সুখহীন জীবন

রত্না বাড়ৈ হাওলাদার : জীবনতো একটিই। কিন্তু তার গতিবিধি হরেক রকমের। কখনো সাদা, কখনো আবার কালো। কখনো কারো জীবনে আসে আলো, আবার কারো অন্ধকার। কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। তবে বাস্তবতা হলো, অন্যায় করলে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু ভুল করলে যে তার মাসুল দিতেই হবে। ভুল তো ভুলই। তার জন্য জীবনভর খেসারত তো দিতেই হবে। উপরন্তু আমরণ বিবেকের দংশনে নিশেষিত হতে হয় বৈকি। জ্বলে-পুড়ে ছারখার করে দেয়। পদ্মপাতার ঝলমল রোদ্দুরে জীবনের জলতরঙ্গের ন্যায়।

তিরস্কৃত মেয়েটি প্রমীলা। দুষ্ট সাথীদের সংস্পর্শে ছোট বয়সে আবেগে আপ্লুত হয়ে ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে, শান্ত স্বভাবের মেয়েটি চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাশ্ববর্তী গ্রামের ছেলে অসীমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। গ্রামের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল। সেসময় পিতা-মাতাদ্বয়ের অসম্মানজনক ঐ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন এক মুহূর্ত ছিল। লজ্জা, ঘৃণা-অপমানে বিমর্ষ এক অবস্থা। কাউকে মুখ দেখাবার জো ছিল না। পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন মুখে থু-থু দিচ্ছে। এহেন একটি পরিস্থিতির স্বীকার হবে! আসলে এই অবস্থার জন্য তারা কখনোই প্রস্তুত ছিলেন না। মেয়ে মা-বাবার মুখে চুনকালি লেপে দিল। সন্তান নামের কলঙ্ক। রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে তারা বিহব্বল হয়ে পড়েছিল। তারপরও নিজের সন্তান বলে কথা। ভারাক্রান্ত পিতা-মাতাদ্বয়ের হৃদয়খানি মেয়েটির জন্য ভীষণ ব্যাকুল হয়ে পড়ছিল। শত হলেও তো জন্মদাতা-দায়িনী। মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন। তাইতো যেন মনটি খুব আনচান্ করছিল। বিচলিত হচ্ছিল। চিন্তায় মাথা ভারী হয়ে ছিল। আসলে চিন্তা রোগ সে কি আর বলে-কয়ে আসে ? কি জানি অবুঝ সন্তানটিকে এভাবে একা ছেড়ে দিলে পরবর্তীতে তাকে কতো কষ্টভোগই না করতে হবে। তাছাড়া, আরো কতই না জটিলতার মধ্যে পড়তে হবে। কে বলতে পারে?

সুখহীন জীবন

যা হোক্  মনে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা ব্যাপারটিকে অতটা সহজভাবে মানিয়ে নিতে পারছিল না। নেয়াটা সম্ভবও নয়। কারণ লেখাপড়া জানা ছেলে সরকারি চাকুরি করছে। তাকে নিয়ে তাদের কত ভবিষ্যত স্বপ্ন আশা ভরসা ছিল। যৌতুকের মত লোভনীয় ব্যাপার তো রয়েছেই তাদের চিন্তার অংশ হিসেবে। কিন্তু এক নিমেষে সেসব যেন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। অবশ্য ছেলেটি বুদ্ধি এবং সাহসিকতার সাথে বিয়ে করে তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে সঙ্গে করে সরাসরি নিজের বাড়িতেই উঠেছিল। আর সেকারণেই বাড়ির লোকজন কোনভাবেই তাদের তাড়িয়ে দিতে পারছিল না। আবার ভালোভাবে মেনে নিয়েছে বা ভালো চোখে দেখছে বলে তাও মনে হয়নি।  

