জীবন ও সমাজ ডেস্ক : বড়দিন হলো খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের সবচেয় বড় একটি উৎসব। এদিনের মূল ভূমিকা হলো ঈশ্বর মানুষ হয়ে পৃথিবীতে এলেন যাতে মানুষ পাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন। বড় হওয়ার দিন। মানুষে-মানুষে মিলনের দিন। ভেদাভেদ ভুলে একাত্ম হওয়ার দিন। আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সমগ্র বিশ্বের দেশগুলোতে পালন করা হয় বড়দিন। অর্থাৎ যীশুর জন্মদিন। এই উৎসব পালনের ধরণ সব দেশে সমান থাকে না। মূল আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠান ভাষা ব্যতিত পুরোপুরো একই নিয়মে পরিচালিত হয়ে থাকলেও বাহ্যিক অনুষ্ঠানে কৃষ্টি অনুসারে থাকে ভিন্নতা। এবার জীবন ও সমাজ অনলাইন ম্যাগাজিনের প্রচেষ্টায় ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মাঝে খ্রীষ্ট জন্মোৎসব উদযাপন কিভাবে পালন করা হয়। আর এর জন্য খাগড়াছড়ির ধর্মপল্লীর কাথলিক ধর্মযাজক ফাদার রবার্ট গনসালভেছ -এর সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মাঝে খ্রীষ্ট জন্মোৎসব উদযাপন। চলুন দেখে আসি তার সাথে সাক্ষাৎকার।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মাঝে খ্রীষ্ট জন্মোৎসব উদযাপন |
উৎসব হিসেবে বড়দিনকে আদিবাসী ধর্মালম্বীরা কিভাবে উদযাপন করে এবং বড়দিনকেন্দ্রীক কি ধরনের আয়োজন করে থাকে।
পাড়ায়-পাড়ায় কীর্তন, দলে-দলে চক্রাকারে নাচ-গান করে প্রভু যীশুর মর্তে আগমনের আনন্দ উৎসব ও উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে খ্রীষ্টীয় বিশ্বাসকে নবায়ন, ঝালাই ও চাঙ্গা করে নেওয়ার মোক্ষম সময় হিসেবে গ্রহণ করে। মফস্বলভিত্তিক খাগড়াছড়ি কাথালিক মন্ডলীর উপাসক ও ভক্তজনগণ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বড়দিন উৎসবকে বাৎসরিক পালনীয় পর্ব হিসেবে গ্রহণ করে। পারিবারিক প্রার্থনা, গির্জায় খ্রীষ্টযাগে অংশগ্রহণ করে বড়দিন পালন করে। আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ, বিশ্বাসে বলীয়ান ও মহীয়ান হয়ে খ্রীষ্টসমাজ গঠন করে নতুন আঙ্গিকে নতুন পরশে ভালোবাসায় প্রলুব্ধ হয়ে অন্তরে লালন-পালন করে ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় মনোভাব সৃষ্টি করে সহজ-সরল ও সাধারণ জীবনধারণের মধ্যদিয়ে খ্রীষ্ট বিশ্বাসের আনন্দ ও শান্তি অনুভব, উপলব্ধি দিয়ে অন্তর আত্মায় ত্রাণকর্তা যীশুকে স্থান দেয়।
বড়দিন সমাসন্ন এ সময়ে ফসলের ধান কাটা ও ছাটাই-মাড়াই শেষে ঘরে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার ঢালী সাজিয়ে নবান্ন উৎসব করে ও যীশুর আগমন প্রতীক্ষায় জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সুউচ্চ পাহাড় বসতিতে বড়দিনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে, লেপা, মোছা কাজ চলছে। পাড়ায়-পাড়ায় রঙিন কাগজে বড় তারা তৈরি করে বসতবাড়ীর আঙ্গিনায় টাঙ্গিয়ে দিয়ে আগমনী বার্তা ঘোষণা করে এবং পাহাড়ের বাঁশ, ছন ও লতাপাতা দিয়ে গোশালা সাজিয়ে নবজাতক শিশু যীশুকে প্রণাম ও সবাইকে হোচ্পানা অর্থাৎ শুভেচ্ছা জানানো হয়। এরা তাদের চাকমা ভাষায় শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে “বেক্কুনেরে মর হোচ্পানা জানাঙ্গর”।
