স্বতন্ত্র মূল্যবোধে গড়ে উঠুক ছাত্ররাজনীতি

জাসিন্তা আরেং : শিক্ষা, দেশ ও আদর্শ নেতৃত্বের নামই হলো ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররাজনীতির শিকড় প্রোথিত রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনের সোনালী অতীতে। তাই কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতিকে উৎসাহিত করে আসছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি বিবিধ কারণে অমানিশার বলয়ে আবর্তিত হচ্ছে। বিচ্যুত হয়ে পড়েছে ছাত্ররাজনীতির দর্শন ও মূল্যবোধ থেকে। ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল অতীতে এখন ভাটা পড়ে যাচ্ছে। কেননা বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতির নামে নিজের স্বার্থরক্ষার কাজ চলে। যে ছাত্ররাজনীতি এক সময় ভাবী নেতৃত্বকে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো, সেই ছাত্ররাজনীতি এখন নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত। বর্তমানে বাইরের রাজনৈতিক অঙ্গ-সংগঠনসমূহ ছাত্ররাজনীতি এবং এর সাথে জড়িত ছাত্রদেরকে জিম্মি করে রেখেছে। পরিস্থিতির শিকার হয়ে ছাত্ররাও বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছে যা তাদের ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে ধাবিত করছে। বাইরের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর পাল্লায় পড়ে ছাত্ররা বিভিন্ন সময় নিজেদের প্রতিষ্ঠানে সমস্যার সৃষ্টি করছে। যা রীতিমত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ কলুষিত করছে। ছাত্রদের উত্তম রাজনীতি চর্চায় বাধার সৃষ্টি করছে। আগামীর আদর্শ নেতা-নেত্রী তৈরির পরিবর্তে তৈরি করছে শোষকশ্রেণি। তাই দেশ ও দশের কথা বিবেচনা করে ছাত্ররাজনীতিতে স্বতন্ত্রতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সুষ্ঠু ও অর্থবহ ছাত্ররাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করাও অত্যন্ত আবশ্যক। নতুবা উদীয়মান তরুণ নেতা-নেত্রীরা দেশ ও জাতির মঙ্গল কিছুর প্রত্যাশা কতখানি যৌক্তিক  তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

স্বতন্ত্র মূল্যবোধে গড়ে উঠুক ছাত্ররাজনীতি


বর্তমানে অসুস্থ ও শৃঙ্খলবিহীন রাজনীতির শিকার হচ্ছে অনেকেই। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও এমন ঘটনার নজির মিলেছে। যা অনেকাংশেই দেশের মানুষের বিশ্বাসের ভিতকে নড়বড়ে করে তুলেছে। সম্প্রতি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ এমনি এক অসুস্থ রাজনীতির শিকার। এমন হাজারো দৃষ্টান্ত মিলবে যারা সুনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির ফলে অকালেই প্রাণ হারিয়েছে এবং সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এমনকি সহপাঠিদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন ও অত্যাচারের যন্ত্রণায় আপন বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে দেশান্তর হয়েছে অনেকেই। নিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সহপাঠিদের নির্যাতনের ফলে আবরারের মৃত্যু ছাত্ররাজনীতির সুষ্ঠুতা, শৃঙ্খলা এবং বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। কেননা ছাত্ররাজনীতি এখন ক্ষমতাশীল দল-গোষ্ঠীর কাছে মুষ্টিমেয় হয়ে আছে যার প্রতিফলনই এই হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডেরে ছাত্রদের সংশ্লিষ্টতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দেশের মানুষকে মর্মাহত করেছে। ছাত্ররাজনীতি যেন নামমাত্র রাজনীতি না হয় বরং তা যেন দেশ ও জাতির কল্যাণ বয়ে আনে। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নির্দিষ্ট কোন মূল্যবোধ এবং দর্শন হারাতে বসেছে। যার ফলে ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের লোকেরা ছাত্রদেরকে নিজ স্বার্থের জন্য কাজে লাগাচ্ছে। কাজেই, ছাত্ররাজনীতির নির্দিষ্ট মূল্যবোধ ও দর্শনের আলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও বৃহত্তর স্বার্থে নেতৃত্ব গড়ে তোলা অতীব প্রয়োজন। তাছাড়া ছাত্ররাজনীতিতে স্বতন্ত্রতা বজায় রাখাও সকলের দায়িত্ব। রাজনীতিতে জড়িত ও আগ্রহী ছাত্রদের নিজেদের স্বতন্ত্রতা ও নৈতিকতা সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যেন কোন বাইরের রাজনৈতিক দল দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে তাদের ব্যবহার করতে না পারে।

