চামড়ার ভাঁজেই আছে গল্প

জাসিন্তা আরেং:   স্বপ্নকে বাস্তবতায় রুপান্তরে ব্যস্ত তরুণেরা। এমতাবস্থায় বয়োজেষ্ঠ্যদের সময় দেয়ার চিত্র যেন রীতিমত অমাবশ্যার রাতে চাঁদ দেখার সমতুল্য। তরুণদের অনুভূতি আজ মরা উনুনসম, সেখানে কি নতুন করে জ্বালবার তাড়না আজও বিদ্যমান? সেই সকল মানুষদের কথা ভাবার অবকাশ কোথায় তাদের?

প্রকৃতপক্ষে, এটা অলীক কোন ঘটনা নয় বরং প্রতীয়মান বর্তমান সমাজের বাস্তবতারই করুণ প্রতিচ্ছবি। তারুণ্যের জোয়ারে গা ভাসাতে গিয়ে তরুণেরা ভুলে গেছে শিকড়বিহীন অস্তিত্বের কথা, হারিয়ে গেছে তাদের অনুভূতির গভীরতা। প্রোথিত শিকড়ের মায়াবী বাঁধন তরুণদের আর কাছে টানে না, উদ্বেলিত করে না তাদের যৌবনের গল্পগুলো। আজকাল কুচকে যাওয়া চোখের দিকে চেয়ে কেউ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখে না। বয়সের ছাপ পড়া চেহারাটায় তাদের অতীত পরিচয় খুঁজে না; ওই খস-খসে হাতখানি দেখে আদরমাখা হাতের স্পর্শ আর মনে পড়ে না। দাঁতের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসা অস্পষ্ট শব্দগুলো তাদের আর আবেগী করে তোলে না। তাদের মলিন ছেড়া শাড়ির আঁচলখানি দেখে আর মনে পড়ে না, সেই আঁচলই ছিল আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ ছায়াস্থল। বলহীন ওই পা দু’খানি দেখে বিশ্বাস হয় না যে, একসময় তারা হেঁটে বেরিয়েছে তপ্ত-বন্ধুর পথে, আজ তাদের পায়ের চিহ্নটুকুও চাপা পড়ে গেছে ধূলোর নিচে। আর তাদের স্মৃতিগুলি বিলীন হয়ে গেছে ঘন কুয়াশার প্রান্তরে। 

চামড়ার ভাঁজেই আছে গল্প


 বর্তমানে গুজো হওয়া দেহখানা কোন একসময়ের কঠোর পরিশ্রমী মানুষ। তারাই তাদের জীবনী দিয়ে লিখে গেছে সেদিনের ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্মের জ্ঞান-বুদ্ধির কাছে তাদের জ্ঞানের পরিধি অুুলনীয়। আজ তারা শিখে গেছে নতুন ইতিহাস খনন করার পদ্ধতি। তাই আজ সেসব মানুষগুলো পরিবার ও সমাজের কাছে ভাঙা কোলার সামিল। আজ তাদের না আছে সুঠাম-মনোমুগ্ধকর রঙ, সুঠাম দেহ-বল, না আছে টগবগে যৌবন; তাদের অনুসরণ করা কি তরুণদের মানায়? নিশ্চয় নয়। কিন্তু এই মানুষেরাই তাদের জ্ঞানের পরিধি, সকল শক্তি-সামর্থ সব পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দিয়েছে। আজ তারা নিস্ব-সর্বহারা, অস্তিত্বহীনতার সঙ্কট যেন তাদের বেঁচে থাকার আশাটুকুও কেড়ে নিচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় তরুণেরা আজ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, আপনজনদের অব্যক্ত আর্তনাদ তারুণ্যের দেয়াল ভেদ করে তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাদের দুরন্ত কৈশোর ও যৌবনদীপ্ত দিনগুলোকে আজ অবাস্তব বলে মনে হয়, তাদের কাছে বসে মূল্যবান সময় ব্যায় করাও যেন অবসাদপূর্ণই বটে। একসময় এই মানুষগুলিই ছিল কারো-কারো সবচেয়ে কাছের, শ্রদ্ধার ও ভালবাসার। কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও বলতে হয় যে, আজ তারা তরুণদের নিত্যদিনের চিন্তাজগতের বাইরে। 

ভাবতেই অবাক লাগে যে, একসময় তাদের মনুষ্যতে¦র লড়ায়ের গল্প শুনেই গুরুজনেরা মানুষ হবার পণ করত, ওই সীমাহীন আকাশে পাখির মতো ডানা মেলার পরও নিজের শিকড়ের টানেই বার-বার ছুটে আসতো। তাদের মুখ থেকে সেকেলে লাজুক কিশোর-কিশোরীর গল্প শোনার জন্য বায়না ধরতো, রসালো সে কাহিনীগুলো ছিলো প্রচলিত কাল্পনিক ও মনগড়া গল্পগুলোর চেয়েও রুচিকর। কতযুগ ধরে যে সেসব গল্পগুলো কচি-কাচাঁর মনের খোরাক যুগিয়েছে, তার হিসেব কতজনই বা রাখে! একালের তরুণেরা সেসব তিক্ত-মধুর বাস্তবতার তোয়াক্কা করে না, আজকাল তাদের মন যোগায় ভিত্তিহীন কিসব কল্পকাহিনী! এ যুগে তরুণেরা আজ তাদের সাথে গল্প তো দূরের কথা, তাদের নিসঙ্গ করে ফেলে রাখে কোন এক ঘরের কোণে। তরুণেরা আজ ভুলে গেছে যে, তাদের সব অতীত জুড়ে রয়েছে সেই মানুষগুলো, যাকে আজ সংসারের বাড়তি বোঝা মনে হয়। যাদের দু’চার কথা শোনার জন্য ক’টা মুহূর্ত প্রতিদিনকার ব্যস্ততার রুটিনে জায়গা হয় না। সংসারের সব দায়িত্বের মাঝে তাদের সময় দেয়াটা অর্থহীন এবং সময়ের অপচয় ছাড়া যেন কিছুই নয়।  