এদিকে বড়দিন উপলক্ষে রান্নার কাজে জড় হয়ে সকল গাবুরী ও গাবুজ্জা অর্থাৎ নারী-পুরুষ এক সাথে সকাল বেলা হতে বইন্যা শুকরের মাংস, মুরগির মাংস, মাছ ও বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি দিয়ে ঘন্ড বা পাচন তৈরি করে একসাথে পাড়া-প্রতিবেশী আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে দুপুরের খাবার পরিবেশন করে। বড়দিন উপলক্ষে সামাজিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকার ঐত্যিহ্যবাহী সরবত প্রস্তুত করে, তার মধ্যে উল্লেখ্য একচোয়ানী, দোচোয়ানী, বজা চাউল দিয়ে কাঞ্জি ও বিন্নি চাউল ও মুলি মিশিয়ে মাটির কলসীতে সংরক্ষণ করে জগরা তৈরি করে আনন্দ উৎসব ও সামাজিক মিলনবন্ধনে মেতে ওঠে। মনের শান্তি, উৎসাহ আনন্দ নিয়ে বড়দিনের দিবা-রাত্র উদযাপন করে। বড়দিনের সাজসজ্জা ও পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারে মেয়েরা খাদি, পিনুন, ব্লাউজ, কামিজ তৈরি করে লুুলি পায়ে পড়ে, আজুলী গলায় পড়ে এবং হারুহাতে পড়ে দোল মিলা অর্থাৎ সুন্দরী পাহাড়ী ললনা সেজে আমোদ ফূর্তি করে, অপরদিকে, যুবকেরা নতুন লুঙ্গি প্যান্ট শার্ট পড়ে বড়দিনের আনন্দ প্রকাশ করে।
বড়দিনের সময় শাক-সবজি যথাক্রমেঃ মুলা, বেগুন, খর বেগুন, কপি, পেঁপে, কলা, আলু, মিষ্টি কুমড়া, সীম, কচু, কাঁচা মরিচ, ছুরি শুটকি, হাঙ্গর শুটকি ও নাপ্পি মিশিয়ে দিয়ে ঘন্ড বা পাচন কমপক্ষে ২২ পদ দিয়ে রান্না করে। বড়দিনের শীতের কনকনে ঠান্ডায় বরা পিঠা, সান্নি পিঠা, সামু পিঠা, কলা পিঠা, বেঙ্গ পিঠা, মগা পিঠা ও ভক্তি পিঠাসহ রকমারী পিঠা পসার সাজিয়ে একসাথে গরম-গরম পিঠা খেয়ে আনন্দ প্রকাশ করে ও বড়দিন উৎসবের দিনে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকে। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা সঙ্গত যে, বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়ন গতিধারায় শহর এলাকায় পাহাড়ী খ্রীষ্টীয় সমাজে কেক কেটে বড়দিনের প্রেমপূর্ণ মিলনোৎসব করা হয়, সান্তাক্লসের টুপি পড়ে মিষ্টি জিলাপি, রসগোল্লা ও লজেন্স বিতরণ করে পরিবারের সবাই ও শিশুরা একসাথে উৎসব হিসেবে বড়দিন উৎসব পাহাড়ী খ্রীষ্টভক্ত জনমন্ডলী ভক্তি, শ্রদ্ধা ও হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে পালন করে।
আদিবাসী কৃষ্টি অনুসারে বড়দিনের মাহাত্ম্য কি? আদিবাসী পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদের খ্রীষ্ট জন্মোৎসব সম্পর্কে কি শিক্ষাদান করেন।
ঐশসংবাদ পবিত্র বাইবেলের বাণী আত্মস্ত করা ও অন্তর গভীরে স্থান দিয়ে পাহাড়ী আদিবাসী খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে তা টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী করে তুলতে প্রতিবছর বড়দিন উৎসব তাদের সামর্থ অনুসারে পালন করে থাকে। ঈশ্বরের ভালোবাসার বাক্য এখন মাংসে রূপান্তরিত হল এবং দেহ গ্রহণের দ্বারা মানব সমাজে অর্থাৎ আমাদের মধ্যে বাস করলেন। নতুন ভাবধারা ও গতিধারা সৃষ্টি করতে খ্রীষ্ট প্রভু যীশু ক্ষুদ্র গোশালায় ঐশরিক