বরিশাল ক্যাথলিক ডাইওসিসের পালকীয় সম্মেলনের প্রতিবেদন

সেবাস্টিনা শাওলী বাড়ৈ : প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও বরিশাল ক্যাথলিক ডাইওসিস খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস-এর চিন্তাধারা ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গত ১১-১২ ডিসেম্বর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দে পালকীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও, এবছর ছিল বরিশাল ক্যাথলিক ডাইওসিসের পঞ্চবার্ষিকী পালকীয় সম্মেলনী যা এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা। সৃষ্টি ও প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে সকল ধর্মের এবং সকল খ্রিস্টমণ্ডলীর নেতৃবৃন্দকে একসাথে নিয়ে ধরিত্রীর অভিন্ন বসতবাটীকে সুরক্ষা ও যত্নের নিমিত্তে এবং ভাই-বোন সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে পোপ মহোদয়ের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এবারের পালকীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পোপের তিনটি সর্বজনীন পত্র ২৪শে মে ২০১৫ খ্রিস্টবর্ষে ‘তোমার প্রশংসা হোক প্রভু’ এবং ৩রা অক্টোবর ২০২০ খ্রিস্টবর্ষে ‘ভাই-বোন সকলে’) “লাউদাতো সি নামক সর্বজনীন পত্রের মাধ্যমে তিনি বলেছেন, ধরিত্রী আমাদের সবার বসতবাটী। তাই সকলকেই দায়িত্ব নিয়ে এর যত্ন ও সুরক্ষা দিতে হবে। চতুর্থ পালকীয় পত্রটিতে তিনি সৃষ্টি ও প্রকৃতির যত্নে, বিশেষভাবে সৃষ্টির সেরা জীব মানব জাতিকে রক্ষা ও যত্ন করতে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে ২৫ মার্চ, ২০১৯ খ্রিস্টবর্ষে রচনা করেন “ক্রিস্তুস ভিভিত যার অর্থ হলো “খ্রিস্ট জীবন্ত। পোপ মহোদয় তাঁর তৃতীয় সর্বজনীন পত্রে বলেছেন, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় বিশ্বের সকলে মিলে একটি পরিবারের ভাই-বোন হিসাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিহার করে পরস্পরের সঙ্গে মানবীয় সম্পর্ক ও সংহতি জোরদার করতে এবং বিশ্ব জগতের সুরক্ষা ও যত্ন নিতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। পোপ ফ্রান্সিস গত ৪ঠা অক্টোবর ‘ফ্রাতেল্লী তুত্তি’ নামক তৃতীয় সর্বজনীন পত্রের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুঃখ-কষ্টের কারণ, তাদের প্রতি বর্তমান জগতের দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব, নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা এবং তাদের প্রতি মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উপায় নিয়ে আলোচনা ও প্রস্তাবনা প্রদান করেন। পোপ মহোদয়ের সর্বজনীন ও পালকীয় পত্রগুলোর আলোকে বরিশাল কাথলিক ডাইওসিসের ২০২১ খ্রিস্টবর্ষের পালকীয় মূলভাব নেওয়া হয় “সৃষ্টি ও প্রকৃতির যত্নে ভাই-বোন সকলের অংশগ্রহণ।”

ফাদার লেকাভালী’র সাথে সাক্ষাৎকারে উঠে প্রতিবেদন বিস্তরিত :

২০২০ খ্রিস্টবর্ষের শুরুতে কোভিড-১৯ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে এর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অনেক খ্রিস্টভক্ত প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। যারা জটিল রোগে আক্রান্ত, তারাও অনেকে সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। পরিবারের মধ্যে কেউ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে তাদের জীবন। সমাজ যেভাবে আক্রান্ত পরিবারগুলোকে গৃহবন্দী করেছে, তেমনি নিকটতম পরিবার-পরিজনও আত্মরক্ষার্থে দূরত্ব নিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এক বছর ধরে পড়াশুনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরিবারের আয়-উপার্জন বন্ধ থাকায় অনেকে খাদ্য সঙ্কটে পড়ে কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করেছে। রাষ্ট্রপ্রধানদের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রা ও কাজ-কর্মকে নতুন ধারায় আনতে নিশ্চিত করছেন। এসময়ে পালকীয় সম্মেলন আয়োজন করাও চিন্তার বিষয় ছিল। মহামারির কারণে এবারের অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাও কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ততটা ব্যাপকতা ছিল না প্রতি বছরের ন্যায়। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী ম্যাস্ক ব্যবহার করে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করে ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে প্রোগ্রাম করা হয়েছে।

দুই দিনব্যাপি সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমদিনে উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান, পরিচয় পর্ব, এবং বিগত বছরের পালকীয় মূলসুরের ওপরের এক বছরের পালকীয় কার্যক্রমের প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। দ্বিতীয় দিনে পালকীয় মূলসুর “সৃষ্টি ও প্রকৃতির যত্নে ভাই-বোন সকলের অংশগ্রহণ”-এর আলোকে বরিশাল ডাইওসিসের বিশপ সহভাগিতা রাখেন। এরপর ২০২১ খ্রিস্টবর্ষে নতুন পালকীয় মুলসুরকে কেন্দ্র করে প্রতিটি ধর্মপল্লী এক বছরের পালকীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ও উপস্থাপন করেন।



