বিজয়ের চেতনা থাকুক প্রজন্মের হৃদে

জ্যাষ্টিন গোমেজ : ১৯৭১ সালে আমাদের বিজয় অর্জন এমনি এমনি হয়নি। এই অর্জনের পেছনে যে অঙ্গীকার ও মনোভাব ছিলো তা হলো, ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।’ বাঙ্গালী হিসেবে নিজেদের অধিকার রক্ষায় ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল আমাদের বাংলার দামাল ছেলেরা। লক্ষ্য শুধু দেশকে স্বাধীন করবে। মা বোনের ইজ্জত রক্ষা করবে। তাই তো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুনের কেতন উড়িয়ে বাংলাদেশ নামে একটি ভূখ- জন্ম নেয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন। বিজয়ের রঙে রাঙানো এ দিনটিতে ইতিহাসের স্বর্ণালি পাতায় বীর-বাঙালি হিসেবে জায়গা করে নিই আমরা। আর আমাদের এই অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। আমাদের এ বিজয় অর্জনের পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। এ বিজয়ের জন্য ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস এক সাগর রক্ত আর ৩০ লাখ তাজা প্রাণ দিতে হয়েছিল, হারাতে হয়েছিল দেশ গড়ার কারিগর তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন সন্তান আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রম। তাই বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ডিসেম্বর মাসের বিজয় দিবসের এ দিনটিকে স্মরণ করে। স্মরণ করে জাতির অকুতোভয় বীর সন্তানদের।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা এবং যত দিন বাঙালি জাতি থাকবে, তত দিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায় হিসেবে, অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হিসেবে। কারণ বাঙালি জাতি জন্ম থেকেই কোনো না কোনো শাসক দ্বারা শোষিত হয়েছে, অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। কখনো মোগল-পাঠান, কখনো ব্রিটিশ, কখনো পাকিস্তানিদের দ্বারা। জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে। বাঙালির ইতিহাস মানেই শোষণ আর অধিকার থেকে বঞ্চনার ইতিহাস। বাঙালির ইতিহাস মানে না পাওয়া আর বেদনার ইতিহাস। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে পরিচয় লাভ করে বাংলাদেশ। আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। প্রতিবছর দিবসটি উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং পূর্ব পুরুষদের আত্মত্যাগের মহিমা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। তারা স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাঙালি জাতিসত্ত্বার ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা-সংস্কৃতি, প্রভৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করে। ফলশ্রুতিতে জাতিকে বৈশ্বিক আঙ্গিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়াস পায়।



আজকের তরুণ প্রজন্মের জানা দরকার বিজয়ের পেছনের রক্তক্ষরা দিনগুলোতে কী ঘটানো হয়েছিল সারা বাংলার বুকে। পাকিস্তানি সামরিক সরকার চেয়েছিল কতভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) শোষণ করা যায়, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায়, পূর্বের সম্পদ পশ্চিমে নিয়ে নেয়া যায়, সিভিল সার্ভিস থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী, বিভিন্ন সরকারি চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। এমনকি বাঙালিদের মুখের ভাষা, প্রিয় বাংলা ভাষাকে বিলীন করে দিয়ে তার স্থলে পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্তে মেতে ওঠে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সঠিক সময়ে হাল না ধরলে এবং দিকনির্দেশনা না দিলে এ দেশের রাজনীতি কোথায় যে হারিয়ে যেত তা ভাবতেও ভয় হয়। পাকিস্তানি শাসকরা চক্রান্ত করেই সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পাওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়নি। ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে তারা টালবাহানা করতে করতে শেষ পর্যন্ত বাঙালিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের রুখতে না পেরে শাসকরা হঠাৎ করেই একাত্তরের ২৫ মার্চের রাত ১২টার পর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে ঢাকাসহ সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে। প্রথম আক্রমণ চালায় বাঙালি পুলিশ অধ্যুষিত রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে; নির্মমভাবে হত্যা করে ঘুমন্ত পুলিশদের। একই সঙ্গে আক্রমণ চালায় জ্ঞানচর্চার রাজ্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কয়টা আবাসিক হলে। উপাসনালয়কেও বাদ দেয়নি। সারা ঢাকা শহরে যাকে সামনে পেয়েছে, যাকে পেয়েছে বাড়িতে-দোকানে কিংবা অফিস-আদালতে তাকেই পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে। তা-ব চালিয়েছে সারাদেশে। সে রাতে অপারেশনস সার্চলাইট নামক অভিযানে সমগ্র দেশে এক লাখেরও বেশি মানুষকে তারা হত্যা করে। পরবর্তী দিনগুলোতে জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতায় রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী আর আলশামস বাহিনী গঠন করে নারী নির্যাতন, নির্যাতন-পরবর্তী হত্যা, বাঙালিদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া, ফসলের মাঠে আগুন ধরিয়ে দেয়া, রেললাইন ধ্বংস করে দেয়া, রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে যাতায়াত কঠিন করে ফেলা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনাসহ সব বড় নদীতে টহল বোট দিয়ে নদীপথে যাতায়াতে বিঘœ সৃষ্টি, বাঙালিদের দোকানপাট-বাড়িঘর লুট, যুবকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলা, তরুণীদের হানাদারদের ক্যাম্পে নিয়ে সেনাদের হাতে তুলে দেয়াসহ অনেক অকথিত অত্যাচার চালিয়ে দেশটাকে আমাদের কাছে পরদেশি করে তোলা হয়। পুরো নয় মাস ধরে চালানো গণহত্যা বাংলাদেশে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি করে। দেশ স্বাধীন না করতে পারলে তাদের হাত থেকে মুক্তির কোনো উপায় থাকবে না এই অনুভূতি যখন সব বাঙালির হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে গেলো, তখন তরুণরা কেউ সশস্ত্র যুদ্ধে, কেউ কেউ গেরিলা যুদ্ধে আবার কেউ বা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকায় নেমে পড়লেন। শুরু হয়ে গেল আধুনিক সমরাস্ত্রসমৃদ্ধ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র বাঙালির অসম যুদ্ধ।

