পার্বতীর পর্বত সমান ভালবাসা

 জ্যাষ্টিন গোমেজপার্বতীর গায়ের রং তেমন সুন্দর না। তার মানে এই নয় যে খুব খারাপ। কিন্তু চোখ দুটো মন কাড়ার মতো। মায়াবী হরিণীর ন্যায়। আর যাই বলুন না কেন ভালবাসার মতো বড় একটা দিল আছে। সে জানে কিভাবে ভালবাসতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে কারো ভালবাসা পায়নি তার জীবনে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা অনাদরে বড় হয়েছে। বরাবরই লক্ষ্য করে এসেছে তার বড় ভাই যতটা না সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, তার চেয়ে অনেকগুণ কম ভালবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠছে সে তার জীবনে। এছাড়াও মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে সে যে কত তিক্ত অভিজ্ঞতার  হয়েছে তা বর্ণনার অতীত। সবকিছু মিলিয়ে তার জীবনে দুঃখের অন্ত নেই। কিন্তু মিশির আলীকে যখন সে তার জীবনে পায়, তখন যেন জীবন খুঁজে পায়। যেন জীবনের এক আস্বাদ পায়। নতুন এক জগতের সন্ধান পায়। যে জগতে ভালবাসার ঘাটতি বিরল।

পার্বতীর পর্বত সমান ভালবাসা

এই তো বেশি না, ইন্টার পরীক্ষা শুরু হয়ার আগেই মিশির আলীর সাথে তার পরিচয়। প্রথম পরিচয়ে একটু সখ্যতা তারপর বন্ধুত্ব আর সেখান থেকে মোড় নেয় ভালবাসায়। আর এই নিয়ে চলছে দুবছর তাদের সম্পর্ক। মিশির আলী পার্বতীর জীবনের সব দুঃখ-কষ্টের কথা শুনেছে। শুধু তাই নয়, সে তার সাধ্যমত পার্বতীর জীবনে ভালবাসায় পূর্ণ করে দিতে চেষ্টা করছে। মিশির আলী সবসময় নিজেকে একটাই প্রশ্ন করে, সে পার্বতীকে সুখী রাখতে পারছে তো! এদিকে পার্বতী সর্বদাই মিশির আলীকে বলে, “তুমি আমার জীবনে এসে আমার জীবনটাই পাল্টে দিয়েছ। যেভাবে ভালবেসে যাচ্ছ সেভাবেই ভালবেসে যাও। শুধু অনুরোধ, ছেড়ে যেও না কোনদিন।পার্বতী স্বীকার করে, মিশির আলী তার জীবনে আসার পর তার জীবনে ভালবাসার  স্রোত বইতে শুরু করেছে। ভালবাসা যে কি জিনিস সে তা সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই সেও তার জীবনের সকল ভালবাসা দিয়ে মিশির আলীকে ভালবাসতে লাগলো। তাদের এই ভালবাসার কথা কেউ জানত না। শুধুমাত্র পার্বতীর এক বান্ধবী মুক্তা এবং আলীর এক বন্ধু বিমল ছাড়া। পার্বতী চাইত তাদের ভালবাসার কথা সবাইকে জানিয়ে দিতে কিন্তু আলী চাইতো না। আলীর ভাষ্য, “লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করার মজাই আলাদা। আর এই ভালবাসার গভীরতা থাকে অনেক এবং ভিত্তি হয় মজবুত।একদিন দুজনে চন্দ্রিমা উদ্যানে পাশাপাশি বসে আছে। পার্বতী আলীর ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আলীর পিঠে হাত বুলাতে-বুলাতে বলেছে, “জানো, আমি তোমাকে অনেক ভালবেসে ফেলেছি। কেন এমনটি হয়! তোমাকে ছাড়া এক মূহুর্ত যেন আমার কাছে অনেক যন্ত্রণাদায়ক। কেন এভাবে ভালবেসে ফেলেছি তোমাকে! কথা দাও কোনদিনও ছেড়ে যাবে না আমাকে। বল, কখনো কষ্ট দেবে না আমায়।” “কি বলছ এইসব! এখানে আবার ছেড়ে যাবার কথা আসছে কেন! ভাল আমি তোমাকেই বেসেছি। মন আমি তোমাকেই দিয়েছি। আজ একটা কথা পরিষ্কার করে জেনে রেখো, তোমাকে আমি কখনো মন থেকে মুছতে পারব না।” “তবুও ভয় হয়। মাঝে-মাঝে মনে হয়, এতো ভালবাসা আমার কপালে সহ্য হবে তো! সবার কপালে তো আর সুখ জোটে না।” “শোন, আমি জানি না আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো কিনা। যদি বিয়ে করতে নাও পারি, তারপরও আমি তোমাকে ভালবেসে যাবো। আজীবন ভালবেসে যাবো। তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না কতো ভালবাসি তোমায়। শুধু এইটুকু মনে রেখ তুমি আমার মনের যেই স্থানে রয়েছ, সেখানে আর কেউ আসতে পারবে না।” 