কৃপায় পবিত্র পরিবার গঠন করে। বিপদে-আপদে, দুঃখ-যন্ত্রণা ও নানা প্রতিবন্ধকতা, হয়রানি, হুমকি ও পাশবিকতা জয় করে গোশালাকে আকাশের তারায় উজ্জল করে যীশু জন্ম নিলেন। পশুত্বের ক্রুদ্ধভাব পরিহার করে মানবতা ও মনুষত্বের পরিচয়, শান্তির বাণী পরিধান করে ও দিব্য আশীর্বাদে পরিপুষ্ট হয়ে বড়দিন পাহাড়ী পার্বত্য বনভূমিতে দিন-দিন প্রসার লাভ করছে। একদা নব্বই দশকে পাহাড়ে খ্রীষ্টান বসতি গড়ে তুলতে কষ্টকর বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে বাণীপ্রচারে ও প্রসারে অগ্রযাত্রায় পাহাড়ীদের মধ্যে খ্রীষ্টধর্ম কালক্রমে সমাদৃত ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো এবং পাড়ায়-পাড়ায় খ্রীষ্টধর্মের বিশ্বাসীদের উপস্থিতি, পরিচয় ও অস্তিত্ব সবার কাছে সহনীয় ও গ্রহণযোগ্য হতে শুরু করেছে। খ্রীষ্টমন্ডলীর অগ্রযাত্রায় সহজ-সরল ও সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত পাহাড়ী খ্রীষ্টভক্তগণ খ্রীষ্টান হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। খ্রীষ্টীয় উপাসনা, প্রার্থনা ও গান ধীরে-ধীরে রপ্ত করা আরম্ভ করেছে। নতুনভাবে খ্রীষ্টবাণী অন্তরে ধারণ, খ্রীষ্টসমাজ নতুন ভাবধারায়, খ্রীষ্টিয় বিশ্বাসে জীবন যাপন, রীতি-নীতি, পর্ব পালন, সাক্রামেন্তিয় কাজ, পরিবার গঠন, সাধু-সাধ্বীর পর্ব পালন ও মা মারীয়ার প্রতি ভক্তি নিবেদন ও তীর্থে অংশগ্রহণের আশা-আকাঙ্খা ও প্রত্যাশা দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ও কাথলিক খ্রীষ্টমন্ডলীতে যাজক ও ব্রতধারিনী সিস্টারদের সাথে ধর্মীয় পালকীয় কাজে দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা বুঝতে শুরু করেছে।
প্রতিটি পাড়ায় বড়দিন উদযাপন করা ও বিভিন্ন সামাজিক প্রস্তুতি গ্রহণে শিশুরা আনন্দ ও উৎসাহ পায়। পিতা-মাতা শিশুদের যথাসম্ভব খ্রীষ্টধর্ম ও মৌলিক প্রার্থনা শিখিয়ে দেয়, পাড়ার মাস্টার শিশুদের বড়দিনের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য বুঝিয়ে দিচ্ছে। পবিত্র শিশুমঙ্গলের কার্যক্রমের মধ্যে ধর্মশিক্ষা নাচ, গান, বাইবেল কুইজ ও চিত্রাংকনের ব্যবস্থা করে এদের রুচিশীল, সৃজনশীল কাজে অনুশীলনের সুযোগ করে দিচ্ছে। অবহেলিত সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র পাহাড়ী শিশুদল খ্রীষ্টবিশ্বাসে বৃদ্ধি পেয়ে খ্রীষ্ট নেতৃত্ব, খ্রীষ্ট গঠন ও খ্রীষ্ট উপাসনায় সক্ষমতায় বৃদ্ধি পেয়ে সচেতন, জাগ্রত ও মানসম্পন্ন খ্রীষ্টসমাজ, পরিবেশ ও প্রতিবেশ গড়ে তোলে বড়দিন আরো উজ্জ্বল আলোয় ভরে তুলবে, এটাই একান্ত কাম্য। এখানে বড়দিন আসলে পিতা-মাতা ও মুরব্বীগণ তাদের কণ্ঠে সুমধুর গান গোশালার সামনে গেয়ে উঠে “গোয়াল ঘরে যীশুর জন্ম গিয়ে দেখোরে, তারার নীচে যীশুর জন্ম গিয়ে দেখোরে। ”
আদিবাসীদের নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি বড়দিনকেন্দ্রিক আয়োজনকে অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা করবে এটাই স্বাভাবিক কেন এবং কিভাবে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি সর্বজননীন উৎসবকে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত কি?
