“ভালো আছো অনিতা?” অশেষ অনীতার ভালো-মন্দ কুশল জানবার জন্যেই প্রশ্ন করেছিলো আগ্রহভরে। কিন্তু অনিতার কোমল নারী মনে যে বিরহের সুপ্ত যন্ত্রণাটা এতোদিন লুকিয়ে ছিলো তা যেন অশেষের প্রশ্নে তার দর্শণে আচমকা বিষফোঁড়া হয়ে টন্-টন্ করে উঠেছে যেন! কিন্তু অশেষ তা অনুমান করতে পারেনি। সে ভেবেছিলো দীর্ঘ বিশটি বছরের ব্যবধানে সে হয়তো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, নতুবা নতুন কোন স্বপ্নের বিভোরে সে মজে আছে, কিন্তু অশেষ যা ভেবেছিলো তা নয়। অনিতা একটা চাঁপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কান্নামিশ্রিত সুরে বলে উঠে, ‘ভালোই তো আছি অশেষদা’। কথাগুলো বলেই সে অশেষের দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে থাকে। দীর্ঘ বিশটি বছর পর দুজনার মাঝে দেখা। এই বিশটি বছরের মধ্যে গ্রামের পরিবেশ-পরিস্থিতি, যুগ ও কালের অনেক বির্বতন ঘটেছে। ঋতুর পরিক্রমা ঠিক থাকলেও গ্রামীণ জীবনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামে অনেক পাঁকা বাড়ি হয়েছে, কাঁচা রাস্তা পাঁকা হয়েছে, পল্লী বিদ্যুতের আওতায় ঘরে-ঘরে এখন বিদ্যুতের বাতি জ্বলে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও গ্রামে এখন শিক্ষিতের সংখ্যা বেড়েছে। মানুষের রুচিবোধ, তাদের প্রবাহমান জীবনেরও প্রভূত উন্নতি হয়েছে। ষাটের দশকে এ গ্রামের মানুষ অশিক্ষায়, কুসংস্কারের অন্ধ জগতে বাস করছিলো। আজ সেই গ্রামের মানুষ শিক্ষার আলো পেয়ে তাদের জীবন-মানকে উন্নত করেছে, বহিবির্শ্বের সভ্যতার সাথে তারাও এখন তাল মিলিয়ে চলতে শিখেছে। আসলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই গারো সমাজে শিক্ষার রেঁনেসা শুরু হয়। অনিতা বর্তমানে কুমুদিনী হাসপাতালে নার্সিং-এ কাজ করে। এখনও ঘর-সংসার করেনি। আর ঘর-সংসার করবে না বলেই সে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে। অশেষকে জীবন থেকে হারিয়ে সে আজ মনে অনেক দুঃখ-কষ্টকে বুকে চেপে রেখে নার্সিং জীবনকেই বেছে নিয়েছে। আর্ত-মানবতার সেবার মধ্যদিয়েই সে যেন অতীতকে ভুলে থাকতে চায়। অশেষকে ভালোবেসে সে যে ভুল করেছে সে-ই ভুলের মাশুল যে তাকেই দিতে হবে। আরেকদিকে অশেষ ঘর-সংসার করে তিন সন্তানের জনক হয়েছে। এখন সে তাদের হাজং সমাজের গাঁও বুড়া অর্থাৎ গ্রামের নির্বাচিত প্রতিনিধি। তার কথায় এখন গ্রামের মানুষ উঠা-বসা করে। উচ্চশিক্ষিত বলে রাজনীতি ক্ষেত্রও তার যথেষ্ট প্রভাব, প্রতিপত্তি আছে এবং ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনরও সে নির্বাচিত প্রতিনিধি।
অসম সমাজ |
