বিপন্ন মানুষের পাশে লক্ষ্মীবাজারস্থ কাথলিক ধর্মপল্লী

ডিকন বাধন রোজারিও ও জ্যাষ্টিন গোমেজ : 

মানুষ মানুষের জন্য। যখন কোনো মানুষ বিপদাপন্ন হয়, তখন যারা বিপন্নের পাশে দাঁড়ায়; সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে উষ্ণতার পরশ ছড়িয়ে দেন তারাইতো প্রকৃত মানুষ। করোনায় দেশের এই ক্রান্তিকালে উদার-নৈতিক ও মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের লক্ষ্মীবাজারস্থ পবিত্র ক্রুশ ধর্মপল্লী। এই ফিচারটি সাজানো হয়েছে অত্র ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার জেমস শ্যামল গমেজ সিএসসি’র ধর্মপল্লীর পক্ষ থেকে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গল্প যা সকলকে অনুপ্রাণিত করে ও করোনাকালীন দরিদ্র ও ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহিত করে। করোনা সঙ্কটকালীন ধর্মপল্লীর পক্ষ তিনি অস্বচ্ছল পরিবার, কর্মজীবি, গাড়ী চালক ও বিউটি পার্লারের মেয়েদের জন্য নিয়েছেন বহুমুখী পদক্ষেপ যা অনেক পরিবারকে মহামারী সঙ্কটকালীন ঘুরে দাঁড়াতে সুযোগ করে দিয়েছে। সারাবিশ্ব তথা বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদী লকডাউনের ফলে এক শ্রেণির মানুষের ওপর অর্থনীতির চাপ পড়েছে প্রচন্ডভাবে। দিনমজুর তো আধমরা অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। কোন ব্যতিক্রম ছিল না লক্ষ্মীবাজারের এই ধর্মপল্লীতেও। উল্লেখ্য, পালক-পুরোহিত নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারপরও তিনি সেবার কাজ অব্যাহত রেখেছেন যা সাধুবাদ পাওয়ারই দাবীদার। অতিদরিদ্র মানুষগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে একাত্মতা ও সম্প্রীতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তন্মধ্যে, প্রায় ৭০টি পরিবার মুসলিম ও হিন্দু পরিবার অন্তর্ভূক্ত ছিল। আর এই কাজ সফলভাবে করার নেপথ্যে রয়েছে বিভিন্ন স্বচ্ছল, সদিচ্ছাপূর্ণ ও সাহায্যকারী ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা যা নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে সম্ভবপর হয়েছে।

বিপন্ন মানুষের পাশে লক্ষ্মীবাজারস্থ কাথলিক ধর্মপল্লী


 করোনাকালীন সময়ে আপনাদের ধর্মপল্লী মূলত যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে তিনি বলেন- 

👉প্রথমত, ধর্মপল্লীর গরীব, প্রান্তিক ও চাহিদাসম্পন্ন লোকদের একটি সমীক্ষা করা হয়। তারপর তাদের প্রয়োজনগুলোকে চিহ্নিত করা হয় এবং চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে খাদ্য চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য দ্রব্য ও আর্থিক অনুদান দেয়া হয়। হিসেব অনুযায়ী, মোট ২৩৬টি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছি। মূলত, প্রয়োজনীয় খাদ্য, ঔষধ, জীবাণুনাশক স্যানিটাইজার ও সাবান প্রদান; এবং আর্থিকভাবে শিক্ষা ও চিকিৎসা অনুদান দেয়া হয়েছে। মূলত, পরিবারগুলোকে একবার নয় কিন্তু একাধিকবার অনুদান দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের মনোবল ও ধর্মবিশ্বাস রক্ষার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে; পারিবারিক মালা প্রার্থনা ও মহামান্য কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও সিএসসি এর পৌরহিত্যে অনলাইন খ্রিস্টযাগে যোগদানের জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। তবে এগুলো করা এতটা সহজ ছিল না। দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য যথেষ্ট আর্থিক যোগান দেয়া খুবই কষ্টকর ছিল। পরিতাপের বিষয় হলো, এখনও হতদরিদ্রদের সহযোগিতা পৌঁছে দিতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাছাড়া, অনুদানকারী বা উপকারী বন্ধুদের সঙ্কটও ছিল প্রকট। আবার, অনুদান সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার সমস্যাতো ছিলই। অন্যদিকে, অভাবগ্রস্ত পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে অনেকবার বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, আমরা সুনির্দিষ্ট এলাকায় প্রতিনিধির মাধ্যমে বাকী পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে পরিবারগুলোকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুদান বিতরণের সময় বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য বেশি সংখ্যক ব্যক্তির স্বেচ্ছাসেবা গ্রহণ করতে হয়েছে।