সত্যিকার অর্থে, খ্রীষ্ট জন্মের বারতা নিয়ে বড়দিন উৎসব পাহাড়ী খ্রীষ্টীয় জনপদে পালিত হয়। প্রভু যীশুর ধরাধামে আগমন বিশ্বাসের যাত্রাপথে পাহাড়ী আদিবাসী খ্রীষ্টভক্তগণ বড়দিনটি তাদের নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও তাদের বসতভূমিতে নিজস্ব স্বকীয়তা, প্রাত্যহিক জীবনের রূপ ছন্দের বৈচিত্র্য দিয়ে উৎসবের বাতাবরণের আনন্দ উৎসাহ নিয়ে পালন করে থাকে। বড়দিনের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির ও উপাসনার পরিচালনা আমরা ফাদার, সিস্টার ও কাটেখিস্ট মাস্টারগণ করে থাকি। বড়দিন আসলে আগমনকালের চারটি প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়, আগমনকালীন সহায়িকা ব্যবহার করে শাস্ত্রপাঠের অনুধ্যান, সর্বজনীন প্রার্থনা ও সমাপণী প্রার্থনা করা হয় এবং পাপস্বীকার ও পুনর্মিলন সাক্রামেন্ত্রীয় উপাসনা করে বড়দিনের পবিত্রতা, শুচিতা ও নির্মলতা সম্পর্কে বোঝানো হয়। আমরা কাথলিক মিশন থেকে আদিবাসীদের পাড়ায়-পাড়ায় পালকীয় কাজের মধ্যদিয়ে বড়দিনের প্রস্তুতির দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকি। খ্রীষ্টীয় জীবনের পাহাড় উপত্যকা, ছড়া ও চিঙ্গী নদীর পাড় হয়ে পথচলা খুবই উপভোগ্য হয়, যখন পাহাড়ী খ্রিস্টভক্তদের নিজস্ব প্রকৃতির দ্রব্যসামগ্রী ও ঐতিহ্যগত পূজা-অর্চনার আঙ্গিকে খ্রীষ্ট যীশুকে গ্রহণ করে। খ্রীষ্টযাগে মহিলারা তাদের জুমের ফসলের যে পাত্র নিয়ে আসে সবসময় তা জবাুফুল দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে আসে। পরিবারের ও বসতিতে অপদেবতা, মন্দ আত্মা অপশক্তি বিনাশে তারা পরিবার থেকে বোতল ভর্তি পানি বেদীর পাশে রেখে আশীর্বাদিত পানি ঘরে প্রতিদিন ছিটিয়ে দেয়। বড়দিনের গোশালায় শিশু যীশুকে ভক্তি, প্রণাম শুদ্ধ, পবিত্র ও নিচু হয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ গ্রহণ করে।
সামাজিকভাবে, পাড়ার কারবারী, মাস্টার ও মুরব্বিগণ বসে বড়দিনের প্রস্তুতির মিটিং করে সম্ভবপর বড়দিনের উদযাপনের বাজেট প্রস্তুত করে। পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রতিবছর পাহাড়ী খ্রিস্টানদের বড়দিন উপলক্ষে চাল অথবা সমপরিমাণ অর্থদান করে। এ বছর “ধর্ম যার-যার উৎসব সবার” এই চিন্তা-চেতনার ভিত্তিতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের শুভ বড়দিন উদযাপন উপলক্ষে নগদ টাকা বরাদ্দ ২০২০ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দুর্যোগ অধিদপ্তর হতে খাগড়াছড়ি ১৮৪টি গির্জায় ৯২ মেট্রিক টন চাল অর্থাৎ ৪১, ১৮, ৪৭২০ টাকা অগ্রণী ব্যাংক শাখার মাধ্যমে নিবন্ধিত গির্জার নামে বিতরণ করা হবে। এছাড়া, আদিবাসী পাড়ার প্রতিটি পরিবার হতে চাল ও দান সংগ্রহ করে সামাজিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধূলা ও গির্জার সাজানো কাজে ব্যবহার করা হয়।
