জাতি গঠনে যুবসমাজের ভূমিকা ও করণীয়

লিটন আরিন্দা : 

বাংলাদেশ যুবসামজের তরুণ্য হু-হু করে বেড়েই চলছে। দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠি হলো যুবসমাজ। তাদের এই আগুনসম তারুণ্য শক্তি যে কোন দেশের সম্ভাবনাময় উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশের যুবসমাজ সেই মহান কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করে যাচ্ছে। সমাজ ও দেশ গড়ার কাজে তাদের অংশগ্রহণ ও অবদান অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। দেশের এই যুবশক্তিকে সঠিকভাবে যদি নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নেয়া যায়, তবে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে যুবসমাজ ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ


আরো পড়ুন: স্বতন্ত্র মূল্যবোধে গড়ে উঠুক ছাত্ররাজনীতি


শিক্ষিত যুবসমাজ: দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুবসমাজের উপস্থিতি বেড়েই চলেছে। স্কুল থেকে শুরু করে, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, পলিটেকনিকাল কলেজ ইত্যাদিতে তাদের বলিষ্ঠ উপস্থিতি দেশের হৃদয়ের ধমনী ও শিরা-উপশিরাকে গতি এনে দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কারিকুলামের পড়াশুনার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে তাদের দেশ বিনির্মাণের জন্য প্রস্তুতি দৃশ্যমান। ভরা যৌবনে যুবসমাজের বেড়ে উঠা ও নিজ ভিত্তি গঠনে অংশগ্রহণ অতীব আশার সঞ্চার করে। দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক খেলাধূলার আয়োজন, শিল্প-সাহিত্য চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিবার, সমাজ ও জাতিকে গতিশীল রেখেছে। বর্তমান নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি বিদেশী সংস্কৃতি চর্চাতেও এই যুবসমাজের জড়িত হতে দেখা যাচ্ছে। এ যুবসমাজ দেশের অভ্যন্তরে লেখাপড়া যেমন করছে, তেমনি দেশের বাইরে গিয়েও বিভিন্ন স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রি অর্জন করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তাদের চলার পথ সীমাহীন, তাদের সম্মুখপানে চলার পথ। কোনো ঘাত-প্রতিঘাত তাদের চলার পথকে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারবে না বলেই বিশ্বাস করি।

 জাতি গঠনে যুবসমাজের ভূমিকা ও করণীয়


দেশের প্রধান খাত পোশাক শিল্প’ যুব সমাজের অংশগ্রহণে প্রসারিত হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ৭০ লক্ষ পোশাক কর্মীদের সিংহভাগই যুবসমাজের প্রতিনিধি। কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে, তেমনি বৈদেশিক আয় ও রেমিট্যান্স মজবুত হচ্ছে। বৈদেশিক অর্থের রিজার্ভ যে কোন সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।




বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক ও অনৈতিক অবক্ষয়: বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে এই শক্তিমান যুবগতিকে ব্যবহার করা ও সঠিক পথ নির্দেশনা দেয়া একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। উদীয়মান যুবসমাজ অপটিকাল ফাইবারের সুবাদে সহজেই জ্ঞান সাগরে সাঁতার দিতে শুরু করেছে। কোনো বিপদ তাদের চলার গতিকে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারে না, বিপদকে আমলে না নিয়ে নতুন কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটি মানসিকতা বিকশিত হচ্ছে। তারুণ্যের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করেছে অনেকাংশে। আবার এর উল্টো দিকেও সমাজে ডালপালা মেলে ধরেছে, অনেকাংশে আবার এর উল্টো দিকেও সমাজে ডালপালা  যে মেলে ধরছে না সেটা বলা অনিশ্চিত। কিন্তু অসৎ সঙ্গ উজ্জ্বল জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে যুবশক্তিকে ক্ষয়িষ্ণু পথে প্রভাবিত করছে। পরিবারে তাদের নিয়ে উদ্ধেগ যেমন বাড়ছে, তেমনি পারিবারিক সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ-কেউ পরিবারে বোঝাস্বরুপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


যুব সমাজের একটি বড় অংশ দেশের বিভিন্ন শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়া করছে এটা যেমন সত্য, তেমনি নানা মানুষের সঙ্গে পরিচিতি হয়ে ও সংস্পর্শে এসে জঙ্গীবাদ দর্শনের নেতিবাচক মতাদর্শের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধারণা করা হতো যে, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদ একমাত্র ধর্মীয় ধারণা থেকেই আবির্ভূত। 


