বিজয়ের চেতনা থাকুক প্রজন্ম জুড়ে

জাসিন্তা আরেং : একাত্তরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে বাঙালির বিজয় ঐতিহাসিক এক ঘটনা যার তাৎপর্য একমাত্র বাঙালিরাই উপলব্ধি করতে পারে। এ বিজয় শুধুমাত্র বাঙালির আত্মগৌরব ও দেশমাতৃকতার বিজয় নয়; এ বিজয় দাসত্বের শিকল ভেঙে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার বিজয়। বিজয়ের চেতনা বাঙালি জাতিকে পুনর্জন্ম দিয়েছিল, অসীম সাহসে উদ্দীপ্ত করেছিল তগবগে যুবকদের; উদ্যমী ও দুর্বার করেছিল বাংলার মায়েদের সহজ-সরল ছেলেদের। যে উদ্দীপ্ত চেতনা নিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা নিজের দেশ ও মাটির টানে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নিজের রক্ত দিয়ে দেশের মাটিকে লাল আবীরে রাঙিয়ে ছিল যারা; তারা আজও সকলকে অনুপ্রাণিত করে দেশ, মাটি ও মানুষকে ভালবাসার গভীরতাকে বুঝতে ও ভালবাসতে। দেশের প্রতি তাদের অসীম শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করলে বিনম্রতায় অচিরেই মাথা নত হয়ে আসে। এই বিজয় পৃথিবীর মানচিত্রে শুধু বাংলাদেশকে জন্ম দেয়নি, জন্ম দিয়েছে লাখো বাঙালি প্রজন্মের; যারা দাসত্ব ও অত্যাচার-অনাচার, শোষণ-বঞ্ছনার সাথে আপোষ করে না। নিজেদের সঁপে দেয় না শাসক নামক শোষকদের নিকট। জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যাশা করে যেন বর্তমান প্রজন্ম সেই বিজয়ের চেতনা বুকে ধারণ করে দুর্বার এগিয়ে যায় এবং দেশ ও মাটির সুরক্ষার্থে আত্মদান করতেও যেন পিছু পা না হয়। 

বিজয়ের চেতনা থাকুক প্রজন্ম জুড়ে


অন্যদিকে, আজকাল বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে বাহারি নকশা ও লাল-সবুজের পোশাকে-আশাকে নিজেদের সাজিয়ে তুলতে দেখা যায় বর্তমান প্রজন্মেকে। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ ও চেতনা যেন শুধু লাল-সবুজ পোশাক-আশাক পড়া বা ফ্যাশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং আমরা যেন লাল-সবুজের প্রত্যয় নিয়ে বাঙালির রক্তক্ষয়ী ইতিহাসকে সগৌরবে প্রকাশ করি ও বিশ্বের কাছে তুলে ধরি। বিজয়ের চেতনা যেন অনুরণিত হয় যুগ-যুগ ধরে। মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য এবং বিজয়ের মাহাত্ম্যকে বুঝতে ও উপলব্ধি করতে হবে এবং আগামী প্রজন্মকেও সে সম্পর্কে সরেজমিন অবগত করতে হবে।  

বর্তমানে দেশে নৈরাজ্য, ধর্ষণ, হত্যা, অন্যায়-অত্যাচার ও দুর্বলের ওপর সবলের শোষণ কোনক্রমেই থেমে নেই। তাছাড়া, গণতন্ত্র, ক্ষমতা ও স্বার্থদ্বন্দ্বের লড়াই চলছে রীতিমত। এমনকি বৈরিতা-বিদ্বেষ, এবং ঝগড়া-বিবাদ থেমে নেই পরিবারেও। সমাজ ও রাষ্ট্রে একরকম অস্থিরতা বিরাজ করছে প্রতিনিয়ত। যা বিজয়ের চেতনাকে ধীরে-ধীরে ম্লান করছে। তাই স্থিতিশীলতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এবং ধর্ম-বর্ণ-কাল নির্বিশেষে জাতি-গোষ্ঠিীর মাঝে সম্প্রীতি আনয়নে প্রয়োজন বিজয়ের চেতনাকে ধারণ করা ও বিজয়ের মর্মকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা। একাত্তরের বিজয় শুধু স্বাধীনতা বিরোধী ও শত্রুদের বিরুদ্ধে ছিল না, সে বিজয় ছিল অন্যায্যতা, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। লাখো মা-বোনের সম্ভ্রম দিয়ে এই বিজয় অর্জিত হয়েছে। তাই এই অর্জন যেন কোনভাবেই বৃথা না যায়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আপন স্বার্থসিদ্ধির বিষয়ে না ভেবে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে বসবাস করাই আমাদের ধর্ম হওয়া উচিত। পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে, সমাজের এক শ্রেণির লোকেরা লোভের বশে বা বিভ্রান্ত হয়ে বিপথে চলছে ও দেশের সুনাম নষ্ট করছে এবং দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের মধ্যে বিজয়ের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে এবং সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। যেন বিজয়ের ঐতিহাসিক গৌরব একালের প্রজন্ম তাদের অনৈতিক কর্ম দ্বারা ক্ষুন্ন না করে। মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণা না দিয়ে সন্তানদের যথাযথ জ্ঞানদান করতে হবে ছোটবেলা থেকেই। যেন এই অর্জন কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তারা অনুধ্যান করতে শেখে। সেক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সম্ভাবনাময় প্রজন্মের হৃদয় জুড়ে থাকুক বিজয়ের চেতনা, শহর থেকে প্রান্তিক পর্যায়েও বিজয়ের চেতনা জাগ্রত করুক অনুপ্রেরণা। এদেশের সকল নাগরিক বিজয়ের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে সর্বদা তৎপর থাকুক এটাই একান্ত কাম্য। পরিশেষে, এদেশের বাঙালিরা মুখে বিজয়ের শ্লোগান ও বুকে এর চেতনা নিয়ে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে পৃথিবীর বুকে। আজ বাংলাদেশ নামে সেই ক্ষুদ্র ভূ-খণ্ড কম-বেশি সকলের কাছেই পরিচিত। কাজেই, ৪৯তম বিজয় দিবসের ন্যায় আরও সহস্র বছর সবুজের বুকে লাল বৃত্তে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া লাখো শহীদের চেতনা এমনিভাবেই চিরজাগ্রত ও চিরঅম্লান থাকুক এটাই প্রত্যাশা।


[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]

Post a Comment

Previous Post Next Post