পাহাড় এলাকায় চাকমা বসতির বেতছড়ি, দাঁতভাঙ্গা ছড়া, ইটছড়ি, সাক্রাছড়া, কুতুকছড়ি ও কমলছড়ির ধর্ম নির্বিশেষে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আত্মীয়-প্রতিবেশী সহযোগিতায় মিলে-মিশে কীর্তন গেয়ে যীশুর আগমনী বার্তা ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়। অপরদিকে, রান্না-বান্নার আয়োজন, পাহাড়ের তলদেশ থেকে পানি তোলা, হাড়ি-পাতিল প্লেট ধোয়া সবাই স্বতস্ফূর্তভাবে সহভাগিতা করে।
এ বছর দুর্ভাগ্যভাবে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের মরণঘাতি দুষ্ট-ক্ষত এখনো বিপদ সীমার ওপর দিয়ে সংক্রমিত হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে নো মাক্স, নো এন্ট্রি। প্রতিটি গির্জায় বড়দিনের প্রার্থনায় নিরাময়ের প্রার্থনা সম্পূর্ণ আবেগ-অনুভুতি মিশিয়ে হৃদয় দিয়ে করা হচ্ছে। সবাই যেন সুস্থ, নিরাপদ ও বিপদমুক্ত থাকে এ প্রার্থনা পবিত্র শিশু যীশুর নামে করা হচ্ছে।
ভৌগোলিক বিচিত্রতার পাশাপাশি সেখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও নানা ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। এমন বিচিত্রতার মাঝে আপনার দৃষ্টিতে বড়দিন উৎসব কিভাবে সর্বজনীনতা লাভ করবে?
ভৌগোলিক বিচিত্রতার এ পার্বত্য পাহাড় বনভূমিকে দিয়েছে পর্যটন এলাকার সম্মান ও মর্যাদা। খাগড়াছড়ি প্রবেশ মুখে আলু টিলা পাহাড় ও গিরিখাদের গুহা সুরঙ্গ পথ ও প্রকৃতির অবারিত লীলাভূমি। শীত মৌসুমে প্রকৃতি প্রেমিক পর্যটকদের ব্যাপক ঢল নামে এ পাহাড়-বনভূমিকে কেন্দ্র করে এখানে সাজেক ভেলী, দেবতা পুকুর, রিসাং ঝর্ণা এবং শহরের ঝুলন্ত ব্রীজ ও দৃষ্টিনন্দন পার্ক দেখার জন্যে দূর-দূরান্ত হতে আকর্ষণীয় স্থানসমূহ দেখার জন্য সবাই এখানে ছুটে আসে। পাহাড়ঘেরা এ পার্বত্য এলাকায় চাকমা ও মারমা আদিবাসী জনগণ মূলত বৌদ্ধ অনুসারী এবং ত্রিপুরা আদিবাসী জনগণ সনাতন হিন্দুধর্মের অনুসারী প্রকৃতি পূজা-অর্চনাসহ নানা দেব-দেবতার পূজা উদযাপন করে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ কামনা করে। অতি সম্প্রতি, খাগড়াছড়ি শহরের বিভিন্ন উপজেলায় দির্ঘীনালা, মাটিরাঙ্গা মাইসছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে কাথলিক, ব্যাপ্টিস্ট, প্যান্টিকস্টাল, এসডিএ ও বিলিভার চার্চ তাদের চার্চ ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে খ্রীষ্টীয় বিশ্বাসসহ জীবনমান উন্নয়নের কাজ পরিচালনা করছে। বিভিন্ন খ্রীষ্টমন্ডলী হোস্টেল বোডিং এ সর্বস্তরে পাহাড়ি স্কুলপডুয়া ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ দিয়ে শিক্ষার প্রসার ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি করছে। ফলত, খ্রীষ্টধর্মের আলোকে জীবন গঠন ও জীবনধারণ পার্বত্য এলাকায় তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃতি লাভ করছে। খ্রীষ্টধর্ম এখানে পাহাড়ীদের নতুন আঙ্গিকে খ্রীষ্ট যিশুর মানব উন্নয়নের ধারক ও বাহক এ মর্যাদায় সমাসীন হয়েছে। প্রাথমিকভাবে, বাণীপ্রচার, খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করা ও পাহাড়ী জনপদে প্রবেশ সংরক্ষিত ছিল। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে সবার কাছে খ্রীষ্টধর্ম বন্ধুভাবাপন্ন ও আধ্যাত্মিক পরিবেশবান্ধব ধর্মে রূপায়িত হচ্ছে। খ্রীষ্টধর্ম পর্যায়ক্রমে এখানে সবার সুপরিচিত ইতিবাচক ও উন্নয়নধর্মী বিশ্বাসের গঠনমূলক ধর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
অত্র এলাকার সহজ-সরল আদিবাসীরা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে যে শুভযাত্রা শুরু করেছে ও সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন ও উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছে তা মণ্ডলী কর্তৃপক্ষ যেন সদা সর্বদা সদয় দৃষ্টি দিয়ে দেখে এবং সাধারণ মানুষের বিপদ-আপদে, রোগে-শোকে, বেকারত্বে ও অবহেলায় যারা রয়েছে তাদের পাশে যেন দাঁড়ায়। বড়দিনের তাৎপর্য ও উদযাপনের সর্বজনীনতা যে মাত্রায় উপনীত হয়েছে তার থেকে যেন আরো উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
বড়দিন প্রভু যীশুর আগমন একটি ঐশশক্তি, ঐশপ্রেরণা ও বিশ্বাসের নবায়ন। খ্রীষ্টধর্ম শান্তি ন্যায্যতা ও মানবতার কথা ও কন্ঠস্বর হয়ে সবার কাছে সমাদৃত হোক। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ও অন্ত কোন্দল দূর হয়ে যাক, শান্তি, সম্প্রীতি, ন্যায্যতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত হোক, যে দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রেরণকাজ ঈশ্বরের ইচ্ছায় প্রভু যীশু গ্রহণ করেছে তা হলো পরম পিতার শান্তিরাজ্য এ জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করুক ও ঐশইচ্ছা ও ঐশপরিকল্পনা পাহাড়ি আদিবাসী এলাকায় দৃশ্যমান হোক এ প্রচেষ্টা ও প্রত্যাশা দিনে-দিনে বৃদ্ধি লাভ করে অন্ধকার হতে খ্রিস্ট বিজয়ের আলো আলোকিত হোক এ শুভ কামনা রইল। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, পাহাড়ী আদিবাসীরা ধর্মপ্রাণ মানুষ, অল্পতেই তুষ্ট আবার সামান্য কারণে ক্ষুব্ধ, অনুভূতিপ্রবণ, স্পর্শকাতর ও সহজেই অভিমান করে বসে এতদসত্বেও এদের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ফলে অত্র এলাকায় ধর্মযাজকদের বাণীপ্রচারে, ত্যাগস্বীকার, শ্রমসাধনা, ঐশভালোবাসা পূর্ণ সেবাকাজের এ প্রচেষ্টা যেন সার্থক হয়।
