লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইয়া : ঘণ্টাখানেক আগে বৃষ্টি থেমেছে। এখন আকাশ অসম্ভব পরিস্কার দেখাচ্ছে। বৃষ্টির পর এমন আকাশ সাধারণত খুব কমই দেখা যায়। সন্ধ্যা রাতের আকাশ জুড়ে ফুটে উঠেছে ছোট-বড় উজ্জ্বল তারকারাজি। এক এক করে জ্বলে উঠেছে রাস্তার সব ল্যাম্পপোস্টগুলোও। সব মিলিয়ে সে এক অপরূপ সৌন্দর্য যেন ঝরে পড়ছে প্রকৃতি জুড়ে!
প্রকৃতির এমন মন ভোলানো রূপ অত্যন্ত প্রিয় মৌমির কাছে। গরম কফির মগটা নিয়ে ছাদে চলে এল। বাহ! ছাদ থেকে পুরো ঢাকা শহরই যেন দেখা যায়! নয় তলার উপর থেকে চিরচেনা রাতের ঢাকা শহর কেমন যেন অচেনা মনে হয়! এমন এক তারাভরা সন্ধ্যায় মনের অগোচরে কে একজন তার অনুপস্থিতি জানান দিয়ে গেল। কিছুটা অপ্রাপ্তি! কেমন একটা ভালো লাগায় মন উড়ু উড়ু করতে লাগল তা বেশ বুঝতে পারল মৌমি।
তারাভরা এক সন্ধ্যারাতে |
এমন সন্ধ্যা নিয়ে কোনো গান কি লেখা হয়নি? মনে মনে ভাবল মৌমি। মনে পড়েছে, সে যে কেনো এলো না, কিছু ভালো লাগে না... এবার আসুক তারে আমি... এই গানটা? না-না, গানটা নয়। একটু স্মার্ট গান- তারাভরা রাতে তোমার কথা যে মনে পড়ে বেদনায়- গো মনে পড়ে বেদনায়... এই গানটাও ঠিক যায় না, দূর গানটান বাদ।ছাদের রেলিং-এর উপর রাখা কফির মগটা তুলে নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়াতেই পিছন থেকে বাতাস এসে ঘাড়ের কাছে যেন সুড়সুড়ি দিয়ে গেল। পিঠের উপর মেলে দেওয়া চুলগুলো সামান্য নড়ে উঠল। ঘাড়ের কাছে উষ্ণতা অনুভব হতেই চমকে উঠে ঝট করে ঘাড় ঘুরাল মৌমি। মৌমি অবাক!
রিফাত তুমি?
হা-হা-হা শব্দে হেসে উঠল রিফাত। হুম আমি! বিশ্বাস না হয় তো চিমটি দিয়েই দেখ না। দুই হাত মৌমির সামনে বাড়িয়ে দিল রিফাত।
এবার সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াল মৌমি। সে কি! কেন চিমটি দিব?
ইচ্ছে হলে দিতে পারো। এখানে দেখার মত কেউ নেই। আবার হাসল রিফাত।
যাও, কি যে বল না!
মৌমি, শুনলাম তোমার নাকি বিয়ের কথা চলছে?
অনেকটা সেই রকমই!
মানে কি?
মানে কথাটা সত্যি।
তুমি কি বিয়েতে রাজি?
রাজি। কিন্তু তুমি শুনলে কিভাবে?
এই মাত্রই শুনলাম। আন্টি বলল।
ও আচ্ছা! কফি খাবে?
খাব।
দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি।
যেতে হবে না। আন্টি পাঠিয়ে দিবে বলেছে।
মা তোমাকে একটু বেশি খাতির যত্ন করে, আমি বেশ বুঝতে পারি। কিন্তু কেন করে,বলতো?
কি জানি,ছেলে ভালো। মেয়ের সাথে মানাবে ভালো, তাই হয়ত- হা-হা-হা...
কিন্তু মেয়ের যে বিয়ের কথা চলছে, সে তো সত্য!
হোক সত্য, তাতে কি?
এরপর যদি আর খাতির যত্ন না করে?
তাতে কি? না হয়, নাই বা আসব!
