গণমাধ্যমই শক্তি, কিছু প্রস্তাব কিছু সহভাগিতা

গণমাধ্যমই শক্তি, কিছু প্রস্তাব কিছু সহভাগিতা

ফাদার কমল কোড়াইয়া


গণমাধ্যম আজ আমাদের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাই বা না চাই গণমাধ্যমের প্রভাবে আমরা প্রভাবিত। এমন কি আমরা কি খাব, কেমন করে খাবো, কতটুকু খাবো, কি পরবো, কখন পরবো, কেমন করে পরবো, সবকিছুই গণমাধ্যম আজ আমাদের নির্ধারণ করে দিচ্ছে। গণমাধ্যম বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, যোগাযোগ মাধ্যমের সমষ্টিকে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল, সিনেমা, ইত্যাদি সবই গণমাধ্যমের আওতাভুক্ত। এ গণমাধ্যমগুলো বর্তমানে এত সহজলভ্য যে অতি সহজে অল্প কিছু অর্থের বিনিময়েই আমরা তা পেতে পারি। ঘরে বসেই মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর অপর প্রান্তের খবরা-খবর আমরা পেতে পারি। খবর-তথ্য-তত্ত্বের এ সহজ প্রাপ্তি যেমন সুফল বয়ে আনছে তেমনই কু-ফলও কম নয়। আর এ কু-ফলের সহজ শিকার হচ্ছে শিশু, স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীরা তারা এমন কিছু করছে, বলছে, দেখছে যা তাদের সার্বিক গঠনে ক্ষতি করছে। এমনও দেখা যায়, আজ দুধের শিশু টেলিভিশন দেখতে-দেখতে মায়ের দুধ খাচ্ছে। মা টেলিভিশনের সামনে শিশু সন্তানকে বসিয়ে দিয়ে ঘরে কাজ করছে। সন্তান কাঁদছে মা টেলিভিশন দেখিয়ে কান্না থামাচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি ভালোই মনে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সন্তানটি টেলিভিশনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বয়স বাড়ার সাথে-সাথে সে টেলিভিশন নির্ভর হয়ে পড়ছে। সে টেলিভিশন কাছে পেলে যতো খুশী হয় কোন মানুষ কাছে পেলে সে ততো খুশী হয় না। টেলিভিশন দেখতে-দেখতে শিশুটির রুচিবোধ, মূল্যবোধ, আচার-আচারণ, খাদ্যাভ্যাস এক কথায় শিশুটি হয়ে পড়ছে টেলিভিশন সর্বস্ব যান্ত্রিক এক মানুষ। এটাতো শুধু একটা উদাহরণ। একই কথা খাটে  কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইলসহ অন্যান্য মাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রেও। তাই কিছু বিষয় নিয়ে সহভাগিকা করতে চাই:


গণমাধ্যমই শক্তি, কিছু প্রস্তাব কিছু সহভাগিতা


১। আদেশ নয় বুঝিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করা :


গণমাধ্যম আজ আমাদের হাতের নাগালেই। আমরা চাই বা না চাই এগুলো আমাদের দরজায় এসে আঘাত করছে। ঘরের সন্তানদের আদেশ দিয়ে, শাসন করে, টেলিভিশন বাক্স বন্দী করে আমরা আমাদের সন্তানদের গণমাধ্যম থেকে দূরে রাখতে পারবো না। বরং যা দেখতে বা করতে নিষেধ করা হয় তা দেখতে বা করতে সন্তানদের জেদ চাপে আরও বেশি। তাই সন্তানদের ভালো-মন্দ, নানাদিক নিয়ে গণমাধ্যমের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। তাদের এভাবে বুঝতে হবে যেন তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোন গণমাধ্যম তাদের ব্যবহার করা উচিত কোনটি নয়। 


২। অনুষ্ঠানমালা নির্ধারণ করা :


বর্তমানে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই কোন না কোন গণমাধ্যম খোলা থাকে। ব্যবহার করা যায় । তাই পরিবারের সকলে মিলে কোন কোন অনুষ্ঠান বা কোন-কোন গণমাধ্যম ব্যবহার করা হবে তা নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন পরিবারের সকলে মিলেই ঠিক করলো যে তারা একটা ধারাবাহিক নাটক দেখবে। মা-বাবা যদি মনে করেন ধারাবাহিক নাটকটি ভালো, তাহলে সকলে মিলেই তা দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আর যদি তা হয় সকলে মিলে দেখার অযোগ্য, তবে সকলে মিলেই আলোচনার মাধ্যমে তা বাদ দেয়া উচিত। 


