সাধনা বুকে নিয়ে লেখা-লেখি করি- লেখক এ এম আন্তোনী চিরান

সাক্ষাৎকার: এ এম আন্তোনী চিরান ভালুকাপাড়া ধর্মপল্লীস্থ পূর্ব ভালুকাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আসলে, ভালুকাপাড়া ধর্মপল্লীটা ডোমপাড়া গ্রামে পড়েছে। ডোম বলতে যারা সাধারণত শুকর চড়ায়, তাদেরকে স্থানীয়ভাবে ডোম বলা হতো। সঙ্গতকারণেই, মিশন প্রতিষ্ঠার পর ডোমপাড়া মিশন না রেখে ভালুকাপাড়া মিশন রাখা হয়। জনশ্রুতি রয়েছে যে, গ্রামটি একসময় অভয়ারণ্য ছিলো। ফলে, সম্পূর্ণ গ্রামটি ভালুকের বিচরণ ক্ষেত্র ছিলো। এছাড়াও, ভালুকের পায়ের ছাঁপ যেখানে-সেখানে দেখা যেতো বলেই হয়তো গ্রামটির নাম হয়েছে ভালুকাপাড়া। 

 সাধনা বুকে নিয়ে লেখা-লেখি করি

এই নয়নাভিরাম ও রহস্যাবৃত্ত গ্রামেই লেখকের জন্ম ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই, এক সাধারণ গৃহস্থের পরিবারে। তিনি গ্রামীণ পরিবেশে বড় হই। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা পাহাড়ী নীতাই নদী। ছোটকালে এর প্রবাহমান স্বচ্ছ জলে নেয়ে-ডুবে বড় হয়েছেন। নদীর দু’তীরের সবুজ-শ্যামল বন-বনানী আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মায়াবী স্বপ্নঘেরা এক কূলে তিনি জন্মেছেন। মা-বাবার সন্তানদের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান হিসাবে অতিআদরে ছেলেবেলা কাটিয়েছেন, মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছেন। মা-বাবা ঈশ্বরভক্ত ও ধার্মিক ছিলেন বলে ধার্মিকতার পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। তিনি প্রার্থনাশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেই সুন্দর পরিবেশেই মানবিকতার পরশে বেড়ে উঠেছেন। মা-বাবা আদর করে তার ডাকনাম রেখেছিলেন মানবেন্দ্র আর খ্রিস্টীয় নাম আন্তোনী চিরান। আরও অনেক অজানা বিষয় উঠে এসেছে ‘জীবন ও সমাজ’-এর সাক্ষাৎকারে।    

জীবন ও সমাজ : লেখক ও কবি হিসাবে আপনার লেখালেখির হাতেখড়ি কবে থেকে শুরু হয় এবং আপনার লেখার মূল বৈশিষ্ট্য কি বা কি বিষয়ে লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন?

লেখক: লেখক হিসাবে আমার হাতেখড়ি ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে। লেখা-লেখির প্রতি আমার অনুরাগ জন্মেছিল- ভালুকাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন একবার ফাদার ফ্রান্সিস গমেজ ভালুকাপাড়া ধর্মপল্লীতে খন্ডকালীন পালকীয় সফরে এসেছিলেন। সেসময় ফাদার নিজে একটি গান লিখে নিজে সুরারোপ করে সেই গানটি আমাদের শিখিয়েছিলেন। গানটির কথাগুলো হলো- ‘গারো পাহাড়ের পায়ের কাছে, ভালুকের মতো দাঁড়িয়ে আছে, ভালুক সেতো নয়, সে যে ভালুকাপাড়া----।’ তার সেই রচিত ও সুরারোপিত গান আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সেদিন থেকেই কবিতা বা লেখার অনুপ্রেরণা পাই। আর গল্প ও প্রবন্ধ লেখায় বি এফ রংদী ও মতেন্দ্র মানখিনের লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হই। মূলতঃ আমি প্রবাহমান জীবনের বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি।

জীবন ও সমাজ : সাহিত্যর প্রতি আপনার অনুরাগ মূলত কার অনুপ্রেরণা? আপনার লেখক বা কবি হয়ে উঠার গল্পটি কেমন ছিলো? আপনার কি কোন বই প্রকাশ হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তার নাম ও প্রকাশনী।