দেখতে-দেখতে দুটি বছর পার করল তারা। এরই মধ্যে ঘরে একটি কন্যা সন্তান চলে আসলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বন্ধন বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল যা আরও সুগভীর হয়ে উঠল। যা কিনা সাধারণত সৃষ্টির রহস্য অনুসারেই হয়ে থাকে। একটি দাম্পত্য সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাকে অতিদ্রুত কাছে টেনে নেয় একটি সন্তানকে ঘিরে। কারণ সন্তানের মুখের দিকে তাকালে যে কোন অসুখ সংসারে চির ধরাতে পারে না। বরং একজন দায়িত্ববান পিতা-মাতা হতে শেখায়।

ভালো-মন্দ মিলিয়ে সময়টি বেশ নিজের গতিপথে চলতে লাগল। দুটো পরিবারের সঙ্গে মোটামুটি সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়ে গেল। ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই একসাথে মধুর সম্পর্কে দিনাতিপাত করছিল। হঠাৎ করেই প্রমীলার মনটা অস্থির হতে লাগল। কোথাও গিয়ে শান্তি পাচ্ছে না। বুকের ভেতরটা শুধু ধপ্-ধপ্ করছে। এদিকে অনেক রাত হয়েছে। কিন্তু প্রমীলার স্বামী ঘরে ফিরছে না। অফিসে বেতনের দিনটি সচরাচর একটু দেরি হয়। কিন্তু আজ যেন একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। প্রমীলা কলের পর কল করে যাচ্ছে। কিন্তু ফোন তো তুলছে না। কি হলো কি হতে পারে? ওর মনের ভিতরে ভীষণ কু ডাকছে। অতিনিকটের কেউ সমস্যায় পড়লে মনটা বুঝি আগেই টের পেয়ে যায়। ইতোমধ্যে, বাড়ির প্রত্যেকেই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। প্রমীলা নিরূপায় হয়ে বাবার বাড়িতে ফোন করছে। ফোন পেয়ে বাবা, ভাই অন্য সকলে ছুটে এলো। সত্যি আজকে তার এই চরম বিপদে কেউ আর অভিমান করে থাকতে পারল না। কারো বিপদে মুখ ঘুরিয়ে থাকা সেতো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সবাই ছুটে এলো। ভীষণভাবে চেষ্টা করছিল খোঁজ করার। পাশেই থানাতে জিইডি করা হলো। পুলিশ তৎপর হয়ে খুঁজতে লাগল। এক পর্যায়ে পুলিশ একটি লাশ খুঁজে পেল। যাকে খুন করে একটি লেকের পাশে ফেলে রেখেছিল। প্রমীলাসহ প্রত্যেকেই দৌঁড়ে গেল। লাশটি শনাক্ত করতেই দেখতে পেল নিজের স্বামী অসীমেরই লাশ। প্রমীলার শক্তি ক্ষীণ হয়ে ওখানেই অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে গেল। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অসীমের মা-বোনের কান্না ও বিলাপে গাছের পাতা পর্যন্ত ঝরে পড়ছিল। সত্যি বলতে কি মৃত্যু তো বিধাতার হাতে। তাই বলে অকাল এবং নেক্কারজনক মৃত্যু কি সহ্য করা যায়? মেনে নেয়া সম্ভব? 

খুব সম্ভবত চেনা-জানা কেউ হবে। কারণ ওর বেতনের তারিখটি মনে রেখে, আসলে জেনে-বুঝেই এমনটি করেছে। হয়তো লোকটাকে সে চিনে ফেলেছিল। তাই হয়তো তাকে ওরা প্রাণে বাঁচতে দেয়নি। সৃষ্টিকর্তার এ কেমন রহস্য! ভেবে পাচ্ছিল না প্রমীলা। এত ছোট শিশু নিয়ে কোথায় যাবে। এ যেন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এ কেমন বিপর্যয়? কি করবে কিছুই বোধগম্য নয়। যেন অসীম তাকে সায়ারে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল। সে ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছে। মাথার ওপর থেকে ছাদটুকুও যে নিমজ্জিত হয়ে গেল। বেঁচে থেকেও মরে যাওয়ার সমান। কিভাবে ভুলে থাকবে অসীমকে। জোর করে এই অসহায়ত্বকে মেনে নিতে হচ্ছে। এর ব্যতিরেকে তার যে আর কোন উপায় নেই। এযে ললাটের লিখন। থেকে-থেকে প্রমীলা শুধু ভাবছে সেই আমলের সতীদাহ প্রথাই যেন ভালো ছিল। জীবিত থেকে আগুনে পুড়ে ছারখার হবার থেকে। একসঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেই যে ভালো ছিল।

অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষে বাবা তার সন্তানসহ নিজের বাড়িতে নিয়ে আসলেন। কিন্তু ওখানে এসে ভাইয়ের বউ এর গলগ্রহ হয়ে পড়ল প্রমীলা। তার ভিন্নতর আচরণ। তাছাড়া ভাইয়ের সঙ্গে সারাক্ষণ বৌয়ের ঝগড়া-ঝাটি। এ যেন এক নরকের জ্বালা। আগুনের সমতুল্য। দু্ই মাস যেতে না যেতেই আবার আরেকটি দুর্ঘটনার শিকার। হঠাৎ করে বাবার লিভার ক্যান্সার ধরা পড়াতে তিনিও এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। প্রমীলা এত ছোট শিশুকে নিয়ে কি করবে! এখন কোথায় তাদের গতি হবে! কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। মাথা কাজ করছিল না। একদিকে বাবার শোক সামলানো যেন বুকে একটি শেল বেঁধে আছে। ভীষণ কষ্ট। যা বুঝানো মোটেই সম্ভব নয়। মা হবার ক্ষমতাটুকু সে যে হারিয়ে গেল। তবে একটি কথা না বললেই নয়, প্রমীলা শত দুঃখ-কষ্টের ভিতরে তার লেখাপড়া ছাড়েনি। বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে হয়তো কিছুটা গ্যাপ ছিল।

সত্যি হলো, সময় কারো জন্য অপেক্ষাও করে না, থেমে থাকে না। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই সঙ্গে থাকেন। প্রমীলা এই তিন বছরের মধ্যে বিএবিএড শেষ করে। অবশ্য এহেন প্রতিকূলতার মধ্যে পড়াশুনা করতে তাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। নিশ্চয়ই পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছিল এবং সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিলেন। নচেৎ কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। এদিকে তাকে এবং তার মেয়ে সন্তানটিকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য ভাইকে বৌয়ের কাছ থেকে অকথ্য গালিগালাজ, অপমান, অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। যা শুধুমাত্র নিজের বোন বলে মুখবুজে সহ্য করছে।

কিন্তু এক পর্যায়ে যেন সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হলো। অতপর মা-বোন অন্য সবার মায়া ত্যাগ করে সে চলে গেল মরণ সাগরপাড়ে। এমন পরিস্থিতিতে প্রমীলার মানসিক অবস্থা এতটাই বিপর্যস্ত ছিল যে, সে সময়ে সে বুঝতেই পারছে না যে, সেকি ঠিক মাটির উপর দিয়ে হাঁটছে কিনা! সে যেন দিক হারিয়ে ফেলছে। ভাই সে যে রক্তের বাঁধন। প্রবাদ আছে “ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধনে যদিও পৃথক হয় নারীর কারণে। ভাই নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তারই প্রমাণ করে গেল। ওদিকে মাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। এই বয়সে এতগুলো শোক সহ্য করা মায়ের পক্ষে কতটা কষ্টকর তা শুধু সৃষ্টিকর্তাই জানেন। তার উপরে আবার চোখের সামনে এতটুকু মেয়ের বৈধব্য। মা যেন জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছেন।

প্রমীলা প্রাণপণ করে ছুটে চলছে একটি চাকুরির প্রচেষ্টায়। একটি চাকুরির বিজ্ঞপ্তি স্কুলে লোক নিয়োগ করা হবে। প্রমীলা সেখানে দরখাস্ত লিখে হঠাৎ করে আবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। তাই মাকে দিয়ে সেটি পাঠাতে বাধ্য হলো। যেহেতু জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল। মা সেখানে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও ঐ ঠিকানাটা জোগাড় করতে অপারগ হলে, পাশে অন্য একটি স্কুলের ঠিকানায় তাদের নিজস্ব পোস্টবক্সে চিঠিটি ফেলে রেখে চলে আসলেন।