দুস্থ ও অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে আপনাদের অনুপ্রেরণা কি ছিল তা জানতে চাইলে তিনি বলেন- 

👉যিশু খ্রিস্ট নিজেই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুপ্রেরণা, যিনি সর্বদা গরীব প্রান্তিক, অভাবী ও ছিন্নমূল মানুষদের কথা চিন্তা করেছেন, অগ্রাধিকার দিয়েছেন ও তাদের মঙ্গলকাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এছাড়াও  অনুদানকারী, উপকারী বন্ধুগণ ও সাহায্যকারীগণও আমাদের অনুপ্রেরণার বড় উৎস। মাদার তেরেজা নিস্বার্থ ভালোবাসা ও সেবাও আমাদের অনুপ্রেরণা করেছে। আমাদের ধর্মপল্লীর নিজস্ব আর্থিক তহবিল ছাড়াও অনেক উদার বন্ধুগণ তাদের সামর্থ অনুযায়ী সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন যা এই সঙ্কটকালে অত্যন্ত জরুরী ছিল। তন্মধ্যে, ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের মহামান্য আর্চবিশপ কার্ডিনাল, কারিতাস, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় স্কুল-কলেজগুলো এবং ধর্মপল্লীর দেশী-বিদেশী বন্ধুগণ। এছাড়াও, আরএনডিএম সিস্টারগণ ও হলিক্রশ ব্রাদারগণ, মিশনারীস্ অব চ্যারিটি সম্প্রদায়ের সিস্টারগণ, ধর্মপল্লীর বিসিএসএম ও যুবক-যুবতী ভাইবোনেরা, বিদেশে আমার ভাইবোন ও আত্মীয়-স্বজন;  এবং অন্যান্য বন্ধুগণ উদারভাবে সাহায্য করেছে। 

বৈশ্বিক এই দুর্যোগকালীন খ্রিস্টভক্তদের পালকীয় যত্নে আপনাদের অগ্রণী ভূমিকা ও খ্রিস্টভক্তদের সাড়া কেমন ছিল? 


করোনার এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি মনে করি এ ধর্মপল্লীর খ্রীষ্টভক্তদের আধ্যাত্মিক জীবন সাধনায় ও সেবাকাজে যথাযথভাবে সাড়া দিতে সচেষ্ট ছিলেন। পবিত্র ক্রুশ ধর্মপল্লীর প্রধান লক্ষ্য ছিল এই নতুন বাস্তবতায় নতুনভাবে পালকীয় যত্ন, পালকীয় সেবা ও পালকীয় সাহস নিয়ে সকলকে সম্পৃক্ত করে কোন কিছু করা। সেগুলোর মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য:

  • আমাদের লক্ষ্মীবাজার ধর্মপল্লীর অন্তর্গত বড় একটি সংখ্যার মানুষ দরিদ্র। আমরা সামর্থ অনুযায়ী চেষ্টা করেছি তাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও অন্যান্য যাবতীয় সরবরাহ করতে।
  • সরকারীভাবে সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়ায় বড় পরিসরে পবিত্র খ্রিস্টযাগের ব্যবস্থা করা যায়নি। তাই স্বল্প পরিসরে নিয়মিতভাবেই গির্জায় খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করা হয়েছে। অনেকেই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে খ্রিস্টযাগে যোগদান করেছেন।
  • কার্ডিনাল মহোদয়ের নির্দেশনায় সাপ্তাহিক প্রতিবেশীর সহযোগিতায় অনলাইনে খ্রিস্টযাগের ব্যবস্থা করায় স্থানীয়ভাবে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তাই, সকলকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে যেন কক্ষ বন্ধ থাকলেও আমাদের হৃদয় যেন বন্ধ না থাকে। অর্থাৎ সকলে যে আধ্যাত্মিকভাবে পরিপুষ্ট লাভ করি।
  • করোনার মধ্যে যারা মারা গিয়েছে তাদের সমাধি দেওয়া হয়েছে। 
  • ভক্তজনদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা অব্যাহত ছিল এবং পারিবারিক প্রার্থনা, রোজারিমালা প্রার্থনা ও বাইবেল পাঠে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। 
  • স্থানীয় যুবকদের বিনোদন ও সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ধর্মপল্লীর জিম ও খেলার সামগ্রী উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, যেন তারা এই দুর্যোগে হতাশাগ্রস্ত হয়ে না পড়ে বা বিপথে না যায়। 
  • সাম্প্রতিকালে ভক্তজনদের আধ্যাত্মিক পরিপুষ্টতার কথা ভেবে নয়দিন নভেনার পর কার্ডিনালের পৌরহিত্যে ধর্মপল্লীর পর্ব পালন করা হয়, যেখানে প্রায় ৪৫০জন খ্রিস্টভক্ত উপস্থিত ছিলেন।