লেখক : আমার লেখক ও কবি হওয়ার গল্পটি এরকম- আগেই বলেছি যে, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন আমার লেখা-জোখার হাতেখড়ি। কিন্তু কোন লেখা কোন পত্র-পত্রিকায় পাঠায়নি। কারণ, নিজের মনে দুর্বলতা ছিলো যে, লেখাগুলো পত্র-পত্রিকায় ছাপানোর জন্য উপযুক্ত বা মনোনীত হবে কিনা ইত্যাদি মানসিক দ্বন্দ্ব। একবার, সাহস করে ‘সাপ্তাহিক প্রতিবেশী’ সাপ্তাহিক পত্রিকাতে একটি কবিতা লিখে পাঠালাম। প্রতিবেশী সম্পাদকীয় দফতর থেকে মন্তব্য এলো- ‘আপনার কবিতা অন্য কথা বলে, আপনি কবিতা না লিখে অন্যকিছু লিখতে চেষ্টা করুন।’ সম্পাদক মহাশয়ের মন্তব্য পড়ে সত্যিকার অর্থেই মনে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলাম এবং লেখা-লেখিটা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। একদিন কবি মতেনদা আমাদের বাড়ি আসলেন প্রায় দুই/তিন মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে। আমাদের বাড়ি আর মতেনদার বাড়ি একই নদী নীতাইয়ের পাড়ে। তিনি এসে আমাকে অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা দিলেন। তিনি বললেন, ‘যে পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে তুমি অপমান পেয়েছো, সেই পত্রিকা থেকেই তুমি একদিন সম্মান পাবে। তুমি তোমার লেখা চালিয়ে যাও।’

তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আবার লেখা-লেখি শুরু করলাম। এবং সেই পত্রিকা থেকেই ‘শ্রেষ্ঠ কবি দিপালী সাহিত্য পুরষ্কার’ লাভ করলাম। আজোবধি সাধনা বুকে নিয়ে লেখা-লেখি করছি। আমার প্রথম লেখা প্রকাশ হয় ‘সাপ্তাহিক প্রতিবেশী’-তে। ‘শারদ প্রভাতে’ কবিতা ও প্রথম গল্প ‘একটি শারদীয় মায়াবী রজনী’ও প্রকাশিত হয় একই কাথলিক পত্রিকায়। ‘প্রতিবেশী’তে প্রথম প্রবন্ধ ‘ধর্ম ও সমাজ’ প্রকাশ হয়। দুঃখের বিষয় এই যে, সেসময় আমার কোন বই প্রকাশ হয়নি। কারণ, যুবা বয়সে লেখা গল্প, প্রবন্ধ, কবিতার খাতাগুলো কোন না কোনভাবে মনোহারী দোকানে বিক্রি হয়ে গেছে কেজি দরে। সেটার কোন পান্ডুলিপিও আমার কাছে নেই। ইদানিং প্রতিবেশী পত্রিকার ‘জীবন ও সমাজ’ থেকে আমার লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধের একটি সংকলন ‘ধূসর ফুল’ নামে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এজন্য ‘জীবন ও সমাজ প্রকাশনী’কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

জীবন ও সমাজ : পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান আমরা সবাই কম-বেশি জানি। পুরুষ লেখকের পাশাপাশি নারী লেখকেরা কি সমাজের বাইরে? আপনার কি মনে হয়? সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হতে চাওয়াটা বা পারাটা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন? আপনার দৃষ্টিভঙ্গীতে নারীদের লেখক হয়ে ওঠার লড়াই ও গল্পটি আপনি কিভাবে দেখেন?

লেখক : পুরুষ লেখকদের পাশাপাশি নারী লেখিকাদের লেখালেখি করাটা মোটেও সমাজের বাইরে নয়। লেখালেখির ভাবনাটা মানবিক মূল্যবোধ থেকেই উৎসারিত হয়ে থাকে। যে কোন ব্যক্তি বাস্তব জীবনের চলমান-ঘটমান বিষয়কে উপজীব্য করে (সে নারী বা পুরুষই হোক) তার কলমের ভাষায় তুলে ধরতে পারেন। মানবিক মূল্যবোধের বাস্তব চিত্রগুলো থেকে- তিনি যেই হোক; নারী বা পুরুষ; তার সেই দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি আহরণ করবেন বা লিখবেন। সেখানে সমাজের কোন অসঙ্গতি থাকতে পারে, থাকতে পারে সমাজের কোন উন্নয়নকর্মের কথা; পরিকল্পনার কথা; থাকতে পারে মানবতা বা মূল্যবোধের কোন সংবাদ; চিরায়ত সংস্কৃতির বির্নিমাণের কথা। তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।

সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হওয়াটা বা হতে পারাটা একান্তই সাধনার ব্যাপার। যে কোন কাজ করতে গেলে বা সফলতা পেতে হলে, নিজেকে জানতে হয়ে, শিখতে হয়, পাঠাভ্যাস থাকতে হয়, নিজেকে আগে গড়ে নিতে হয়, সাধনা করতে হয়। আমার দৃষ্টিতে নারীদের লেখক হওয়াটা একটা বড় চ্যালেঞ্জিং বটে। পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের শাসন-বারণ, স্বামীর সেবা, সংসার গোছানো ইত্যাদি নারীর ওপরই বর্তায়। এর ব্যতিক্রম হলে স্বামীর কাছে জবাবদিহি করতে হয়। সে খ্রিস্টীয় পরিবারই হোক আর মুসলিম পরিবারই হোক বা হিন্দু পরিবারই হোক। তাই নারীদের লেখিকা হওয়াটা বাস্তবে চ্যালেঞ্জই বটে। তবে, মানবিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে নারীদের নারী হিসাবে ভাবলে হবে না। তাদেরকে মানবতার মাপকাঠিতে মাপতে হবে। কারণ, সবাইকে সৃষ্টিকর্তা মানবসত্ত্বা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। শিক্ষিত নারীদের প্রতিভা বিকাশে সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত।