স্বনির্ভর বাজারে নবাগত বিকাশ চাকমা মুদি দোকানের সওদাগর তার স্ত্রী রিনা রেমা দুজনেই একসাথে দোকানের কর্মব্যস্ততার মধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের কাজে ও ব্যবসায় জড়িত আছে। নতুন বিকাশ খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে ঠিকই অথচ ধর্মশিক্ষার সুযোগ খুব কমই পেয়েছে। তার পৈতৃক ভিটা-বাড়ি নানিয়াচর রাঙ্গামাটি সে জায়গা হতে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ হতে এ পর্যন্ত স্বনির্ভর এলাকায় দোকানদারি করে ভালই পরিবার নিয়ে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। বড়দিন উদযাপন করার কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, বড়দিন সকালে গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ধোলায় করা নতুন লুঙ্গি ও শার্ট পরিধান করে গির্জার উপাসনায় অংশগ্রহণ করে। প্রার্থনা করে পাপ অপরাধের ক্ষমা চায় ও আশীর্বাদ যাচনা করে যাতে নতুন বছরে সুখে-শান্তিতে ও নিরাপদে ও সুস্বাস্থ্যে বসবাস করতে পারে।
অপরদিকে, তার স্ত্রী রিনা রেমা খ্রীষ্টসাক্ষ্য দিয়ে বলেন, এবার বড়দিনের উপহার হলো আমার ছেলে যিশাইয় চাকমা; মদের নেশা ও বন্ধুদের সাথে বাজে আড্ডা দিত, সে অবাধ্য উশৃঙ্খল জীবন যাপনে জড়িয়ে পড়েছিল। আমি মা হয়ে আমার ছেলেকে পরম পিতা ঈশ্বর ও মা মারীয়ার পায়ে সঁপে দিলাম। এখন সে মন পরিবর্তন করে ভালো পথে ফিরে এসেছে বড়দিন পুনর্মিলন উৎসবে সে প্রেরিত শিষ্য সাধু যোহনের কাথলিক গির্জায় বড়দিনের খ্রীষ্টযাগে অংশগ্রহণ করে ধন্যবাদ ও মানত পূর্ণ করবে।
অপরদিকে, সাজেক পাড়া বিশ্বজিৎ চাকমা বড়দিনের আনন্দ সহভাগিতা করেন সকলের সঙ্গে । তিনি বলেন, তাদের দরজা অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য সবসময় খোলা থাকে। যা প্রস্তুত করা হয় তাই মিলে-মিশে খান তারা, কাউকে আমরা দুঃখ দেই না, যারা বৃদ্ধ মানুষ তাদের ঘরে খাওয়া পৌঁছে দেই এবং নিরীহ-গরীবদের সাহায্য করি ও অসুস্থদের দেখাশুনা, যত্ন-সেবা ও পরিচর্যা করি।
খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার কোন আফসোস নেই, আনন্দিত মনে বড়দিনের অফুরন্ত ও অভাবনীয় অসীম আনন্দ নিয়ে বড়দিন উদযাপন করব। তিনি জীবন সাক্ষ্য দিয়ে বলেন যে, তার পূর্বপুরুষ খ্রীষ্টধর্ম পালন করে এসেছে, তিনিও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, যীশু ছাড়া কোথায় যাব, যীশু ব্যতীত আর কেউ নেই। প্রভু যীশু তোমার নামে অবগাহিত হলাম, তোমার কাছেই রয়েছে শাশ্বত অনন্ত জীবনের বাণী।
ফাদার রবার্ট গন্সালভেছ : সবাইকে শুভ বড়দিনের ও নববর্ষের ২০২১ প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। বড়দিনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস এ ক্ষুদ্র পরিসরে প্রকাশের সুযোগদানের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। খ্রীষ্ট প্রভু যীশু তোমার প্রশংসা হোক।
[জীবন ও সমাজে পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]