প্রমীলা ভীষণ নিরাশ হয়ে পড়েছিল। এবারেও বোধহয় কিছু মিলল না। আপাতত আর কোন সুযোগ নেই। কি করবে ধোঁয়াশায় পড়ে গেল প্রমীলা। ঘরের পুরুষ মানুষগুলো এক-এক করে চলে গেল না ফেরার দেশে। মাথাটা একেবারে কাজ করছে না। জীবনটা যেন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। শুধু অবিচ্ছেদ্য জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখা সন্তানটি এবং মায়ের কারণে। তবে না খেয়ে আধপেটা খেয়ে আর কতদিন বাঁচা যায়। শিক্ষার জ্ঞানটুকু ভিতরে রেখে, অন্যের কাছে হাত পেতে ভিক্ষাবৃত্তি লজ্জাজনকই মনে হয় নিজের কাছে। দংশনের জ্বালা বেড়ে যায়। সত্যিই কি সবকিছু কপালের লিখন? মাঝে-মধ্যে ভীষণ ভাবিয়ে তোলে। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়। এ কেমন অভিশপ্ত জীবন?

এবারে আবার আরেকটি মহাপরীক্ষা। কিছুদিন যেতেই সৃষ্টিকর্তা প্রমীলার জন্মদায়িনী দশভুজা মা জননীকে স্বার্থপরের মত নিজের কাছে তুলে নিলেন। মানুষ কি করে জীবদ্দশায় এতটা মর্মান্তিক নৃশংস যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে? কি অপরাধ ছিল তার? এ কেমন ধৈর্য পরীক্ষা? কি ভুল করেছিল সে? ভালোবেসে তো একজনকেই বিয়ে করছিল সে। কিছুই যেন বোধগম্য নয়। এবার প্রমীলা সত্যিই কষ্টের ভারে নুয়ে পড়ছে। নিরাশ হয়ে পড়ছে। ওর কষ্ট লাঘবকারিণী বিশ্বস্ত বন্ধু। যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়, ওর মা জননী তিনি ও যে আর রইলেন না। মেয়ে-নাতিনেরে পাহারায়। এও কি বিশ্বাসযোগ্য কথা। এক জীবনে এতো ঝড়। কথায় বলে “অল্প শোকে কাতর, আর অধিক শোকে পাথর। তা না হলে প্রমীলার বাঁচার কোন রাস্তায় আর থাকত না ।

স্বপ্নের মত শোনালেও লেখাটি সত্যি ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা। জীবিত অবস্থাতে মা যে স্কুলটিতে দরখাস্ত দিয়েছেলেন। ঠিক সেই স্কুলটিতেই চাকুরির ডাক পড়ল প্রমীলার, তবে তা তার মায়ের মৃত্যুর পর। মা তা দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু চাকুরিটি তার মেয়ের ভীষণ দরকার ছিল। সে ব্যাপারটি তিনি জানতেন। তারপরও বুকভরা ব্যথা নিয়ে চলে গিয়েছেন এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে। মাগো-মারে তুমিও চলে গেলে? নিরূপায় ছিলেন তিনি। কেননা জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সবই বিধাতার নির্ধারিত। অবশেষে প্রমীলা চাকুরিতে ঢুকে গেল। কারণ এখানে যে মায়ের আশীর্বাদ রয়েছেেই। তাই সে মায়ের আদরে সারাজীবন চাকুরিটিকে আগলে রাখল।

জীবন কখনোই অপেক্ষমান নয়, থেমেও থাকে না। প্রমীলাও জীবনের বন্ধুর পথে এগিয়ে চলেছে। অল্প বয়সে আজ সে গেরুয়া বসনে। বৈধব্য জীবন যাপন করছে। কবি তার কবিতায় তাই লিখেছেন --মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে--।

Post a Comment

Previous Post Next Post