জীবন ও সমাজ : আপনার ব্যক্তিগত, পেশাগত জীবন ও লেখক জীবন একসাথে কিভাবে সমন্বয় করেন?

লেখক: আমার ব্যক্তিগত জীবন চলমান, পেশাগত জীবনও চলমান। সামাজিক গতিধারার সাথে-সাথে মানবিক মূল্যবোধগুলো যখন হাজির হয়; তখন আমার ব্যক্তিজীবনের উপরও তা এসে পড়ে, রক্ত-মাংসের মানুষ হিসাবে তার প্রভাবটা আমার ওপরও বিস্তার করে- তাতে কোন সন্দেহ নেই। মানুষ হিসাবে কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করা প্রত্যেক মানুষের দায়িত্বের বা অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। সেসব বিষয় আমিও এড়িয়ে যেতে পারি না। সকলে জীবিকার তাগিদে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি বা পেশার সাথে জড়িত থাকতে হয়- এর বাইরে আমিও নই। তাই, বিভিন্ন ব্যস্ততার ফাঁকে সাহিত্য চর্চা চালিয়ে আসছি। মাঝে দিনের আহারের পর যতোটুকু সময় পাই বা বিশ্রামের জন্য যে সময়টুকু পাই- তাই সাহিত্য সেবায় ব্যয় করি। এবং রাতে শোয়ার আগে যখন সময় পাই, তখন লেখার চেষ্টা করি। আর পেশাগত জীবন যদি বলি- তবে, তাতে কর্তৃপক্ষ বা পেশা আর লেখক সত্ত্বার সাথে কোন বিরোধ রাখি না। যখন আমি পেশাকে চিন্তা করি, তখন শুধু তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ বা নিমগ্ন থাকার চেষ্টা করি। আর ব্যক্তিগত জীবন যদি বলি- সেখানে কারও সাথে কোন কম্প্রোমাইজ করি না। সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত।

জীবন ও সমাজ : আপনার পাঠক ও নবীনদের উদ্দেশে আপনার মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরুন।

লেখক: আমার পাঠক ও নবীনদের উদ্দেশে আমি বলবো-লেখা-লেখির মাধ্যম্যে ব্যক্তিগত প্রতিভার বিকাশ ঘটে। আর যদি লেখা মানসম্মত হয়, পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়; তাহলে একজন লেখককে সামাজিক স্বীকৃতিস্বরূপ- জাতীয় স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে উচ্চাসনে তোলা হয়। যেমন : আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই লেখা-পড়ার ফাঁকে-ফাঁকে সাহিত্য সাধনাকে সঙ্গী করে নিয়ে অলস সময় যেমন কাটে; ঠিক তেমনি সমাজের সেবা হয়; মানুষেরও সেবা হয়। আর এর মধ্যদিয়ে যেমন সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন হয়, আবার অন্যের মূল্যবোধ শিক্ষা, মানবতার দীক্ষা নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করাও হয়। সহনশীল ও পরিশীলিত সমাজ গঠনে সাহিত্য সেবার কোন বিকল্প নেই। যদিও আকাশ-সংস্কৃতি আমাদেরকে অনেক জ্ঞান ও শিক্ষা দেয়; তবুও আমি বলবো, লব্ধজ্ঞানকে নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতিতে আত্মীকরণ করে জীবনের ঐকান্তিক সাধনায় রত থেকে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার সুযোগকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানো বা জীবনের মূল্যবোধকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দেয়াটাই প্রত্যেক যুবক/যুবতীর কর্তব্য হওয়া উচিত বলে মনে করি।

পরিশেষে, লেখক যেমন করে আপন সাধনার বলে সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রেখেছেন, সেইসাথে প্রশংসনীয়ভাবেই সমন্বয়ও করেছেন লেখক ও ব্যক্তিগত জীবনে। তিনি তার লেখনির মধ্যদিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছেন মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও মানবতার শিক্ষার দ্যূতি, যা ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে অনুপ্রাণিত করছে। আপন সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ  ও মানসম্মত লেখনি উপহার দিতে আগামী প্রজন্মকে সাধনা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন অবিরাম।


Post a Comment

Previous Post Next Post