জন্ম ও জীবন

রত্না বাড়ৈ হাওলাদার : অমিতাভের লেখাটি খুব মনোযোগের সাথে পড়ছিলাম। হঠাৎ অন্যমনস্ক হওয়ায় ভুল করে অন্য আরেক স্টেশনে নেমে পড়লাম। জায়গাটি বেশ অপরিচিত বলেই মনে হলো। বুঝতে পারলাম এটা আমার স্টেশন নয়। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম পরের ট্রেনটির অপেক্ষায়। ট্রেনটি আসতে আরো পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। সময় তো তার নিজের গতিপথে চলে। কারো অপেক্ষায় বসে থাকে না। দাঁড়িয়ে থেকে গল্পটি পড়ে শেষ করে নিলাম।

পরবর্তী ট্রেনে উঠে গিয়ে নিজের স্টেশনে নেমে কিছুদূর হেঁটে সিগন্যাল পার হতেই চোখে পড়ল অনেক লোকের ভীড়, সাথে রয়েছে পুলিশও। নিজের ভিতরে একটু কৌতুহল সৃষ্টি হলো, দাঁড়িয়ে পড়াম। কারণ লেখালেখি তো রক্তে মিশে আছে, তাই অশ্রদ্ধব্য, দুর্বল কিছু চোখে পড়লে যেন কলম হাতে উঠে আসে। যাই হোক, দাঁড়িয়ে অবলোকন করতে লাগলাম।

জন্ম ও জীবন 

হঠাৎ দেখতে পেলাম- একটি শিশু হয়তো তিন থেকে চার বছর বয়স হবে। পুলিশের স্ট্রেচারে শোয়ানো অবস্থায় রয়েছে। একটুখানি খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছিলাম ছেলেটি জীবিত কিনা। শুনতে পেলাম ‘না’--সে আর এই মর্তে বেঁচে নেই। নির্মমভাবে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কৌতুহলী মন যেন উদ্বিগ্নে শিহরিত করলো আমায়। কিছুতেই জায়গাটিকে ছেড়ে আসতে পারছিলাম না। ভিন্ন-ভিন্ন উপায়ে বিভিন্নজনকে জিজ্ঞেস করছিলাম আসল রহস্য কি! হঠাৎ মৃত শিশুটির এক আত্মীয় আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কি কোন সাংবাদিক কি-না। আসলে আমি কোন সাংবাদিক নই। তবে আমার মনোকামনা, লেখালেখির মধ্যদিয়ে সমাজের নির্মম বাস্তব ঘটনাগুলোকে লিপিবদ্ধ করা, শুধুমাত্র জীবিতদেরকে সতর্কীকরণে।

তিনি শোকে-দুঃখে-ক্ষোভে আমাকে সব ঘটনাগুলো খুলে বলছিলেন। ঘটনাটি শোনামাত্রই শরীরে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম। তিনি বলেই যাচ্ছিলেন---

