সাক্ষাৎকারে জীবন ও সমাজ: লেখিকা ও কবি মালা চিরান। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই নারী সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্ত বাতায়নে নিজের ইচ্ছা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞার বলেই নিজেকে প্রকাশ করার পথ খুঁজে নিয়েছেন তার কবিতার মধ্যদিয়ে। কবির ছেলেবেলা কেটেছে অতিসাধারণভাবেই। একান্নবর্তী পরিবারে সবাই একসাথে বড় হয়েছেন, খেলাধুলা ও স্কুলে যাওয়া সবই করেছেন। মেয়ে হিসেবে বাড়ির কাজ-কর্মেও পিতা-মাতাকে যথাসম্ভব সহায়তা করেছেন। সকল দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লেখক হিসেবে নিজের মননশীলতা ও সাহিত্যের চর্চা করেছেন গভীর আগ্রহভরে। কষ্টের মাঝেও আনন্দ খুঁজে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ব্যক্তিত্বের নাম লেখক মালা চিরান।
মূলত সংসারের চাপে থেকে লেখালেখি করা বা সাহিত্য চর্চা করা সত্যিই কষ্টকর, আবার একইসাথে আনন্দেরও। তবে তিনি সবকিছুকে প্রাধান্য দিয়েই কাজ করতে পছন্দ করেন। যেমন: নিজের সংসার গোছানো, সাহিত্য চর্চা করা ইত্যাদি। লেখকের মতে, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। সেই ইচ্ছাশক্তির জোরেই তিনি শত ব্যস্ততার পাশাপাশি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও ভালোবাসা ধরে রেখেছেন।
লেখকের লেখালেখির হাতেখড়ি শুরু হয় যখন তিনি হাই-স্কুলের ছাত্রী। এবিষয়ে তিনি নিজেই জীবন ও সমাজ’কে বলেন যে, ‘আমার বড় দিদি প্রয়াত ঝর্ণা চিরান সাপ্তাহিক প্রতিবেশী থেকে ‘কবি’ পদকে সম্মানিত হয়েছিলেন, তাকে দেখেই মূলত আমি অনুপ্রাণিত হই।’ আর সেই থেকেই সাহিত্যের হাত ধরে পথচলা শুরু এবং তা চলমান রাখতে চান তিনি। লেখকের মতে, ‘কোন লেখকের লেখার কোন বৈশিষ্ট্য বা নির্দিষ্ট কোন দিক থাকতে পারে না, কেননা লেখক যখন কোন কিছু উপলব্ধি করে, তখন তা নিয়েই লিখতে আরম্ভ করে আর তা বিবিধ বিষয়ে হতে পারে। তবে আমি সব বিষয়েই রুচিশীল এবং যে কোন বিষয়ে লিখতে আগ্রহবোধ করি।’
লেখিকার অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ আমার দিদি প্রয়াত ঝর্ণা চিরানের অনুপ্রেরণা। আমার লেখিকা হয়ে ওঠার গল্পটা যতোটা কঠিন ছিলো, ততোটাই আনন্দেরও। কারণ যখন সংসার জীবন শুরু করি, তখন সন্তান সামলানো, স্বামী-সংসার জীবন সামলানো সব কিছু মিলিয়ে খুবই কঠিন সময় যাপন করছিলাম। এমনও দিন গেছে যে, কলম হাতে নেয়ারও সময় পাইনি, তারপরও থেমে থাকিনি। আমি সেই পথ অনুসরণ করেই এগিয়ে চলেছি, যেখানে আমি আজ দাঁড়িয়ে আছি সবই আমার পরিশ্রম ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞার ফসল। আমার একটি কবিতা ‘কুয়াশায় ঢাকা একটি গোশালা’ তৎকালীন পুরানো দিনের কথা নামক পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এরপর সাপ্তাহিক প্রতিবেশী’র সাধারণ ও বড়দিন সংখ্যাগুলোতে আমার প্রথম কবিতা মায়ের সন্ধানে ও অন্যান্য কবিতাও ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পায়।’