বলে রাখা ভাল, আলী মুসলিম আর পার্বতী হিন্দু। পরক্ষণেই তারা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। গভীরভাবে চুমু খেলো। পার্বতী কেন জানি কান্না করে ফেললো। হযেতো এটাই ভালোবাসা। পরদিন অর্থাৎ ২১ শে মে তারিখ ঘটলো এক অপ্রত্যশিত ঘটনা। আলী তার বন্ধু বিমল তো ভার্সিটির একই হলেই থাকতো। ঐদিন হলো কি, বিমলের মা গ্রাম থেকে এসেছে বিমলকে দেখতে। পরে বিকেলবেলা বিমল তার মাকে গাড়িতে পৌছে দিতে বেড়িয়ে পড়লো। কিন্তু ভুলে মোবাইল ফেলে যায়। আর বিমলের এই ভুলটা প্রায়ই হয়। একটু পর দেখল বিমলের সেল-ফোনটা বেজে উঠলো। আলী ধরেই নিয়েছে ফোনটা বিমলই করেছে তার ফোনটা ঘরে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। তাই আলী ফোনটা রিসিভ করায় তেমন কোন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। কিন্তু ফোনটা বারবার বাজছে। এইভাবে ১০ বার ফোন এসেছে। শেষে আলী বিরক্ত হয়ে যেই ফোনটা রিসিভ করবে দেখে ফোনটা করেছে পার্বতী। পার্বতীর নম্বর দেখে ভেবাচেকা খেয়ে গেল। তাই আর রিসিভ করতে পারল না। আলী চিন্তা করতে লাগলো, “পার্বতী বিমলকে কেন কল করছে! কে জানে হয়ত আমার খবর নেয়ার জন্যে।এসব চিন্তা করতে-করতে পার্বতীর নম্বর থেকে একটা মেসজ এল- “কি হলো সোনা, ফোন ধর না কেন? বেশি ব্যস্ত নাকি? আজকে সারাদিন একটা ফোনও দিলা না। তুমি ভাল আছ তো? লাভ ইউ বেবি।মেসেজটা দেখে আলী তো পুরাই পাথর। সে তো নিজের চোখকে বিশ্বসই করতে পারছে না। তাই বারবার নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে মেসেজটা কি পার্বতীর ফোন থেকেই এসেছে কিনা। বিমল আবার পার্বতীর নম্বরটা তার ফোনেহিমা’- নামে সেভ করে রেখেছে। সবকিছু কেন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই কিছু মিলছে না আলী।

যতই মিলাতে যাচ্ছে, ততই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মিশিরআলী কল্পনাই করতে পারছে না। বিমলের কল হিস্ট্রিটা দেখতে লাগল। চেক করে দেখে পার্বতীর সঙ্গে বিমলের প্রায় ফোনে কথা হতো। তাও দীর্ঘ সময় ধরে। আর মেসেজ চ্যাট তো পুরাই মাথা নষ্ট করার মতো। মেসেজগুলোর মধ্যে অন্যতম, “হাই সোনা”, “হ্যালো”, “কি কর জান”, “লাভ ইউ বেবিইত্যাদি আরো কত! এত কিছু দেখার পরও আলী ঠান্ডা মাথায় বিমলের ফোন থেকে প্রয়োজনীয় কিছু সিক্রিন-সর্ট নিয়ে ফোনটা এমনভাবে রেখেছে বিমল যাতে বুঝতে না পারে। আলী ভাবতে লাগল কি করবে। চিন্তাশক্তি কিছুতেই কাজ করতে পারছে না। তবে লক্ষ্য শুধু একটাই, শান্তিপূর্ণ একটা সমাধান। আলী কোন রকম ঝামেলা পছন্দ করে না। তাই তো বিমল রুমে আসার পর আলী কোনো রকম অশোভন আচরণ করলো না। তাকে কিছুই বুঝতে দেয়নি। কিন্তু পার্বতীর বিষয়ে কি করবে! তার প্রতি আগে যেরকম ভালবাসা আন্তরিকতা ছিল তার বিন্দু মাত্রও নেই এখন। পার্বতী কি করে পারল তাকে নিয়ে এই ধরণের খেলা খেলতে! আলী আবিষ্কার করতে চেষ্টা করতে লাগল পার্বতীর কোন্ ভালবাসাটা প্রকৃত! আলীর প্রতি তার ভালবাসা সত্য, নাকি বিমলের প্রতি তার ভালবাসা! নাকি পার্বতীর ভালবাসা পর্বত-সমান! এইসব চিন্তা করতে করতে আলী হঠাৎ সচেতন হয়ে বলে ওঠল, “না এইসব নিয়ে ভাবলে হবে না। দুদিন বাদেই ফাইনাল পরীক্ষা। আগে পরীক্ষা, তারপর ভালবাসা।যেই কথা, সেই কাজ। মোবাইলাটা হাতে নিয়ে পার্বতীকে এসএমএস করলো, “ফাইনাল পরীক্ষার জন্যে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো না। তুমি আমার পরীক্ষার পর অর্থাৎ আগামী ২৫ মে রমনা পার্কে বিকেল বেলা দেখা করতে এসো। বাই।এই বলে ফোনটা বন্ধ করে দিল আর পুরোদমে পড়াশুনা করতে লাগল। 

