চাবিটা নিজের হাতেই

রত্না বাড়ৈ হাওলাদার : বিচিত্র পৃথিবীর বৈচিত্র্যতা মানবজাতিকে করে রহস্যাবৃত্ত। শ্রেষ্ঠ জীবের আচরণবিধি মাঝে-মধ্যেই ভীষণ ভাবিয়ে তোলে সৃষ্টিকর্তা বলে আদৌ কেউ আছে কি না? কেননা জগৎ সংসার থেকে ভয়, শালিনতাবোধ, মান-সম্মান সব কিছুই বিলুপ্তির পথে। আর এগুলো হচ্ছে সব-ই ধরাতলের তাণ্ডবকে ঘিরে। কাজেই মাঝে-মধ্যেই মনে হয়, “ভাগ্যিস সৃষ্টিকর্তা জন্ম-মৃত্যুর চাবিটা নিজের হাতে রেখে দিয়েছিলেন বিধায় রক্ষা”! নচেৎ কি জানি মানুষের মাংস মানুষই ভক্ষণ করতো কি না---হাল-চাল তথা বিকৃত চিবোধ এমনটিই প্রকাশ করে। তাছাড়া, কলির কাল বলে কথা।

চাবিটা নিজের হাতেই


যাই হোক, সেকালে প্রায়শই শোনা বা দেখা যেত স্বামী পরিত্যাক্তা নারী। কিন্তু একালে এই কলির কালে সব উল্টো, স্ত্রী পরিত্যাগ করছে স্বামীকে। স্ত্রী পরিত্যক্ত। বর্তমানের নারীরা কতটা সাহসী ভাবনার উর্ধ্বে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পাগলামো দেখতে হচ্ছে মেয়ে মানুষগুলোর। অবশ্য, সৃষ্টিকর্তা তো পুরুষ জাতিকে আদম থেকেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে রেখেছেন। পরিবারে তো বটেই তথা সমাজেও। কিন্তু লাভ কি হলো তাতে? হবা তো আদমের মন ভুলিয়ে জীবনবৃক্ষের ফল খেতে বাধ্যই করল। যুগ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাই দলটির কাছে হার মানতেই হলো। একান্তই ড্যামকেয়ার ভাব। তাই হয়তো ধরাকে সরাজ্ঞান করতেও এতোটুকু দ্বিধাবোধও করেনি। বুদ্ধির বিকাশ বলে কথা, তাই না!  মাঝে-মধ্যে মনে হয় ঐ যুগের সখিনা বিবিরাই বোধহয় ভালো ছিল। ঘরে বসে শুধু রান্না-বান্না ব্যাতিরেকে অন্য কোনো চিন্তা-ভাবনার লেশমাত্র ছিল না। স্বামী-ভগবানের খেদমত তথা খেতে দিয়ে পাশে বসে বাতাস করা। এবং সেসময়ে দুই-চারখানা কথা হতো এই। নচেৎ দিনভর কোন সাক্ষাতের বালাই ছিল না। তারপরও ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না। ভালবাসা যেন হৃদয়জুড়ে দোল খেতো। আর সেই অন্তরের গভীর ভালবাসার ফসল ডজনখানেক সোনার সন্তান যেন যাচাই-বাছাই করতো। বড্ড কঠিন ব্যাপার ছিল। ওদের নাম মনে রাখাও কঠিন ছিল। উহ!। বিস্বাদ একটি ভাবনা।

কিন্তু এই শিক্ষিত যুগের ধরন একটু অন্যরকম কায়দায়, আলাদা রকমের। উদাহরণস্বরূপ, শুধু চাকুরি ব্যাতীত, অন্য সময়ে স্বামীরা যেন গিন্নির পাশাপাশি থাকছে। ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করা, সন্তানদের যত্ন নেওয়া থেকে শুরু করে পাকের ঘর পর্যন্ত সামলানো; সবই সমান তালে স্বামীরা স্ত্রীর সাথে করে যাচ্ছে। তারা দুই অথবা তিনটি সন্তানের জনক/জননী। এখানে শিক্ষা ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ রয়েছে লাখো। আসলে পৃথিবীটা বড্ড বৈচিত্র্যময়। তবে জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত খুবই মূল্যবান। “যেমন গতকাল ইতিহাস, আগামী কাল অজানা এবং শুধু দৈনন্দিন উপহারমাত্র”। আর এর মধ্যে জীবন সংগ্রাম পরিষদের কতো কল-বিবাদ। সত্য মিথ্যার দৈন্যদশা। এই জীবন তরীর স্বাদ-বিস্বাদের জগাখিচুড়ি। অনেক সময় ভাগ্যকে দোষী সাব্যস্ত করে জীবনের এপিঠ-ওপিঠ মূল্যায়ন করা হয় যা নিতান্তই ভুল। ভাগ্য কারো হাতে নেই। তবে সিদ্ধান্ত সবার হাতের মুঠোয়। ভাগ্য সিদ্ধান্ত নেয় না বরং একজন ব্যক্তির সিদ্ধান্তেই ভাগ্যের বা কপালের দ্বার খুলে যায়।