তার আত্মীয়েরা দুজনেই চাকুরিতে নিযুক্ত ছিল বিধায় শিশুটিকে সেই সময়ে দেখভাল করবার মত ঘরে কেউ ছিল না। কেননা স্থানটি আমেরিকা। ঘরে কোন সাহায্যকারী রাখার চিন্তা যেন অলীক কল্পনার মত। ভাবাই যায় না, সম্ভবও নয়। কারণ ঘন্টায় তাদের বেতন একশত ডলারের উপরে। কারো সাধ্য নেই সংসার চালিয়ে এতো ডলার এই খাতে ব্যয় করবার মত। আর সেই কারণেই নিশ্চয়ই এই দম্পতিকে একজন বেবিসিটারের সাহায্য নিতে হয়েছিল। যে প্রতিকূলতার সম্মুখীন শুধু তারা নয়, অনেকেই এই সমস্যায় জর্জরিত, বিশেষভাবে যাদের ঘরে ছোট সন্তান রয়েছে। এমতাবস্থায় এই বাবা-মাকে ও একইভাবে একজন বেবীসিটারের দায়িত্বে সন্তানকে রেখে তাদের কাজে চলে যেতে হতো। শুনেছি পাশের ঘরের একজন প্রতিবেশির মাধ্যমেই ঐ বেবীসিটারকে ঠিক করা হয়েছিল। মাইনেটাও একটু কমই ছিল। তাছাড়া কাউকেই পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই অবস্থায় হয়তো তার সার্টিফিকেট চেক্ করা, মানুষ হিসেবে যাচাই-বাছাই করা অথবা মদ, গাজার কোন বদভ্যাস আছে কিনা তা দেখার সুযোগ ছিল না। মোটকথা, কোন কিছুরই খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। কারণ আমেরিকা এমন একটি দেশ যেখানে কাজ করতেই হবে, কেননা মাসের শেষে বিল এসে হাজির। কাজেই, ঘরে-বাইরে দুজনকেই সমানভাবে কাজ করতে হয়। কারণ এখানে চাকুরি করলে টাকা, আর না করলে হোমলেস্ (ভিক্ষুক)। তাছাড়া ধার-দেনার ব্যাপারটা একটু প্রতিকূলই বটে। কেউ কাউকে ধারকর্জও দিতে নারাজ। মোটকথা,  দৈনন্দিন জীবন-যাপন ভীষণ দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় দিন কাটছিল। আর এভাবেই সপ্তাহখানেক কেটে গেল। প্রতিদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাবা ছেলেকে ঘরে ফিরে আসে।

প্রতিদিনের মত সেদিনও বাবা ছেলেকে পিক-আপ করবার জন্য বেবীসিটারের বাসায় গেল। কলিং বেল বাজাচ্ছে কিন্তু ভিতর থেকে কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। অন্যদিন বাবা আসার সময় হতেই জানালার ফাঁকে অপেক্ষায় ছেলে হাঁসফাঁস করতে থাকে। বাবার পদধ্বনি শুনতেই ঝড়ের বেগে ছুটে আসে, কিন্তু আজ তার কোন খবর নেই। দরজাটিও খোলা। কিছুই বুঝতে পারছিল না বাবা কি করবে? দরজার ফাঁকা দিয়ে তাকাতেই মনটা খচখচিয়ে উঠল। সে দেখতে পেল একটি শিশুছেলেটি মাটিতে পড়ে আছে। কোন চিন্তা না করেই সে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। চোখ পড়তেই যেন একেবারে আচমকিত হয়ে উঠল এ যে তারই সন্তান। বাবার কাঁধে ছেলের লাশ-এর থেকে বড় কষ্ট পৃথিবীতে আর বোধহয় কিছু হতে পারে না। নিজের আদরের ধন, নয়নের মণিকে এভাবে হাতে ধরে নিশেষ করে ফেলল? বাবার মাথার উপরে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল, নির্বোধের ন্যায় বসে রইল। কি করবে বাসায়, ওর মাকে কল দিবে অথবা পুলিশ কল করবে কোন কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। মাথা একদম কাজ করছিল না, হাত কাঁপছিল। তবে বিপদে সৃষ্টিকর্তাই সাহস যুগিয়ে দেন। তিনি নাইন-ওয়ান-ওয়ান-এ কল করলেন এবং সঙ্গে-সঙ্গে পুলিশ চলে আসল। শিশুটির সমস্ত শরীরে সিগারেট দিয়ে পোড়ানোর দাগ চোখে পড়ছিল।