এদিক দিয়ে আলী আবার ঠিক আছে। আর যাই করুক না কেন পড়াশুনায় কোন প্রকার অবহেলা করে না। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন  ২৫ তারিখ তারা দুজনে মিলিত হলো রমনা পার্কে। আলীকে দেখে পার্বতী দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। আর এই মুহর্তটা আলীর বুকের ভিতরটা পুরোদমে কাঁপিয়ে দিল। তবুও পার্বতীর প্রতি আর আগের মতো সেই ভালোবাসা আন্তরিকতা নেই। আর এই রকম পরিস্থিতিতে এটাই তো হয়ার কথা। পার্বতী বলল, “তুমি জানো, আমি তোমাকে কত মিস করেছি! তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন! একটা ফোন পর্যন্ত করলে না। কেন আমাকে এতো কষ্ট দিলে!” আলী কথাগুলো শুনছে আর পার্বতীর দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে, কি মায়াবী! দেখে মনে হয় কত নিষ্পাপ। এদিকে আলীর নিরবতা দেখে পার্বতী বলল, “কি হল, কিছু বলছ না কেন! চুপ করে আছ কেন?” “কি আর বলবো। বলার মতো কি আর কিছু আছে? বাকি আছে এখন শুধু দেখার।” “তাই! তা কি দেখছ শুনি।” “কাকে আর দেখব। তোমাকেই তো দেখছি।” “ওমা আমাকে আবার কি দেখার আছে?” “আছে-আছে। অনেক কিছুই আছে। তোমাকে যতবারই দেখছি, মনে হয় ততবারই নতুন করে দেখছি। আরো যে কত নতুন দেখব!” “হইছে আর বলা লাগবে না। অনেক হইছে।কৃত্রিম একটা হাসি হাসলো আলী। ভেবেছিল এখানেই সম্পর্কের ইতি টানবে। কিন্তু কেন জানি পারছে না। চাইলেই ছাড়তে পারছে না। ভেতর থেকে মানতে চাইছে না। 

আবার মনকে সান্ত্বনাও দিতে পারছে না। আলী চাইলে এখানেই তাদের সম্পর্কে সমাপ্তি ঘটাতে পারে। কিন্তু তা সে করেনি, করতে পারেনি। কেননা পার্বতীকে বড্ড ভালবেসে ফেলেছে। তাই কি করবে বুঝে ওঠতে না পেরে আলী সব কিছু নিয়তির হাতে ছেড়ে দিলো। তবে এটা নিশ্চিত এই সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না। হয়তো আলীর একটু-একটু অবহেলা -আন্তরিকতা জমতে-জমতে সবকিছু বিলীন করে দেবে। মিশির আলীর মনে আজ একটাই সান্ত্বনা কাজ করছে, “আমার ভালবাসা তো আমাকে ছেড়ে ভালো আছে। জানি ওকে ছেড়ে থাকতে একটু কষ্ট হবে। তাতে কি! কষ্টে যখন বুক থেকে ধোয়া বের হবে, তখন হাতগুলো কি করবে? ধোয়াগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে রাখবে। পৃথিবীতে চিরকাল কেউই কাছে থাকে না। এটা জানি। তবুও মন যে মানতে চায় না।আজও সে হয়তো আছে মনের গহীনে, তাই অজান্তেই মনে পড়ে যায় সেই পার্বতীকে।


Post a Comment

Previous Post Next Post