তারা তাদের জীবনের বসন্ত দিয়ে রাঙিয়ে গেছে তারুণ্যের জীবন, তাদের সব আগুন দিয়ে গেছে তাদের দেহে। তাদের সকল অবদানের ফলেই আজ তরুণেরা দীপ্তপ্রাণ ও প্রাণচঞ্চল। আজ তাদের জীবন থেকে নেই বসন্ত, হারিয়ে গেছে সব রঙ, নিভে গেছে সে আগুন; আজ তারা নিরব-নিস্তেজ ও অসহায়। আজ যখন তারা দৃষ্টিহীন, তখন তরুণেরা কি হতে পারে না অন্ধের ষষ্ঠি? আজ যখন তারা শক্তি-সামর্থ্যহীন, তারা কি পারে না নিজের কাঁধে তাদের ভার তুলে নিতে? আজ যখন তাদের দৃষ্টিশক্তি ঘোলাটে, তরুণেরা কি পারে না তাদের চোখ দিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে? এখনো যখন পরিবারের কেউ টিউশনি শেষে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে,  তখন তরুণেরা পারে না এগিয়ে যেতে এক গ্লাস পানি ও পাখা হাতে? যার টিউশনির টাকা উপজীব্য করে চলে তরুণদের লেখাপড়া, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া, বিলাসবহুল জীবন, তার জন্য কি তরুণদের সামান্য কিছু করারও নেই?

সময়ের পরিক্রমায়, ও প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় এ দেশ, সমাজ, মানুষ এবং তাদের মানবিকতা-মানসিকতা, এমনকি তাদের মনটাও বদলে গেছে। গত এক যুগ আগেও অন্ধ এক বৃদ্ধা তার কাছে আসা মানুষটির শার্টের বোতাম খুলে ঘ্রাণ নিয়ে বুঝি নিতো লোকটির পরিচয়। আবার কেউ-কেউ হাত বুলিয়ে চিনে নিতো ভালবাসার মানুষটিকে। কারণ সেদিনকার তরুণদের দেহে ছিল আপনত্বের গন্ধ, মনে ছিল সহস্র জিজ্ঞাসা এবং অনুভূতির গভীরতা। কিন্তু এ যুগের তরুণদের মনে নেই সেই আপনত্বের আকুলতা, আছে শুধু স্বার্থপরতার গন্ধমাখা দেহ-মন। হয়ত সময়ের গহ্বরে হারিয়ে গেছে সে ব্যকুলতা, আধুনিকতার সুবাতাস লেগে বদলে গেছে তাদের অনুভূতি। সময় বুঝি সত্যিই এমনি করে সব বদলে দেয়!

প্রচলিত সমাজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হয়ে গেছে এ যুগের তরুণদের নিত্যসঙ্গী। আজকাল তরুণেরা আধুনিক আবেগ-অনুভূতি দিয়ে মূল্যায়ন করে মানুষগুলোকে এবং অবোধের ন্যায় তাদের গুরুত্ব যাচাই করতে চায় টাকা রোজগারের দাড়িপাল্লায়। এতো অপমান এবং অবহেলাও মানুষগুলোর বেহায়া ভালবাসাকে ঠেকাতে পারে না। তবুও উজার করে দিতে চায় অবশিষ্ট সবকিছু। কাছের মানুষটিকে কাছে পাবার অব্যক্ত আকুতি এবং নিরব কান্নার শব্দ তবু শুনতে পায় না চোখের সামনে থাকা আপনজনটি। প্রত্যাশায় ভরা দু’নয়ন যেন খুঁজে পেতে চায় তাদের আপনজনকে, যার জন্য অপেক্ষা করছে না বলা কথার ঝুলি।

স্বার্থপরতার গন্ডি থেকে বেরিয়ে কেউ এক মুহুর্ত থমকে চিন্তা করি না যে, পুনরায় একদিন ফিরে যেতে হবে সেই চিরচেনা শৈশব-শ্যামলিমায়। সেদিন থাকবে না কোন আধুনিকতা এবং যৌক্তিকতার বলয়। জীবনের পড়ন্তবেলায় এসে তাদেরই মতো তরুণদের দু’চোখে থাকবে শতক জিজ্ঞাসা, আপনজনকে খুঁজে বেড়ানোর সুপ্ত বাসনা। এই মানুষদের অনুরূপই হয়তো পড়ে থাকতে হবে একলা ঘরে, সাথে নিয়ে হাজার বছরের নিসঙ্গতা। কে জানে কার পরিহাস কেমন হবে! 

তবে হঁ্যা, সেদিন শোবার জন্য বিছানা-বালিশ সব থাকবে, শুধু গল্পকথক থাকবে না। সেদিন অবশ্য গল্প বলার জন্য কথকের প্রয়োজনও হবে না। আধুনিকতার সুবাতাসে নিশ্বাস নেয়া তরুণদের জীবন ভরে যাবে হাজারো লাল-নীল গল্পে।

সেদিন কেউ গল্প না শুনলেও ঠিকই অনুভব করবে এই ‘চামড়ার ভাঁজেই আছে গল্প।’ তাই আজ শুধু এতটুকুই বলা সাজে, ‘কতো যে গল্প সে চামড়ার ভাঁজে, পড়ল না তো কেউ।’ 

লেখক

স্টাফ রিপোর্টার

Post a Comment

Previous Post Next Post