ভিন্ন মতাদর্শী ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ ও আবাসনে থাকার ফলে বা বিভিন্ন কারণে তারা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ছে। অধুনা সেই ধারণাকে পাল্টে দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অংশ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ধনাঢ্য পরিবারের শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গীবাদ কর্মকান্ডে। এমনকি কতিপয় সুনামধারী কলেজ ও ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তথ্য-প্রযুক্তির আশীর্বাদে মুহূর্তের মধ্যেই যুক্ত হচ্ছে দেশ বিরোধী ও সমাজ বিরোধী কর্মকান্ডের সাথে। যুবসমাজের একটি বড় অংশ জড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটের নেশায়। আত্মগঠনের সময়ে মানানিবেশ না করে নানা ইলেট্রিক্যাল ডিভাইস, গেমস্ এ্যাপসে সময় অপব্যবহার করছে। নিজের ও পরিবারের সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। তাদের দেখা-দেখি অনুজারাও নানা বদভ্যাস গড়ে তুলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেইসবুক, হোয়াটস্ এ্যাপস, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ওয়েবসাইট ইত্যাদির প্রভাবে সহজেই প্রভাবিত হচ্ছে বর্তমান যুবসমাজ। নানা কৌশলে এক শ্রেণীর লোক তাদের নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে নিচ্ছে ও অপরাধচক্রের সাথে যুক্ত হয়ে তাদের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। অল্প বয়সী মেয়েদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করে যেমন; প্রতারণা করছে, তেমনি কিছু অভিভাবকও দায়িত্বহীন আচরণ করছে যা তাদের সন্তানদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে যথাযথ গঠন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সন্তানদের অপরাধ ও জঙ্গীবাদের মতো ভয়ঙ্করী অপকর্মের সাথে যুক্ত হওয়া পরিবার ও সমাজের জন্য কোনভাবেই কাম্য নয়। পরিবার ও সমাজকে এ ধরণের আপরাধ ও বিপদসংকুল অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই সচেষ্ট না হলে ভয়াবহ পরিণতির দিকে সমাজ যে কোন সময় প্রভাবিত হতে পারে। যুবশক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে যুবাদের যেমন বড় ভূমিকা রয়েছে, তেমনি অভিভাবকদের দায়িত্বও অপরিসীম। পরিবার যদি নৈতিক জীবন-যাপন করে, সেখানে সন্তানেরাও মানবিক গঠনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পায়। প্রার্থনাপূর্ণ জীবন ও নৈতিক জীবন আদর্শিক জায়গায় নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখে। তাই পরিবার, সমাজ ও যুবসমাজের শিল্প-সাহিত্য চর্চা, ক্রীড়া-সাংস্কৃতিক বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি ও পারিবারিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী করতেই হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যুবাদের গঠনে উদ্যেগ গ্রহণ করা জরুরী। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর যাতে তারা যথাযথ কর্মসংস্থানে যেতে পারে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা শিল্প-সাহিত্য, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পরিধি বাড়াতে হবে। নতুন-নতুন উদ্ভাবনী কাজে উৎসাহিত করে যুব মানোবল গঠনে  পরিবার, সমাজ ও সর্বোপরি রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে হবে। এতে কোন যুবশক্তি তার বিকাশমান অবস্থা থেকে বিচ্যুত হবে না। পরিবার যেমন লাভ করবে ‘সোনার সন্তান’ তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্র পাবে সুযোগ্য নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ যোগ্য উওরসূরী।


আরো পড়ুন: ক্যাথলিকদের বিশ্ব যুব দিবস


পরিশেষে বলা যায়, যুবশক্তি জাতি গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাই তাদের সঠিক পথে গড়ে তোলা জাতির মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য। কাজেই, তাদের গঠনদানে সমাজ ও রাষ্ট্র কোনভাবেই যাতে কার্পণ্য না করে। যুবসমাজ গঠনে পরিকল্পিত কাঠামো ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা আমাদের প্রয়োজন কেননা এর মধ্যদিয়েই দেশ একটি সৃষ্টিশীল ও যুবশক্তিতে সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার পাবে। আসুন তাদের এই পথ চলায় সবাই সামিল হই।

litonarinda1996@gmail.com


[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]  


Post a Comment

Previous Post Next Post