অশেষ আর সুনীতির মাঝে হৃদ্যতার সেতু বন্ধন হয় সৌভাগ্যক্রমে। স্থানীয় ধর্মপল্লীতে সত্তর দশকে কোন সঙ্গীতজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন অন্ততপক্ষে গারোদের মধ্যে। তাই ধর্মপল্লীর উপাসনা সঙ্গীতে, তবলায় কোন ব্যক্তি সঙ্গত করার ছিলো না বলে অশেষকে টেনে আনা হয় উপাসনা কমিটির সিদ্ধান্তমতে। বিশেষ করে, বড়দিনের উৎসবে, ইস্টারে অশেষকে টেনে আনা হয় উপসানায় প্রাণবন্তটা আনয়নের জন্য। অশেষ নটরডেম কলেজে পড়াশোনাকালীন তিন বছর তালিম নিয়েছিলো ওস্তাদ রহুল হাসানের কাছে। বর্তমানে অবশ্য স্থানীয় ম-লীতে অনেক সঙ্গীত শিল্পী, যন্ত্রশিল্পী গারোদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে। সব কিছুর মূলে রয়েছে খ্রিস্টম-লীর অবদান। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ যাবৎ খ্রিস্টম-লী কর্তৃক সঙ্গীত কোর্সের ব্যবস্থা করায় গারোদের মধ্যেও এর প্রতক্ষ্য প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে নানা আচার-অনুষ্ঠানে। বর্তমানে সঙ্গীত জগতে গারোদের অবস্থান, বিচরণ সত্যিই প্রশংসনীয়। গারোদের মধ্যে এখন অনেক সঙ্গীত শিল্পী রেডিও, টেলিভিশনে অংশগ্রহণ করছে, এটা সত্যিই বাস্তব ছবির ইঙ্গিত প্রদান করে।
অনিতা ময়মনসিংহের হোলি ফ্যামিলি গার্লস হাই স্কুলে পড়া-শোনাকালীন খ্রিস্টান সমাজের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ব্যক্তি প্রয়াত সুশীল বাড়ৈয়ের কাছে সঙ্গীত এবং হারমোনিয়ামে তালিম নিয়েছিলো তিন বছর। সেই খ্রিস্টীয় উপাসনায় লিড দিয়ে আসছিলো এককভাবে। আর এ সুবাদেই অশেষের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা, হৃদ্যতা, ভালোবাসার সম্পর্ক।
অশেষ একান্ত শান্ত-শিষ্ট আর দারুণ মিশুক ছেলে ছিলো বলে সবার সাথেই তার ঘনিষ্ঠতা ছিলো। বিশেষত, গারো ছেলে-মেয়েদের সাথে তার অবাধ মেলা-মেশা সবাইকে অবাক করতো। সে গারো ছেলে-মেয়েদের সাথে বড়দিনের উৎসব, ইস্টারের উৎসব এমনকি প্রায়ই প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভূমিকাও পালন করতো। অথচ হাজং সমাজে এমন কোন কঠিন নিয়ম এছ হাজং পরিবারের কোন ছেলে-মেয়ে কোন বিজাতীদের সাথে মেলা-মেশা করলে, তাদের সাথে পনাহার করলে তাকে সামাজিক বিধি লঙ্ঘনের দায়ে জবাবদিহি করতে হতো। যদিও বর্তমানে এব্যাপারে অনেক শিথিলতা এসে গেছে। কিন্তু বিজাতিদের বিয়ে করলে এখনও সামাজিক নিয়ম ভঙ্গের কারণে তাকে মানত পূরণ করতে হয়। এমনকি সনাতন ধর্মমতে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মানত পূরণ করতে হয়।
অশেষ আর সুনীতির বাড়ি পাশাপাশি গ্রামেই। মাঝখানে নিতাই নদী, এপার আর ওপার। একবার আশ্বিন মাসে নদী পার হতে গিয়ে নৌকা ডুবিতে মরতে বসেছিল অনিতা।