আমাদের তরুণ সমাজকে ভুলে গেলে চলবে না যে, তারুণ্য একটি প্রাণশক্তি, যা অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিল স্বপ্ন দ্বারা পরিপূর্ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন। তরুণদের ভাবনাগুলো হবে বাংলাদেশের ভাবনা, বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার ভাবনা, তরুণ সমাজের আপাদমস্তক চিন্তাভাবনা হবে বাংলাদেশকে নিয়ে। সব অস্তিত্বে থাকবে বাংলাদেশ। তরুণদের কাজগুলো হবে বাংলাদেশের কাজ। সব স্বপ্ন দেখতে হবে বাংলাদেশকে নিয়ে।

বিজয় দিবস বাঙালি জাতির চেতনায় রক্তে মেশানো উৎসব। বিজয়ের উৎসবে তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে। ভুলকে শুধরে শুদ্ধতার পথে চলার চেষ্টা করতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ-অহঙ্কার ছুড়ে ফেলে সবাই মিলে এক হয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে উজ্জীবিত হতে হবে। এ বিজয়ের জন্য ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস এক সাগর রক্ত আর ৩০ লাখ তাজা প্রাণ দিতে হয়েছিল, হারাতে হয়েছিল দেশ গড়ার কারিগর তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন সন্তান আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রম। তাই বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ডিসেম্বর মাসের বিজয় দিবসের এ দিনটিকে স্মরণ করে। স্মরণ করে জাতির অকুতোভয় বীর সন্তানদের। বাংলাদেশি হিসেবে প্রত্যেকেরই এই দিনটির প্রতি কিছু কর্তব্য রয়েছে। শুধু বিজয় দিবসের একটি দিনেই নয়, বরং বিজয়ের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রত্যেক মানুষের উচিত সারাবছরই দেশ-জাতি, স্বাধীনতা-সার্বোভৌমত্বের পক্ষে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কাজ করে যাওয়া। বিজয় দিবসের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ ও প্রচারে জাতীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয়ের ইতিহাস বিকৃত করে পরবর্তী প্রজন্মকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে সচেষ্ট তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে সে বিষয়টি নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনুধাবন করতে হবে। এখন সময় এসেছে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ চিহ্নিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত একটি তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। নতুন প্রজন্ম সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। এর মাধ্যমে একটি গতিশীল জাতি গঠিত হবে এবং এগিয়ে যাবে নতুন প্রত্যাশায়। নতুন প্রজন্ম হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি আধুনিক প্রজন্ম, যারা বাস্তবায়ন করবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।


লেখক, শিক্ষার্থী, এমএই (ইংরেজী সাহিত্য) 

নর্দান ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশ

justingomes80@gmail.com 



Post a Comment

Previous Post Next Post