই যাবো। কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে? 

ফরমান আলী কইয়েছে।

সে আবার কে?

ওই যে,যারে আপনে চা খাওয়াইলেন!

ও আচ্ছা। উনার নাম তবে ফরমার আলী?

জে স্যার।ক্যান আপনে জানেন না,?

জিজ্ঞেস করা হয়নি। আমি কি উঠবো রিক্সায়?

জে স্যার, উঠেন।

শাহাবুদ্দিন সাহেব রিক্সায় উঠতে গিয়ে ভাবলেন, সত্যিই তো, একটা মানুষ এত সময় ধরে কথা বললো  অথচ তার নামটাই জানা হয়নি? বড্ড অনুসূচনা হলো শাহাবুদ্দিন  সাহেবের।

রিক্সা চলছে। গ্রামের নীরব রাস্তা, তার উপর অপরিচিত। দুইপাশে গাছের সারির ফাঁকফোকর দিয়ে বাড়িঘর দেখা যায়। প্রায় সব বাড়িতেই বাতি জ্বলছে।

স্যার কি ডরাইতাছেন?

না তো। আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?

কি কন স্যার? আমার  গেরামে এইডা। দুনিয়ার জীবন আর পরকাল দুই জীবনই পাড় কইরা দিতাছি এই রাস্তায় গাড়ি চালাইয়া, মানুষজন পাড় কইরা...

দুনিয়ার... পরকাল...  আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, 

আপনি শিক্ষিত মানু, এইডা বুঝতে পারেন নাই? এই যে আপনি এই জলজ্যান্ত একখান মানু।দুনিয়াত বাস করছেন।আর আপনি যখন চক্ষু উল্টাইয়া মাটির নিচে চইল্যা যাইবেন, হেইড্যা হইলো পরকাল।যেইখানে আমি অহন বাস করি!বুঝলেন?

উত্তর দেবার শক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মুহুর্তেই। আশেপাশের ঝিঁঝিঁ পোকাদের ও  বাতাসের শব্দকে ছাড়িয়ে হার্ডবিটের শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন শাহাবুদ্দিন সাহেব। রিক্সার সিটটা দুইহাত দিয়ে শক্ত করে ধরার বৃথা চেষ্টা করলেন।ধীরে ধীরে চোখদুটো বন্ধ হয়ে এল।

স্যার... স্যার.... আপনের গাড়ির সময় হইয়া গেল। স্যার..

কারো ডাকাডাকিতে চোখ মেলে তাকিয়ে আগন্তুককে দেখতে পেলেন শাহাবুদ্দিন সাহেব।আগন্তুককে দেখে বেশ অবাক হলেন। ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।কাছে এসে গেছে ট্রেন।

স্যার ঘুমাইয়া পড়ছিলেন তাই এতক্ষণ ডাকি নাই। 

আ...মি...ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? তবে যে....

জে স্যার, ঘুমের মানুষরে অকারণে ডাকতে নাই।

এরই মধ্যে ট্রেন এসে থামলো। শাহাবুদ্দিন চিন্তিত মুখে ব্যাগের দিকে হাত বাড়াতেই আগন্তুক ব্যাগটা তুলে নিল।

চলেন স্যার আমি তুলে দেই আপনেরে।

শাহাবুদ্দিন ক্লান্ত পা ফেলে আগন্তুককে অনুসরণ করে একটা বগিতে গিয়ে উঠলো। জানালার ধারে সিটের দিকে ইঙ্গিত করে বসতে বলে ব্যাগটা বাড়িয়ে দিল আগন্তুক। 

কিছু একটা বলা দরকার জেনেও শাহাবুদ্দিন কোনো কথাই বলতে পারছেন না। আগন্তুককে দেখে কিছু মনে করার চেষ্টা করলেন।

স্যার আমি যাই- বলে ট্রেনের দরজার দিকে পা বাড়ালো আগন্তুক। 

ফরমান আলী....