৩। সময় নির্ধারণ করা :


গণমাধ্যম ব্যবহার করে যেমন শিক্ষালাভ করা যায় তেমনই বিনোদনও সম্ভব। বাংলাদেশে টেলিভিশনই বর্তমানে প্রধান বিনোদন মাধ্যম। তাই পরিবারের সকলে ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা, ঠাকুরদাদা-ঠাকুরমা অর্থাৎ সকলে মিলে উপভোগ করা যায় এমন একটি সময় ঠিক করা দরকার। এতে হালকা মেজাজে আনন্দ-ফুর্তির মধ্যদিয়ে বিনোদন করলে দেহ-মন-আত্মার যেমন কল্যাণ হয় তেমনই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও আদান-প্রদান বৃদ্ধি পায়। 


৪। ঘরে বসে শেখার ব্যবস্থা : 


গণমাধ্যমের মধ্যদিয়ে অনেক কিছু শেখা যায়। যারা ভালো ইংরেজী বা বাংলা উচ্চারণ শিখতে চায় তারা মনযোগ দিয়ে খবর শুনলে নিজের উচ্চারণগত ভুল সহজেই সংশোধন করতে পারে। আবার যারা নতুন-নতুন রান্না-বান্না শিখতে চায় তারা টেলিভিশনে দেখে বা রেডিও শুনে বা খবরের কাগজে পড়ে তা সহজেই করতে পারে। তবে এতে অবশ্যই জানতে হবে কখন, কোথায় আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয়টি নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। 


৫। পারস্পরিক আলোচনা-সহভাগিতা :


গণমাধ্যমে কোন অনুষ্ঠান উপভোগ করার পর তা নিয়ে আলোচনা-সহভাগিতা করলে আরও বেশি লাভবান হওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পরিবারের সকলে মিলে একটি সিনেমা বা নাটক দেখার পর আলোচনা করা যেতে পারে নাটকের মূল বিষয় কি ছিলো? মূলশিক্ষা কি? বাস্তবতার সাথে এ নাটকের মিল-অমিল কতোটুকু? অভিনয় কেমন ছিলো? আর কি করলে নাটকের চরিত্রগুলো আরও বেশি ফুটে উঠতো আমরা এ নাটক থেকে কি গ্রহণ করতে পারি ইত্যাদি। 


৬। পড়াশুনার সময় :

যত কাজেই আমরা ব্যস্ত থাকি না কেন আমাদের পড়াশুনার একটি নির্দিষ্ট সময় থাকা উচিত। মা-বাবা, ছেলেমেয়ে সকলেরই প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়াশুনা করা দরকার। এতে বর্তমান অবস্থায় নিত্য নতুন আবিষ্কার ও নিজেকে আপডেট রাখা যায় সম্ভব হলে পরিবারের সদস্যদের সাথে আলাপ করে সবার গ্রহণযোগ্য খবরের কাগজ, ভালো সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন রাখা যেতে পারে। এভাবে পারিবারিক লাইব্রেরি ধীরে-ধীরে গড়ে তোলা অতি সহজেই সম্ভব। 


৭। পিতা-মাতা অভিভাবকদের করণীয় :


পরিবারে সন্তানেরা যখন পড়াশুনা করে যেকোন বয়সের হতে পারে। তখন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অবশ্যই পড়াশুনার পরিবেশ রক্ষা করা খুবই জরুরি। কখনও-কখনও দেখা যায় মা-বাবা সন্তানদের বলছে তোমরা যাও পড়ো অথচ তারা পাশের ঘরে বসে টেলিভিশন বা ভিসিডি দেখছে, ক্যাসেটে গান শুনছে, গল্পগুজব করছে। এতে কিন্তু সন্তানদের পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটে। তাদের মনে খারাপ প্রতিক্রিয়া হয়। এমনও দেখা গেছে সন্তানেরা পড়ার টেবিলে বসে আছে কিন্তু পড়ছে না। তারা ভাবে মা-বাবা যদি টেলিভিশন দেখতে পারে আমরা পারব না কেন? অথবা আমরা বড় হয়ে নিই তখন আমরাও টেলিভিশন দেখবো। তখনতো আর মা-বাবা আমাদের কিছু বলতে পারবে না! বড় হলে তাই করে। মা-বাবার কথা শুনে সন্তানেরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পড়ে। পিতা-মাতার প্রতি সম্মান হারায়। 