তাহলে এখন কেন আসো?
সে কথা না হয়, না ই বা জানলে! তোমার কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বলল রিফাত।
জানলে বরং ভালো হত! কফিতে চুমুক দিয়ে বলল মৌমি।
কেমন ভালো?
বাবার পছন্দকে না বলার একটা কারণ তো পেতাম।
তাই বুঝি? তলে তলে এতদূর? বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না- আহা রে বাঙালি রমণী! তো তোমার বাবার পছন্দের ছেলেটা কে? তা তো বললে না?
আবীর হাসান রিফাত, বাবার পছন্দের ছেলে। খুশি হলে তো শুনে?
হা-হা-হা শব্দে হেসে উঠল রিফাত। যা হোক, আমার নামের সাথে তবুও একটা মিল তো আছে। আর তোমার পছন্দ?
রিফাত! শুধু রিফাত....
আর আবীর হাসান?
সে তো বাবার ...
বাব্বা, তাহলে ম্যাডামের মুখ ফুটেছে দেখছি বাম হাতের তর্জনী দিয়ে মৌমির চিবুক স্পর্শ করে বলল রিফাত।
ভাইয়া, আপনার কফি! পিছন থেকে মিলার ডাক শুনে সরে দাঁড়াল রিফাত।
আপু, তোমার জন্যও এনেছি কফি।
মিলা দুই মগ কফি ছাদের রেলিং-এর উপর রেখে ছাদের গেটের কাছে চলে গেল। পিছন ফিরে বলল, ভাইয়া, রাতে আমাদের সাথে ডিনার করে যাবেন। এটা মায়ের আদেশ।
মাতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য। মাথাটা কিঞ্চিৎ নোয়ালো রিফাত।
মিলা চলে যেতেই মৌমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল- কি বুঝলে?
রিফাতের অনেকটা কাছে চলে এল মৌমি। হুম, জামাই জি, শাশুড়ি মায়ের বড্ড পছন্দের! দুই হাত দিয়ে রিফাতের গাল টেনে ধরল মৌমি। চাঁদের আলোতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে মৌমিকে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে রিফাত তাকিয়ে রইল মৌমির মুখের দিকে।
মৌমি রিফাতকে খেয়াল করতেই গাল ছেড়ে দিয়ে অচমকা রিফাতের বুকে মাথা গুঁজে আলতোভাবে রিফাতকে জড়িয়ে ধরল।
রিফাত মৌমিকে বাঁধা দিল না। এই প্রথম মৌমি রিফাতকে স্পর্শ করেছে। বুকের ভিতরের কম্পনটা বেশ বুঝতে পারছে রিফাত। নিজেকে সরিয়ে নিতে পারল না রিফাত। দুহাত দিয়ে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিল মৌমিকে।
বাতাসে হালকা নড়ছে মৌমির সিল্কি চুল। মৌমি যেন সদ্য মেঘমুক্ত আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটার মতই আলো ছড়াচ্ছে রিফাতের ভালোবাসার ঘরে! প্রেমের নিবিড় আলিঙ্গণে রিফাতের ঠোঁট জোড়া নড়ে উঠল-
একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনি-
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী
কিছু পলাশের নেশা কিছু বা চাঁপায় মেশা,
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি,
রচি মম ফাল্গুনী...
একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনি....
অনেক দিন পর রিফাত গুনগুনিয়ে উঠল! এমনই এক তারাভরা রাতে মিলার জন্মদিনের পার্টিতে রিফাতের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল মৌমি! সেই থেকে মনে মনে জাল বোনা রিফাতকে নিয়ে। প্রথমদিনের সেই মুগ্ধতা রিফাতকেও ছুঁয়ে ছিল মৌমির অগোচরে।
রিফাত অনুভব করল মৌমির হাত দু’টো যেন আরো শক্তভাবে তার পিঠে চেপে বসেছে। মায়াবী চাঁদ আর তারভর্তি আকাশকে সাক্ষী রেখে মর্ত্যপুরে দুজন মানব-মানবী সুরের মূর্ছনায় ভেসে যেতে লাগল।