অসুস্থ ছাত্ররাজনীতি বর্জন এবং সুষ্ঠু ছাত্ররাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতাও কাম্য। কেননা বর্তমানে উদীয়মান এবং সক্রিয় ছাত্রনেতা-নেতৃদের আদর্শ গঠন দান এবং বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পৃক্ততা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সঠিক তদারকি প্রয়োজন। এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সক্রিয় ছাত্ররাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ম মাফিক এবং নির্ধারিত দর্শন ও মূল্যবোধ অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিতে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করতে তার আশু সমাধানে আসতে হবে। ইতোমধ্যেই অনেকেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবী জানিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের মত দেশে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা ছাত্ররাজনীতি দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও জাতীয় সঙ্কটে সর্বদা অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছে এবং দেশের মানুষ তার সুফলও ভোগ করেছে। কিন্তু বর্তমানে বাইরের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সাথে ছাত্ররাজনীতির অবাধ সংশ্লিষ্টতার ফলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের সৃষ্টি হচ্ছে। যদি ছাত্ররাজনীতি ও বাইরের রাজনীতির মাঝে স্বতন্ত্রতা বলবৎ করা যায় তবেই এর সুফল ভোগ করা সম্ভব হবে। বাইরের রাজনৈতিক অপশক্তির শৃঙ্খল থেকে ছাত্ররাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থ পরিত্যাগ করে জাতির ও ছাত্রদের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করতে হবে যেন আগামীতে আদর্শ নেতা-নেতৃর বলিষ্ঠ নেত্বত্ব দ্বারা দেশ ও জাতি এগিয়ে যেতে পারে।

ছাত্ররাজনীতিকে স্বতন্ত্র পথে ফিরিয়ে আনতে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের সহায়তারও প্রয়োজন আছে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপ থেকে ছাত্রদের দূরে রাখার সিদ্ধান্ত যত শীঘ্রই নেয়া যায়, ততই মঙ্গল। যেন তারা কোন ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের লোভে পড়ে ছাত্ররাজনীতির মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে না পড়ে। সম্প্রতি মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে ছাত্ররাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে যা ছাত্রদের সহিংসতার পথে ও পরস্পর বিরোধী এবং অসাংগঠনিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে উৎসাহিত করছে। সহিংসতার ঘটনাগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতির ভাবমূর্তি নষ্ট এবং কলঙ্কিত করছে। তাই এ পরিস্থিতি থেকে অতিসত্ত¡র উত্তরণ প্রয়োজন। ছাত্ররাজনীতি যেন শুধু ক্যাম্পাসভিত্তিক থাকে সেটাও নিশ্চিত করা দরকার। অনেকাংশেই দেখা যায় যে, শিক্ষকরা ছাত্রদের বাইরের রাজনীতি ও অসাংগঠনিক কার্যকলাপে উৎসাহিত করেন, যেখানে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। তাই এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও কার্যকলাপও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

যুগ পরিবর্তনের ফলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছেই। তাই সেই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ছাত্ররাজনীতিকদের সাংগঠনিক মূল্যবোধ নিয়ে পথ চলতে হবে এবং অন্যকে পরিচালনা করতে হবে। বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের কারণে ছাত্রসমাজ আদর্শচ্যুত হয়ে পড়ছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ছাত্ররাজনীতির নিজস্ব স্বকীয়তা ও গৌরবময় সংস্কৃতি চলমান রাখতে ছাত্রসমাজকে সক্রিয় হতে হবে। ছাত্ররাজনীতিকে মূল্যবোধসম্পন্ন করতে বিজ্ঞজনদের মূল্যবান পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হবে। ছাত্ররাজনীতি যেন প্রতিষ্ঠানের অধ্যয়নরত ছাত্রদের জন্য ফলপ্রসু ও কল্যাণকর হয়, সেদিকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের খেয়াল রাখতে হবে। এ যুগের ছাত্ররাজনীতিতে আগামী দিনের জাতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফুটে উঠুক এটাই সকলের কাম্য। অমানিশার বলয়ে ঘূর্ণায়মান ছাত্ররাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে প্রতিষ্ঠান, দেশ ও জাতির সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা ক্রমশ কলুষিত ছাত্ররাজনীতির ফলে আগামীতে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

jacintarani03@outlook.com

Post a Comment

Previous Post Next Post