৮। আধ্যাত্মিক অনুশীলন :


দেহ-মন-আত্মাসম্পন্ন মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন একটি বড় অংশ বিবেক গঠন, ঈশ্বরভীতি, দয়া মায়া, মানবকল্যাণ। সবই আধ্যাত্মিক জীবনের অংশ। তাই পিতা-মাতাদের অবশ্যই সন্তানদের নিয়ে আধ্যাত্মিক অনুশীলন করতে হবে। রবিবাসরীয় খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ, সম্ভব হলে দৈনিক খ্রিস্টযাগে সন্তানদের নিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ, সান্ধ্য মালা প্রার্থনা, নিয়মিত বাইবেল পাঠ, সন্তানদের দেহ-মন-আত্মার সার্বিক গঠনবৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। তারা সুন্দর পরিবেশে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে। ঈশ্বরের সাথে তাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। ফলে এপার্থিব যোগাযোগ তাদের আরও ভারসাম্যপূর্ণ হবে।

 

৯। বয়স-চাহিদা অনুসারে কিছু অনুষ্ঠান নির্ধারণ :


গণমাধ্যমে অনেক ধরনের অনুষ্ঠানমালা আছে যা সকলের জন্যে সব সময় উপযোগী নয়। যেমন ছোট ছেলে-মেয়েরা কার্টুন দেখতে পছন্দ করে। তাই পরিবারে সন্তানদের বয়স ও চাহিদা অনুসারে কিছু গণমাধ্যম অনুষ্ঠানমালা থাকতে পারে। তবে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে অতিরিক্ত যেন না হয়। একই সময় সপরিবারে মা-বাবা সন্তানেরা মিলে উপভোগ করা যায় এমন কিছু অনুষ্ঠানমালা, ম্যাগাজিন অবশ্যই পরিবারে থাকলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আদান-প্রদান ও ভাব বিনিময় বাড়াতে সাহায্য করবে। 


১০। প্রশিক্ষণ :


বর্তমান গণমাধ্যম সমন্ধে সকলেরই জানা প্রয়োজন। গণমাধ্যমের প্রভাবের ভাল-মন্দ দিক সবই একজন সচেতন শিক্ষিত ব্যক্তির জানা দরকার। তাই পিতা-মাতা সন্তানদের সকলেরই গণমাধ্যম বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা জরুরী। প্রায়ই এধরনের প্রশিক্ষণ-সেমিনার আয়োজন করা হয়। নিজে আগ্রহ নিয়ে পিতা-মাতা ও সন্তানদের মিডিয়া প্রশিক্ষণ-সেমিনার-কর্মশালায় অংশগ্রহণ করলে নিজেদেরই মঙ্গল হবে। আপনার ধর্মপল্লী, স্কুল-কলেজ-প্রতিষ্ঠানে যদি মিডিয়া সম্বন্ধে কোন সেমিনার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকে তবে আপনি এব্যাপারে প্রস্তাব দিন। আয়োজনে সাহায্য করুন। অন্যকে বুঝতে সাহায্য করুন বিষয়টি কতো গুরুত্বপূর্ণ। সর্বশেষ বলবো, বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যম সবচেয়ে শক্তিশালী অথচ সবচেয়ে সহজলভ্য। আপনি/আমি চাই বা না চাই গণমাধ্যম আমার/আপনার জীবন প্রভাবিত করছে, আমার/আপনার চিন্তা-চেতনা, রুচিবোধ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। আমি/আপনি ধীরে-ধীরে গণমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছি। তাই অবহেলা না করে গণমাধ্যম সম্বন্ধে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। এবিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করলে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে মরতে হবে। কথায় বলে, গণমাধ্যমই শক্তি। যার যতো বেশি গণমাধ্যম সম্বন্ধে জ্ঞান থাকে সে ততো বেশি শক্তিশালী ॥


[জীবন ও সমাজে- পাঠাতে পারেন আপনারও বস্তুনিষ্ঠ লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ] 

Post a Comment

Previous Post Next Post