নিতাই নদীতে তখন পাহাড়ী ঢলে জলে টৈ-টুম্বুর। যদিও বর্ষাকাল তখন শেষের দিকে কিন্তু হঠাৎ করে প্রবল বর্ষণে নদীতে ঢল নেমেছিলো। নদীর মাঝখানে হঠাৎ করে একটি বড় ঢেউ এসে তাদের নৌকাটা ডুবিয়ে দেয়। সাতার জানলেও পরনে শাড়ী থাকায় সে সাঁতরাতে পারছিলো না। ভাগ্যিস! অশেষ তার জন্য অপেক্ষায় এপারে বসেছিলো। অশেষ সাঁতরিয়ে তাকে পারে নিয়ে আসে। সেদিন সাধ্বী তেরেজার পর্ব উপলক্ষে দুজনের মিশনে যাবার কথা ছিলো কিন্তু দুর্ঘটনার পরে আর যাওয়া হয়নি। এই দুর্ঘটনাটা তাদের হৃদ্যতাকে আরো বেশি নিবিড় ও গাঢ় করে তোলে। অনিতা সত্যি-সত্যি জীবন রক্ষাকারী বন্ধু হিসাবে অশেষকে নিজের করে নিয়েছিলো তার নারী হৃদয়ের কোমল ভালোবাসা দিয়ে। কিন্তু বাঁধ সাধলো অশেষের বাবা আর মৌলবাদী হাজং সমাজ। হাজং ছেলে হয়ে গারো মেয়েকে বিয়ে করবে, ঘর-সংসার করবে? তা কি করে সম্ভব?, হাজং সমাজে যে, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের বাছ-বিচার আছে। তাই ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। গয়েশ্বর রায় একদিন ছেলেকে ডেকে নিয়ে প্রশ্ন করে বসে, ‘তয় নাকি গারো টিমিতগে বালবাসিলে? হুন্ বাবা, তয় যদি গারো টিমিতগে বিয়ে কয় তাইলে তলা ঘর ছারবা লাগব। আর যদি মুলা কথারা না মানে কে বিয়ে কয়, তা’লে মূলা মরা মূখ দেখিব’। বাবার মুখে এরকম অলুক্ষণে কথাগুলো শুনে অশেষ একেবারে চুপ্সে যায়। ঘর থেকে বেড়িয়ে সে আকাশ-পাতাল অনেক কিছু ভাবতে থাকে।
একদিকে অনিতা তার ভালোবাসা। আরেকদিকে তার বাবা, সমাজ, ভাবতে গিয়ে তার হৃদয়টা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। বেদনার কাল মেঘে ঢাকা দুচোখে অশ্রুর বন্যা নেমে আসে মনের অজান্তেই। সে মনে-মনে ভাবে ভালোবাসার কি কোন জাত-বিজাত আছে নাকি কারোর পক্ষপাত করে ভালোবাসা এমন একটি আত্মিক চেতনা বা ঐশ্ব প্রদত্ত্ব মানবিক গুণাবলী যা অপরকে আপন করে নিতে হৃদয়কে উন্মুক্ত করে তুলে। হয়তো কারো-কারোর ব্যক্তিজীবনে জৈবিক লালসার উগ্র প্রবণতা পশুতে রূপ নেয়। কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসায় কোন স্বার্থপরতা থাকে না বা কারোর অমঙ্গল কামনা করে না, বরং প্রকৃত ভালোবাসা ত্যাগ ও অন্যের সেবাদানে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। অশেষ আরো জানে, যে যে বাবা সন্তানের জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতাকে গ্রাহ্য করে না, সন্তানের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বরদাস্ত করে না; যে সমাজ ব্যক্তিজীবনের মানবিক কর্ম ও স্বপ্নকে গ্রাহ্য করে না, মূল্যায়ন করে না সেই সমাজে মানুষ কিভাবে জীবনের অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণে বেঁচে থাকার স্বার্থকতা খুঁজে পাবে? মানবিক জীবনে সাম্য-মৈত্রীর দীক্ষায় দীক্ষিত হবে মানবতার ফসল ফলাবে। অশেষ অনীতাকে ভালোবাসে, তাকে নিয়ে ঘর-সংসার করার যে মধুর স্বপ্ন দেখেছিলো তা যেন হাজং সমাজের স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের অমানবিক রীতি-নীতির কারণে একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে যায় তার বাবার কঠিন সিদ্ধান্তে। ভালোবাসা যদিও সর্বজনীন তথাপি অশেষর বেলায় তা যেন ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। যেমন, বাবার ব্যক্তিমর্যাদা, পারিবারিক জীবনের মূল্যবোধ, সামাজিক জীবনের মূল্যবোধ আর বাধ্যবাধকতা সব কিছু মিলে তার ব্যক্তিগত অভিপ্রায়, অভিরূচিতে ভেঙ্গে খান-খান করে দেয় ভঙ্গুর কাঁচের মতো। এ ঘটনার দুই মাস পরেই বাসন্তী নামের এক স্ব-জাতি মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় অশেষের। এদিকে অনিতা মনের দুঃখে-কষ্টে, বিরহের অসহনীয় যন্ত্রনা নিয়ে আর বিয়ে করবে না বলে কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এবং নার্সিং জীবনে প্রবেশ করে আর্ত-মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে আত্ম-প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। যেই ভাবা, সেই কাজ। একই বছরে নার্সিং ট্রেনিংয়ে চলে যায় কুমুদিনী হাসপাতালে। তিন বছর ট্রেনিং শেষ করে সেই হাসপাতালেই সে নার্সিং-এর কাজে যোগ দেয় নব আশা ও উদ্দিপনা নিয়ে। বিশটি বছর পর বড়দিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসে হঠাৎ করেই অশেষের সাথে দেখা। জীবনের প্রাণময়, উচ্ছল বসন্তে যে মানুষটিকে সে ভালোবেসে আপন করে নিয়ে ঘর বাঁধবার মধু-স্বপ্ন দেখেছিলো; আজ সেই মানুষটি তাকে ফাঁকি দিয়ে কি করে আরেকজনকে নিয়ে ঘর করতে পারে? হাজারো চিন্তা, হাজারো প্রশ্ন তার কোমল নারী মনকে বিহ্বল করে তোলে।
হায়রে হাজং সমাজ! যে সমাজ অনিতার ভালোবাসাকে মূল্য দেয়নি, যে সমাজ তার মানবতার সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করেনি, যে সমাজ নিজস্ব সামাজিক গন্ডির খোলসে এখনও মোড়ানো; সেই সমাজকে সে মানবতার পরিপন্থী বলেই মনে করে। অশেষ অনিতার কান্না দেখে তাকে সান্তনা দেবে বলে কাছে গিয়েও সে ফিরে আসে। কারন সে যে এখনও অনিতার কেউ নয়। সে এখন বাসন্তীর স্বামী। অশেষ আত্ম অহমিকা বশত: লোক দেখার ভয়ে অনিতাকে ফেলে চলে যায়, তার গন্তব্য পথে। অশেষ আজ তাদের গ্রামের গাঁও বুড়ো, সমাজপতি, হাজং সমাজের কর্ণধার। অনিতার সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। লোকে দেখলে তার ব্যক্তিমর্যাদা ক্ষুন্ন হবে, হাজং সমাজের লোকেরা দেখলে ছি ছি করবে কারণ অনিতা তাদের সামাজিক বিধিমতে অস্পৃশ্য গারো জাতি আর সে হলো সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজং জাতি। দুই সমাজের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। শুধু এইটুকু মিল আছে দুই সমাজই মানব সমাজ। ধর্মের মধ্যেও ব্যবধান, গারোরা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী আর হাজংরা সনাতন ধর্মাবলম্বী। দুই জাতির মধ্যে এখানেই ব্যবধান। অনিতা চোখের জল মুছতে-মুছতে বাড়ির পথে পা বাড়ায় এক বুক জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়ে আর আরেকদিকে অশেষ জাত-কুল-সমাজের আত্ম অহমিকা নিয়ে পাশ কেঁটে চলে যায় অনিতার দৃষ্টির অন্তরালে॥