পুরুষ ও নারী লেখকদের মধ্যে বৈষম্য সম্পর্কে জানতে চাইলে জীবন ও সমাজ’কে তিনি বলেন, একজন লেখক বা লেখিকা অথবা নারী বা পুরুষ হোক না কেন সেটা মূখ্য বিষয় না। সমাজে যতোটুকু একজন পুরুষ পেয়ে থাকে, তুলনামূলক সেসমানই নারী লেখকও পেয়ে থাকে। সবকিছু নির্ভর করে তাদের মানসিকতার ওপর। কখনই সমাজের বাইরের কেউ হতে পারে না। কাজেই, নারী লেখক হতে চাওয়াটা সত্যিই অতুলনীয়, কারণ নারীকে প্রথমতো তার সংসার সামলাতে হয়, মা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়; আবার সংসারের নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় যা একজন নারীই উপলব্ধি করতে পারে। সবকিছু সামলে একজন নারী লেখক হতে পারাটা চ্যালেঞ্জিং বটে। তিনি আরও বলেন, নারী-পুরুষ লেখকের লড়াইয়ে আমি জানি না কতোটুকু টিকে থাকতে পেরেছে, তবে হ্যাঁ, আমি আমার লেখনিকে প্রাধান্য দেই। যে বিষয়েই লিখি না কেন, গুছিয়ে ও যত্ন সহকারেই লেখার চেষ্টা করি। আমার বিশ্বাস, আমার লেখাই আমাকে টিকিয়ে রাখবে।
নারীর অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার ব্যক্তিগত জীবন বলতে সংসার কারণ একজন নারীর সংসারই তার ব্যক্তিগত জীবন। তার বাইরে আর কোন ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে বলে মনে হয় না। আমার ব্যক্তিগত জীবনকে যেভাবে উপলব্ধি করি, ঠিক তেমনি লেখার চর্চা করার প্রয়োজনও উপলব্ধি করি। আর এই দুটো জিনিস একসাথে করতে এখন আর আলাদা মনে হয় না। দুটোকে একই মনে হয়। তাছাড়া, একে-অন্যের পরিপূরক মনে করি। এটাই আমার ব্যক্তিগত জীবন আর এটাই আমার লেখক জীবন।
নারী কবি বা লেখক হিসেবে তার বক্তব্যে তিনি বলেন, আমি একজন লেখক, আমি জানি কিভাবে চেষ্টা, পরিশ্রম, ধৈর্য ধরে লিখতে হয়। একবার ভুল হলে আবার লেখা বার-বার ভুল হলে সংশোধন করা অত্যন্ত কষ্টের এবং ধৈর্যেরও। যে কেউ চাইলেই লিখতে পারে না, আবার কেউ পারলেও হয়তো তেমনভাবে লেখনিগুলো গুছাতে পারে বা ফুটিয়ে তুলতে পারে না। কিন্তু হ্যাঁ, সে যদি হাল না ছাড়ে, তাহলে অবশ্যই সে কোন একদিন সফলতার মুখ দেখবেই কারণ পরিশ্রম কখনও বৃথা যেতে পারে না। আমরা লেখকেরা একেক জন ভিন্ন ধরনের লেখনি লিখতে পছন্দ করি বা লিখে থাকি। একেক জনের চিন্তা-ভাবনা একেক রকম, কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা একটাই আমরা লেখক। আমরা আরও সুন্দর-সুন্দর লেখনি সবাইকে উপহার দিতে পারি। বিশেষত, আমাদের ছেলে-মেয়েদের আগ্রহী করার জন্য। তারা যেন আমাদের অনুকরণ করে লেখক হতে চেষ্টা করে, বাংলা ভাষার রূপকে আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে। তবেইতো এই জনম সার্থক হবে বলে আমি মনে করি।
পরিশেষে, লেখিকার এই শুভচিন্তা তার লেখনির মধ্যদিয়ে আরও প্রসারিত হোক এবং আলোকিত করুক আরও অনেককে। এছাড়াও, লেখিকা মালা চিরানের শুভইচ্ছা যেন তরুণ-তরুনীদের মাঝে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করে এটাই কাম্য। জয় হোক নারীদের, যারা ঘরোয়া গন্ডি হতে বেরিয়ে এসে নিজেকে প্রকাশের দৃঢ় বাসনা মনে-প্রাণে লালন করে॥
Tags:
ফিচার