চট করে ফিরে তাকালো আগন্তুক। সামান্য হাসলো।তারপর নেমে গিয়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো।

স্যার, আপনে ভালো লোক।

আপনি কি সত্যিই ফরমান আলী? 

শাহাবুদ্দিন সাহেব যতটা অবাক হয়েছেন,পুরোটাই প্রকাশ পেলো তার প্রশ্নে। আগন্তুকের মুখটা বেশ শান্ত দেখাচ্ছে।

আগন্তুকের ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠলো। সাথে সাথেই বিকট শব্দে ট্রেন চলতে শুরু করলো। আগন্তুকের কথা কিছুই শুনতে পেলেন না শাহাবুদ্দিন সাহেব। 

ট্রেন এগিয়ে চলছে,পিছনে সরে যাচ্ছে আগন্তুক। ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি বেড়ে যাচ্ছে। ট্রেনের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে শরীর বেশ দুলে দুলে উঠতে লাগলো। কিন্তু একি! হঠাৎ করেই ট্রেনের গতির চেয়ে শরীর বেশি  দুলছে মনে হচ্ছে...শাহাবুদ্দিন সাহেব বুঝার চেষ্টা করলেন।শরীর দুলে উঠার সাথে একটা কণ্ঠও শোনা যাচ্ছে।

এই যে ভাই, শুনতে পাচ্ছেন? এই যে ভাই...

শাহাবুদ্দিন চমকে উঠে চোখ মেললেন।ঘোলাটে চোখে তাকালেন।সামনে আবছা একটা মূর্তি দেখতে পেলেন।অনেকটা মুখের কাছে ঝুলে আছে যেন!

সামনেই আপনার স্টেশন। নামার প্রস্তুতি নিন। এই বগিতে যারা ছিল তারা আগের স্টেশনে নেমে গেছে।

ভদ্রলোকের কথা শুনে ঘুম ছুটে গেল শাহাবুদ্দিন সাহেবের।বুঝলেন উনি ট্রেনের টিকিট মাষ্টার। 

ধন্যবাদ আপনাকে।আপনি দায়িত্বশীল মানুষ। কথা বলার সাথে সাথে উপর থেকে ব্যাগটা নামিয়ে নিলেন। 

এটা আমার ডিউটি ভাই। হাসলেন ভদ্রলোক। 

শাহাবুদ্দিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোকের মুখে।এই হাসিটা তার খুবই চেনা মনে হলো। হঠাৎ চোখ পড়লো ভদ্রলোকের বুকের বাম দিকে। কালো নেমপ্লেটের উপর সিলভার রঙের কালিতে লেখা- ফরমান আলী! 

অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলেন,ফরমান আলী.... 

ফরমান আলী হাসলেন।কথা বললেন না।

এ কি করে সম্ভব? ট্রেন ধরতে না পারা থেকে শুরু করে জেগে উঠার আগ পর্যন্ত সবই কি স্বপ্ন ছিল?যদি স্বপ্নই হয়,তবে ফরমান আলী নামটা মিলে গেল কীভাবে? 

ট্রেনের গতি এরই মধ্যে কমে এসেছে। শাহাবুদ্দিন সাহেব তাকালেন ফরমান আলীর দিকে। ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে  দুই হাত দুই দিকে দিয়ে দরজা ধরে হালকা গতিতে দুলছে ফরমান আলী। মুখে লেগে আছে সেই পরিচিত হাসি। বড়ই অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে।

শাহাবুদ্দিন সাহেব কিছু বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু  মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো  না। মনে হলো, সে আর এই অদ্ভুত  ফরমান আলী ছাড়া এই ট্রেনে মানুষ নামের অন্য কোনো প্রাণী নেই। ডান হাতে ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ট্রেন থামার অপেক্ষা করতে লাগলেন।


লেখক : লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইায়া

শিক্ষিকা, বটমলী হোম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়

ফেইসবুক লিংক : Lucky Corraya


[জীবন ও সমাজে- পাঠাতে পারেন আপনারও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ] 


Post a Comment

Previous Post Next Post