পালকীয় সম্মেলনীতে সকল পাল-পুরোহিত ও সহকারী পাল-পুরোহিতগণ, প্রতিটি ধর্মপল্লীর পালকীয় পরিষদ থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকগণ, ব্রাদারগণ, সিস্টরগণ, কাটেখিস্ট, প্রার্থনা পরিচালক, প্রতিটি ধর্মপল্লী থেকে দুইজন করে বিসিএসএম ও যুব প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। মারীয়া সংঘ থেকে, অন্যান্য সংগঠন থেকে প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।

ঘ)  উক্ত পালকীয় সম্মেলনী উল্ল্যেখযোগ্য বিষয় ছিল, ধরিত্রীকে রক্ষা ও যত্ন একসাথে মিলে এই ধরিত্রীকে নিরাপদ করে তুলি। ধরিত্রী যে নবরূপ ধারণ করেছে তা দূষণমুক্ত রাখতে পরস্পরকে সচেতন করতে পারি। ধরিত্রীর যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বশীলতাঃ পরিবেশ সংরক্ষণ এবং ধরিত্রীর অস্তিত্ব নিশ্চিতকরণঃ পরস্পরের সাথে সুসম্পর্ক, আন্তরিকতা এবং একাত্মতা থাকলে মিলন-সমাজ গড়ে ওঠে এবং স্বর্গীয় শান্তি ও আনন্দ নেমে আসে। পরস্পরের মঙ্গল নিশ্চিত হলে মানবীয় মর্যাদা, শ্রদ্ধাবোধ, সুষম বণ্টন, নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ হয় সুনিশ্চিত। কিছুদিন পূর্বে বরিশাল ক্যাথলিক ডাইওসিসের আওতাধীন ‘ট্রান্সজেন্ডারদের’ (হিজড়াদের) সাথে সংলাপ হয়েছে। দেখা গেছে, তারা মানবীয় মার্যাদা থেকে বঞ্চিত। তাদের সাথে শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে কথা বলা হয় না। সম্পদের সুষম বণ্টন, নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণভাবে কাজ-কর্ম করার নিশ্চয়তা তাদের জন্য নেই। তাই তারা বেঁচে থাকার তাগিদে এবং আত্মরক্ষার্থে নিশ্চিতকরণ। তাদের বক্তব্যে সুস্পষ্ট- পরিপূর্ণ মানবীয় মর্যাদায় জীবন-যাপন করতে তাদের মনের গভীরে বাসনা রয়েছে। একইভাবে অসুস্থ, বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী, মানসিক রোগীদেরকে পরিপূর্ণ মানবীয় মর্যাদায় বেঁচে থাকার অধিকার আমাদেরকে সুনিশ্চিত করতে হবে। সহজ-সরল ও সংযমী জীবন যাপনের গঠনদানঃ ধরিত্রীর কান্না আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে-সাথে মনোভাবের গঠনঃ ভূমিহীনদের প্রতি যত্নশীলতা অভিবাসীদের যত্ন: মানবীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভাই-বোন সকলেঃ যারা অভিবাসী হয়ে আমাদের ডাইওসিসেই শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদের যত্ন নিতে ধর্মপল্লীর যুব আন্দোলন এবং ধর্মপল্লী থেকে যেসকল প্রতিনিধি ডাইওসিসের যোগাযোগ কমিশন, যুব কমিশন, পালকীয় কমিশন এবং ন্যায় ও শান্তি কমিশনে রয়েছে তাদেরকে নিয়ে কার্যক্রম করা।

সম্মেলন অংশগ্রহণকারীদের অংশগ্রহণ সক্রিয় ও আন্তরিক। তাদের অংশগ্রহণ শতভাগ ছিল। বিশপের পালকীয় পত্রের সহভাগিতার ওপর মুক্ত আলোচনায় তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আসন্ন বড়দিনকে কেন্দ্র করে ধর্মপ্রদেশের প্রতিটি ধর্মপল্লীতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব মেনে এবং সামাজিক ও প্রশাসনিক বিধি মেনে বড়দিন উদযাপন করার আহ্বান করেন। আগমনকালীন প্রোগ্রাম পূণর্মিলন সংস্কারের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি নিয়ে আনন্দপূর্ণ ও তৃপ্তিপূর্ণভাবে উদযাপন করেছেন। এছাড়া আসন্ন বড়দিনকে কেন্দ্র করে প্রতিটি ধর্মপল্লীতে ধর্মপ্রদেশ থেকে ২০,০০০.০০ টাকা করে দরিদ্রদের ত্রাণ প্রদানের জন্য দিয়েছেন। যাতে সকলে আনন্দপূর্ণভাবে সকলের সাথে এই কোভিড-১৯ এর মাধ্যমে যেন আনন্দপূর্ণভাবে বড়দিন উদযাপন করতে পারে। এছাড়া ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লী থেকে ২৭০ জন শিশুদের মাঝে শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ করেন। ধর্মপ্রদেশের পক্ষ থেকে সকল প্রশাসনিক ব্যক্তিদের নিয়ে ২৫ ডিসেম্বর বিকালে বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠান হয়। সব কিছু মিলিয়ে এবারের বড়দিন অনুষ্ঠান সুন্দর, আনন্দপূর্ণ ও উৎসবমুখর ছিল।

Post a Comment

Previous Post Next Post