জীবনটা কিছুটা বইয়ের পাতার মতো। কোন পাতায় কি লেখা আছে, কেউ-ই তা জানে না। তা হতে পারে কখনো সুখের আবার কখনো বেদনার। পৃষ্ঠা না উল্টোলে যেমন কোনভাবে জানা সম্ভব নয় অপর পৃষ্ঠায় কি লেখা আছে, তেমনি কাজ না করতে তার ফল পাওয়া যায় না। কাজেই, এগিয়ে যেতেই হবে। খ্রিস্টধর্মে পবিত্র বাইবেলে স্পষ্ট লেখা আছে। “যাচনা কর তোমাদের দেয়া হবে, অন্বেষণ কর পাবে। দ্বারে আঘাত কর, তোমাদের জন্য দ্বার খুলে দেওয়াই হবে।”

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটি যেখানে এত বেশি মধুর হওয়ার কথা, সেথায় ভেঙ্গে যাচ্ছে তাদের ঘর বিভিন্ন প্রতিকূলতার অজুহাতে। কেননা আজকাল তুরিধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয় বেশি। কারণ শয়তানের মতলব অমৃতের স্বাদে অঙ্কুরিত হচ্ছে। বিবর্ণ বিষাদের আসক্তি যেন অন্য রকম শক্তি সঞ্চারিত করছে। দশ মাস দশ দিন গর্ভেধারণ করে যে রত্নকে জগত দেখালো দশভুজা মা জননী? করুণ সুরে বলতে হয় যে, সেই রত্নকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, সন্তানের মায়া-মমতা ভালোবাসা পরিত্যাগ করে, উপেক্ষা ও বঞ্চিত করে তারা তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হাত ধরে চলে যায়। তারা বিশ্ব পরিমণ্ডলের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে উপভোগ্য ও অপবিত্র মধুর নীড় গড়ার লক্ষ্যে চলে যায় পরকীয়ার আস্বাদনে। মা নামের কলঙ্ক এক মায়াবী রাক্ষসী মূর্তি ধারণ করে তাদের জন্য।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, একটি স্বার্থপর, বিকৃত রুচিসম্পন্ন সন্তানের অবাধ্যতা ও কৃতকর্মের কারণে নিরীহ বাবা-মায়েরা সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। বার্ধক্যে এসে নারকীয় যন্ত্রণা সহ্য করায় তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আর তখন চরম এবং কঠিন মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে বিভিন্নভাবে অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কেননা শরীর এবং মন একে অপরের পরিপূরক এবং ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট। সেকারণেই ডায়াবেটিস রোগটি বাসা বেঁধেছে শরীরে। বিশেষভাবে, ডায়াবেটিসের ফলে শরীরে নানাবিধ সমস্যা যেমন হার্ট, কিডনি, চোখ, দাঁত ইত্যাদি সব কিছু অক্ষম হতে বসেছে। ডাক্তারগণ বলেন, বিভিন্ন ব্যায়ামের মাধ্যমে সুস্থ থাকা সম্ভব। তবে বয়স কাউকে ক্ষমা করে না। তাছাড়া, ডায়াবেটিস রোগটি বয়সের সীমানাটা দ্রুত অতিক্রম করে। আসলে, যতই ব্যায়াম তথা ডায়টিং করা হোক না কেন কোন লাভ হয় না। কেননা মানসিক চিন্তা যেকোন রোগটি থেকেও ভয়ঙ্কর। একমাত্র মানসিক চিন্তা সুগারকে ধাই-ধাই করে বাড়িয়ে দেয়। কথায় বলে, চিন্তা যেকোন রোগের থেকেও মারাত্মক রোগ আর কিছুই হতে পারে না। এই  রোগের কোন ঔষধ নেই। বঞ্চিত করে জীবনের স্বপ্ন, স্বাদ, ভূত-ভবিষ্যত। এমন কি চলার পথের পাথেয়কেও নষ্ট করে দেয়। তাইতো অন্তর জ্বালায় ধুকে-ধুকে একদিন চলে যেতে হয় পরপারে। সাত রাজার ধন প্রাণপ্রিয় আদরের মানিক রতনদের কারণে।  যেখান থেকে কেউ আর কখনো ফিরে আসে না।

পিছনভাগে যারা রয়ে যায়, বিবেকের দংশনের জ্বালা তাদেরই আকঁড়ে ধরে, কুঁড়ে-কুঁড়ে খায়। তাড়া করে বেড়ায় জীবনভর এই নশ্বর ভুবনে। চেতনার বলয়ে অনুশোচনায় নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারলেও শুধরে নেয়ার আর কোন পথ থাকে না। দিবাস্বপ্ন, দিনের বেলা যে স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্নটি মনের মধ্যে জীবিত থাকে। জীবন যেন তারই সাদৃশ্য বনে যায়। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন অংকের নাম হলো “জীবন, যেখানে অংকের পরে সূত্র তৈরি হয়। আর তাই সে সূত্রটি যেন না হয় মর্তের বরং তা যেন হয় ওপারের, পরকালের চাবিকাঠি ।


[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]

Post a Comment

Previous Post Next Post