পুলিশ ভিতরে খোঁজ নিয়ে দেখতে পেল বেবীসিটার চুপ করে কাচুমাচু করে ফ্লোরে বসে আছে এবং বিড়-বিড় করে কিসব বলে যাচ্ছে। পুলিশ এতোটুকু দেরী না করে তাকে গ্রেফতার করে, জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে আপন মনে বলতে থাকে যে, আমি প্লে করেছি। আমি তো ওকে খালি গায়ে স্নো-র মধ্যে বাহিরে দুই ঘণ্টা বেঁধে রেখেছিলাম। কাঁদতে দিইনি মুখে কাপড় বেঁধে দিয়েছিলাম। তারপর ঘরে ঢুকিয়ে ওর শরীর সিগারেট দিয়ে পুড়িয়েছি। জান, তখনও একটুও কাঁদেনি। কি করে কাঁদবে? তখন তো দেহে ওর প্রাণই ছিল না। ফুটফুটে শিশুটির এমন নির্মম মৃত্যু প্রতিটি মানুষকে কাঁদিয়ে ছিল।

পুলিশ বেবীসিটারকে ধরে নিয়ে গেল বটে। হয়তো লকাপে রাখবে। তবে মানসিক রোগী হওয়ার কারণে তার শাস্তি অনেকটা শিথিল হয়ে যাবে যা অহরহ হয়ে থাকে। কারণ এখানে মানসিক ভারসাম্য হারানো মানুষগুলোই নাকি এসব হত্যাকাÐ করে থাকে। এদিকে ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণে বাবা-মা শোকাহত অবস্থায় অজ্ঞান ও স্থবির হয়ে পড়ে আছে। একটি সুখী পরিবার যেন ভেঙ্গে খান-খান হয়ে গেল। গোটা জীবন দুঃখভারে জর্জরিত হয়ে রইল। যা আর কোনদিন শুধরানো সম্ভব নয়। প্রতি পলকেই ছেলের স্মৃতিবিজড়িত অ¤ø-মধুর স্মৃতিগুলো যেন তাদের তন্ত্রীগুলোকে তচনচ করে বিকলাঙ্গ করে ফেলছে। কিছু করার নেই। কেননা বিধির বিধান না যায় খÐন।

যাই হোক, আমিও এক বুক কষ্ট নিয়ে ঘরে ফিরে আসলাম। ফ্রেস হয়ে, রিলাক্স মুডে সোফাতে শুয়ে ফোন চাপছিলাম। মনটাকে কিছু সময় অন্যমনস্ক রাখার জন্য। কিন্তু আবার আরেক আজব কাÐ। হঠাৎ দেখতে পেলাম মেসেঞ্জারে একটি ক্লিক হল। চেক্ করে দেখতেই একটি ভিডিয়ো চোখে পড়ল। উৎসাহিত হয়ে ভিডিয়োটি খুললাম। সাধারণত এসব ভিডিয়ো দেখার ইচ্ছা আমাকে কখনই তাড়া করে না। কিন্তু এখানেও এক আজগুবি ঘটনা। তবে আজগুবি হলেও একেবারে সত্যি ঘটনা। এক সাংবাদিক দম্পতি একটি ঘটনাকে উদ্ঘাটন অনুসন্ধান করতে নিজস্ব গাড়িতে ঈশ্বরদি যাচ্ছিলেন, যা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল, যেখানে এখনো আধুনিকতা স্পর্শ করতে পারেনি। সেখানে তিনতলার একটি পুকুর আছে। বলতে হবে জায়গাটি এখন সে নামেই পরিচিত। 

যাই হোক, কেউ একজন তাদেরকে সংবাদটি পৌঁছে দিয়েছে। খবরটি পেয়ে তাদের মধ্যেও কিউরিসিটি ভীষণভাবে কাজ করছিল। আর সেকারণেই যতো দ্রæতসম্ভব ঠিকানামাফিক সেখানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। মনে হচ্ছিল যেন একটি এডভেঞ্চার। আসলে প্রকৃত রাস্তা না চিনলে যা হয়। বিব্রতকর পরিস্থিতির স্বীকার। যেন যখন যাকে সম্মুখে পাচ্ছে, তাকেই জিজ্ঞেস করছিল। বলতে গেলে একটি অন্যরকমের সাক্ষাৎকার। বিভিন্ন জন ভিন্ন-ভিন্নভাবে তাদের অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করছিল। কেউ-কেউ আবার তাদের দীর্ঘ বারো বছরের অভিজ্ঞতা সহাভাগিতা করছিল। কেউ-কেউ আবার বলছিল তাদের অনুভূতির কথা। “পানির ভিতরে নামতেই যেন নিছক বালুমাটি, আরো অনুভূত হয় শুধু চুলের সমারোহ, যা নাকি একজন মানুষকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে যায়।”