খ্রিস্টভক্তদের সাড়া :

  • আধ্যাত্মিকভাবে খ্রিস্টভক্তদের সাড়াদান যথেষ্ট ইতিবাচক ছিল। তারা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেছে, বাসায় প্রার্থনা করা, অনলাইন এ খ্রিস্টযাগে যোগদান করেছে।   
  • ইতোমধ্যে,  দরিদ্রদের সাহায্যার্থে অনেকেই আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে।
  • খ্রিস্টভক্তগণ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে একে-অপরের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে যা এ সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মহামারীকালীন ধর্মপল্লীতে অবস্থানরত কর্মীদের সেবাদানের ক্ষেত্রে কিরূপ ভূমিকা পালন করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন-

👉 পবিত্র ত্রুুশ ধর্মপল্লীতে কেউ কর্মী নয়, সবাই পরিবারের সদস্য হিসেবে ধর্মপল্লীতে থাকে। সবাই মিলে মোট ১১জন। কর্মীদের পাশাপাশি তাদের পরিবারগুলোকেও সাহায্য করা হয়েছে। সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আলাদা-আলাদা রুমের ব্যবস্থা ও সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। কেউ আক্রান্ত না হওয়ায় চিকিৎসার প্রয়োজন হয়নি কিন্তু উপলক্ষণের মত কিছু দেখা দিলে প্রয়োজনীয় ঔষধ দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে।

সমাজের বিত্তশালীদের উদ্দেশে আপনার মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরুন। কিভাবে মূলত তারা আপনাদের মতো অন্যদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সহভাগিতার জীবন গড়ে তুলতে পারবে?

👉আমরা কেউ এত গরীব নই যে দিতে পারি না এবং কেউ এত ধনীও নই যে নিতে পারি না। দরকার শুধু একটা উদার মন। মৃত্যু দুয়ারে এলে মনে হয় জীবনটা কত মূল্যবান। এই মূল্যবান জীবনটাকে আমরা আরও মূল্যবান করে গড়ে তুলতে পারি দানের মধ্যদিয়ে। কোভিড-১৯ আমাদের খাঁটি মানুষ চিনতে সহায়তা করেছে। এমনকি তা পরিবারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা অনেকে এই দুসময়ে দূরে সরে গেছি, যখন আমাদের কাছে থাকার কথা ছিল। কে মহৎ, পরোপকারী, মানবিক, উদার তা আমরা চিনতে শিখেছি। তাই আমরা মনে করি, এখনও সময় আছে খ্রিস্টান হিসেবে তাঁর উদারতার শিক্ষার অংশীদার হিসেবে আমরা যেন প্রান্তিক মানুষদের পাশে দাঁড়াই এবং তাদের উঠে দাঁড়ানোর শক্তি হই। কোভিড-১৯ এ আমরা অনেকেই স্থবির ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। জীবনের ছন্দপতন ঘটেছে। দয়া, সহভাগিতা ও সামাজিক মিলন-ভ্রাতৃত্ব কমে গেছে। সচেষ্টায় ও স্ব-উদ্যোগে এগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। জীবনটাকে আবার নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে। সকলকে নিয়ে বিশ্বাসের যাত্রায় বেড়ে উঠতে হবে। কোভিড-১৯ এ আমরা অনেকে নেতৃস্থানীয় লোকদের হারিয়েছি যা কখনো পূরণ হবার নয়। তাই আমাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে যেন বাংলাদেশের এই ক্ষুদ্র মণ্ডলী বিলীন হয়ে না যায়। সুতরাং, সকলের প্রতি অনুরোধ, করোনা সঙ্কটকালীন আমরা যেন নিজেদের খ্রিস্টীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে চর্চা করতে পারি এবং ভালবাসা ও সহভাগিতার মধ্যদিয়ে নিজেদের খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দিতে পারি।

পরিশেষে বলা যায়, ভালবাসা সহভাগিতা ও সহযোগিতার মধ্যদিয়ে নিজেদের খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দিতে পারি যেন জীবনের শেষে আমরা প্রভুর কাছ থেকে এই আশ্বাস বাণী শুনতে পাই, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, আমার এই তুচ্ছতম ভাই-বোনদের একজনেরই জন্যে তোমরা যা-কিছু করেছ, তা আমারই জন্যে করেছ।” (মথি: ২৫:৪০)

rozariohbadhon@gmail.com


[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]  


 

Post a Comment

Previous Post Next Post