জ্যাষ্টিন গোমেজ : স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কিছু লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের যে প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছে, সেটি অকপটে স্বীকার না করলেই নয়। যেমন, আমাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ২০১৭ তে এসে ৭২ বছরে উন্নীত হয়েছে, যা ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৬৫.২ বছর। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৪ জনে দাঁড়ায়, যা ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৫০জন। পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ছিল প্রতি হাজারে ৬৮ জন, যেটি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে কমে দাঁড়ায় ৩১ জনে। আর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ১৭২জনে, যা ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৩৪৮ জন। টিকাদানের পরিধি এবং গর্ভনিরোধক সামগ্রী ব্যবহারের হার বাড়ানো, ডায়রিয়া ও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে প্রশংসনীয়। করোনাকালীন ডাক্তারদের সাহসী ভূমিকাকে বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু একজন ভালো ডাক্তার দিয়ে তো পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যাবে না। এর জন্য চাই একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রতিজ্ঞা, যার দায় সরকারের ওপর বর্তায়। নির্ভর করে সাধারণ নাগরিকদের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি কি এবং জনগণকে তারা কোন অবস্থার মধ্যে রাখতে চান তার ওপর।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা ও উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক আছে। আর সেটা বিবেচনা করেই বাংলাদেশের সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১৫)। কিন্তু বাস্তবতা সংবিধানের এই অঙ্গীকার থেকে অনেক দূরে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্দশার চিত্র বর্তমানে প্রকট হয়ে ওঠেছে। সারা দেশে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। প্রতিদিন হাজারো মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আর মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। দেশের মানুষ এখন ভয় ও আতঙ্কে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। কেউ বলতে পারছে না যে এই মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়। এই সঙ্কট মুহূর্তে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকিৎসাসেবা। মানুষ এখন কোনো হাসপাতালে গিয়েই চিকিৎসা পাচ্ছে না। করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন যত মানুষ মারা যাচ্ছে, করোনার উপসর্গ নিয়ে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে বিনা চিকিৎসায়। মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাবে দেশে বহু করোনা আক্রান্ত মানুষের নমুনা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। আবার জনবলের অভাবে নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষাও করা যাচ্ছে না। করোনা আক্রান্তদের সেবা দিতে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স। করোনা পরীক্ষার জন্য মিলছে না পর্যাপ্ত কিট। সম্প্রতি দেশে করোনা সংক্রমণের পর সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সক্ষমতার ঘাটতিও সবার নজরে এসেছে।
আজ সমাজের সর্বস্তরে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাতকে নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আর করাটাই তো স্বাভাবিক। কেননা স্বাস্থ্যখাতে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই; আর যেখানে অবকাঠামো আছে সেখানে ডাক্তার নেই। যেখানে ডাক্তার আছে সেখানে নার্স নেই। যেখানে নার্স আছে সেখানে চিকিৎসা-সরঞ্জাম নেই; যেখানে সরঞ্জাম আছে সেখানে টেকনিশিয়ান নেই; করোনার সময়ে ভেন্টিলেটর নেই, আইসিউ নেই, ২৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মীর পিপিই নেই, পর্যাপ্ত টেস্টিং কিট নেই। খালি নেই আর নেই। তবে যা আছে তা হচ্ছে, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা আর পরিকল্পনার অভাব। যা নেই তো নেই আর যা আছে তা-ও নেতিবাচক। মূলকথা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্গতি নিয়ে আজ পুরো দেশবাসী অতিষ্ঠ।
বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ফলাফলগুলো থেকে বোঝা যায় যে বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে প্রত্যেকে সমানভাবে উপকৃত হচ্ছে না। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন মানের ধরন, নিরাপদ ও স্বচ্ছ পরিবেশের অভাব এবং নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবার কারণে আরও বেশি অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমরা যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে চাই, তবে অবশ্যই প্রত্যেকের জন্য সর্বজনীন এবং ভালো মানের স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু কোভিড-১৯ সংকট স্বাস্থ্যখাতে আমাদের যে অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতা রয়েছে, তা আবারও স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। তাই স্বাস্থ্যখাতের উন্নতির বিষয়টি সামগ্রিকভাবে দেখা উচিত। আর সেখানে পৌঁছানোর জন্য আমাদের দীর্ঘ এবং কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে ।
আমাদের স্বাস্থ্যখাতে এখনো প্রধান আগ্রহ ভৌত কাঠামো নির্মাণের দিকে। সামাজিক খাতের চেয়ে ভৌত অবকাঠামোকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তুলনামূলকভাবে বেশি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ভৌত অবকাঠামো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু জনসাধারণের স্বাস্থ্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জাতির স্বাস্থ্য ভঙ্গুর হলে অগ্রগতি ব্যহত হবে। জাতীয় নীতিতে এবং অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার প্রতি গুরুত্ব কম দিলে তার নেতিবাচক ফল এড়ানো যাবে না। কথায় বলে, যেমন কর্ম, তেমন ফল। স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান অবস্থা দেখলে সে কথার তাৎপর্য বোঝা যায়। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ এবং উদ্যোগ তাই মহামারীকালের প্রধান দাবি। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন এগিয়ে চলছে, স্বাস্থ্যসেবার পরিষেবাগুলোও বেসরকারি খাতের মাধ্যমে প্রসারণ ঘটছে। আর এর গুণমান নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত কার্যকরভাবে এই খাতের নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা। কারণ স্বাস্থ্যসেবার গুণমান এবং ব্যয় অনেকটাই পরিবর্তিত হয় এসব নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারীদের মাধ্যমে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে সামগ্রিক জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় দ্বারা শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ঔষধজাত পণ্যের গুণগত মানও পর্যবেক্ষণ করা দরকার। আর সেই সাথে সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা নিশ্চিত করতে সম্পদের অপচয় হ্রাস করতে হবে এবং বাজেট পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করতে হবে। গত পাঁচ বছরের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সব সংগ্রহ পদ্ধতির ওপর একটি নিরীক্ষা করলে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সরকারি সম্পদের জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য এই মহৎ প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পারে। দুর্নীতির এই দুষ্ট চক্রটি ধ্বংস না করা গেলে এবং স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা না গেলে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি তেমনটা আশা করা যায় না। জনস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে এ খাতে অবকাঠামো শক্তিশালী ও মানবসম্পদের ঘাটতি পূরণ করতেই হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আমূল সংস্কার করতে হবে। তিনটি স্তরে স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রাথমিক স্তর তথা উপজেলা ও ইউনিয়ন হবে মূল লক্ষ্য। এখানে সরকারি ব্যয় আরও বাড়াতে হবে। জেলা পর্যায়ে ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আর কেন্দ্রীয়ভাবে যেসব হাসপাতাল ও কলেজ রয়েছে, সেগুলোকে ভিন্ন আঙ্গিকে সংস্কার করতে হবে। এসব হাসপাতাল পরিচালনার জন্য স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা খুবই দুর্বল। এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ঔষধের দাম নির্ধারণে সরকারের জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার। পুরনো কাঠামো ভেঙে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করতে হবে।
[ জীবন ও সমাজে পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]