কাছাকাছি যেতেই চোখে পড়ল তিনতলার একটি বিল্ডিং জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। অনুভ‚তিটা এমন ছিল যেন সেটা একটি ভৌতিক বাড়ি। একটু সম্মুখে আগাতেই সেই ভয়াবহ পুকুরটি যেখানে প্রতি বছর কাউকে না কাউকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে, বিশেষভাবে শিশুদেরকে। শুনেছি সদ্য বিবাহিত নব-বধুর প্রাণহানিও ঘটেছে বিগত দিনে ।

সকলের কথা শুনে মনের মধ্যে কেমন একটা প্যাচ লাগছে। একটু নিকটে যেতেই দেখা যায়, পুকুরটি চতুর্দিকে খানিকটা উঁচু করে বেড়ার মাধ্যমে ঘের দিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা। যেন কেউ কখনো সরাসরি গিয়ে পুকুরপাড়ে বসতে না পারে অথবা পুকুরঘাটে যেন কোন কাজ-কর্ম করতে না পারে। যাই হোক, অনেকেরই নিকট অনেক ঘটনা শোনার পরে সাংবাদিক দম্পতি প্রমাণ করতে চাইলেন, সত্যিই কি কাল্পনিক গল্পের সেই জুজু-বুড়ির খোঁজ পাওয়া যায় কিনা। আরেকটি কথা না বললেই নয়, ওখানের বয়স্ক লোকজনেরা বলছিলেন, “পূর্বে নাকি ওই পুকুরে হিন্দুসম্প্রদায়ের দেবী বিসর্জন দেয়া হতো”।

যা হোক, যেই কথা সেই কাজ, সাংবাদিক দম্পতিরা প্রমাণ করবে বলে তাদের সেই অত্যাধুনিক ক্যামেরাটি “গোপ” যেটি পানিতে ডুবিয়ে দিয়েও ভিডিয়ো করা সম্ভব। স্বচ্ছ-স্পষ্ট পিকচার প্রচারে কোন অসুবিধা হয় না। সেই অত্যাধুনিক ক্যামেরাটি পানিতে ডুবানো হলে, প্রথমবারে শুধু কিছুটা ময়লা দেখা গেল। দ্বিতীয়বার পুনরায় ক্যামেরাটি ডুবাতেই দেখা গেল সেই আলোচিত বিস্ময়কর, চুল যে চুলের গল্প লোকদের মুখে বহুবার শুনে আসছিল। সত্যিই তো তাই ! অত্যাধুনিক ক্যামেরাটি সেই চুলকে আবিষ্কার করতে পারলো। যা তাদের নিজের কাছে তথা অন্য সকলের কাছে সত্য বলে প্রমাণিত হলো। একটু ভীতসন্ত্রস্ত বলেও মনে হলো এই সাংবাদিক দম্পতিদ্বয়কে।

ভাবতে অবাক লাগে, এই ডিজিটাল যুগে এসেও অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মনে পড়ছিল নানী-দাদীদের মুখে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত রূপকথার গল্পকাহিনী। যা আজও সত্য প্রমাণিত হয়ে ধরা দেয় অত্যাধুনিক ক্যামেরায়। একটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র একদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে, সমাজের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার প্রচেষ্টা মাত্র।


[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]


Post a Comment

Previous Post Next Post