নির্মল আনন্দ ।। প্রসঙ্গ বড়দিন

কাজল রোজারিও : অক্টোবর মাসের শেষ ও নভেম্বরের প্রথমদিকেই হালকা শীতের আভাস পাওয়া যায় গ্রামাঞ্চলে। সকালে ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু চোখে পড়ে। মাসের শেষের দিকে উত্তরবঙ্গের  শ্যামল ভূমিতে সবুজ ধানের রঙ সোনালি হতে শুরু করে। সারি-সারি প্রজাতির দল পাখা গুটিয়ে অপেক্ষায় বসে থাকে কখন রবি মামার হাসি দেখতে পাবে। ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয়ে যায় পাকা ধান কাটার মহাধুম। গাছিরা (যারা খেঁজুর গাছ কাটে) ব্যস্ত গাছ কাটতে। কিছু দিন পরেই মাঠের সব ধান কাটার পর শুরু হয় রবি শস্যের আয়োজন। মাঠে-মাঠে হলুদ রঙের বিছানা তৈরি হয় সর্ষে ফুলে। ফুলে-ফুলে গুঞ্জন আর ব্যস্ত জীবন কাটায় মৌমাছিরা, উড়ে বেড়ায় ফুল থেকে ফুলে, মধু সংগ্রহ তাদের একমাত্র কাজ। এদিকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে স্কুলের সমাপনী পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। আর ঠিক সেসময় নতুন বার্তা নিয়ে আসে আগমনকাল। অর্থাৎ প্রভু যীশুর আসার পথ প্রস্তুতের প্রাণবন্ত একটি সময়। সমাপনী পরীক্ষা শেষ মানেই শুরু হবে গ্রামে-গ্রামে কীর্তন। খোল, ঢোল আর করতালের ঝংকারে ঘরে বসে থাকা যায় না। যীশুর আগমনের বার্তা গানের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। কীর্তনের সুর, ঢোলের তাল জানিয়ে দেয় বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এখনই। ঘরে-ঘরে শুরু হয় নতুন ধানের আতপ চাউলের গুড়া কুটা। যা থেকে বড়দিনের আনন্দের চিহ্ন হিসেবে নানা ধরনের পিঠা-পুলি তৈরি করা হয়। ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, নতুন জামা কাপড় কেনা, সাজসজ্জায় তখন ব্যস্ত সময়। একটা সময় ছিল যখন বাড়িতে-বাড়িতে ঘরের সামনে সাজানো হতো এবং তাতে ব্যবহার হতো কলাগাছ আর গাঁথা ফুল। বাড়ির সামনে ছোট গেইট যেখানে শুভ বড়দিন লেখাটা বিভিন্ন রঙিন কাগজের নিশানা দিয়ে সাজানো হতো। এখন আর সে ঐ ঐতিহ্য চোখে পড়ে না। বাড়ির উঠান লেপা হতো, বেড়ার ঘরে আলপনা আর ফুল আঁকা হতো চুন বা রঙ দিয়ে। গাছে-গাছে চুন দিয়ে সজ্জিত হতো। তবে কালক্রমে অনেক কিছুই আজ ঢাকা পড়েছে বিবর্তনের কাছে। এসব হারিয়ে গেছে আজ স্মৃতির অন্তরালে। একটা সময় ছিল বড়দিনের দিন খ্রিস্টযাগ থেকে বাড়ি ফিরে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় ও বড়দের কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণের রীতি পালন করা হতো যার মাধ্যমে মনের মধ্যে সত্যিকার অর্থেই বড়দিনের আনন্দ প্রকাশ পেতো, একটা আত্মতৃপ্তির জায়গা তৈরি হতো। ২৪ তারিখ রাতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে কীর্তন সহযোগে মহাখ্রিস্টযাগে যোগদান করা হতো এবং শেষে সকল গ্রাম একসঙ্গে কীর্তন করা হতো। যা মহামিলনের উৎসবে পরিণত হতো। একইভাবে, ২৫ ডিসেম্বরেও কীর্তন সহযোগেই গির্জায় প্রবেশ করা এবং পরে আনন্দের মহাসমাবেশ করা হতো। হতো বিভিন্ন গ্রামভিত্তিক কীর্তন প্রতিযোগিতা, এখনও হয় তবে আগের মতো নয় নিসন্দেহে। নির্মল আনন্দ নানা বাহ্যিকতার মাঝেও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিও চলতো সমান তালে। মনের সন্তুষ্টির জন্য আমাদের যে আধ্যাত্মিক খাদ্যের প্রয়োজন তা মানুষের একটি চাহিদা ছিল। বড়দিনের পূর্ব প্রস্তুতির জন্য প্রাক্ বড়দিন আয়োজন করা হয়ে থাকে যুবাদের উদ্যোগে। সেখানে আধ্যাত্মিক অনুধ্যান, পাপস্বীকার, খ্রিস্টযাগ, কেক কাটা এবং কীর্তনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বড়দিন থেকে শুরু করে এক সপ্তাহ থেকে পনেরো দিন বা তারও অধিক সময় ধরে চলতো বড়দিনে আনন্দ। সমাজে বৈঠক হতো, এছাড়াও থাকতো বিভিন্ন ধরনের গান-বাজনা এবং মজাদার পিঠার আয়োজন। একটা সময় আপন হাতের নিপুণ কারুকার্যে তৈরি হতো পিঠা আর সেখানেই ছিল আনন্দের চিহ্ন, কিন্তু বর্তমানে খুব সহজে হাতের স্পর্শ ছাড়াই হয়ে যায় পিঠা বনানো। নির্মল আনন্দের বড়ই অভাব। 

নির্মল আনন্দ ।। প্রসঙ্গ বড়দিন
বাহিরের সবকিছু আমাদের বাহ্যিকভাবে আনন্দ দিয়ে থাকে, তবে আত্মতুষ্টি পেতে আমাদের আধ্যাত্মিক খাদ্যের প্রয়োজন। সত্যিকার অর্থে বড়দিন খ্রিস্টবিশ্বাসীদের জীবনে কিসের বার্তা বহন করে? জন্মদিন আমাদের প্রত্যেকের জীবনের জন্য একটি মহান দিন, জীবনের জন্য ধন্যবাদ  কৃতজ্ঞতা ও আশীর্বাদের দিন। তেমনি এক মহান রাজার জন্ম হয়েছিল বেথলেহেম নগরে ক্ষুদ্র গোয়ালঘরে। তিনি দীনবেশে মানুষরূপে এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। যিনি পাপী মানুষকে ভালোবাসে পাপ থেকে মুক্তি দিতেই এসেছিলেন। যীশুর জন্ম প্রতিটি মানুষের অন্তর আলোকিত করেন নিজেকে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে। তিনি আলোকিত মানুষ হওয়ার আহ্বান করেন। তিনি নিজে ক্রুশে জীবন দিয়ে দয়া, ক্ষমা, প্রেম ও ভালোবাসার আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কিভাবে পিতাকে ভালোবাসতে হয়। বর্তমান সময়ে ভালোবাসার প্রচন্ড অভাব রয়েছে আমাদের সমাজে। একদিকে করোনা মহামারী তারপর প্রচন্ড শীত। মানুষ দিনে-দিনে আত্মকেন্দ্রীক জীবন যাপনে ব্যস্ত। কারো দিকে তাকানোর সময় করো নেই। তাই এ সময় নিজেদের ক্ষুধা, অভাব, আত্মপোলব্ধি থেকে খুঁজে ফিরি কোথায় আমাদেরকে আত্মতৃপ্তি। পাওয়া নয় বরং দেওয়ার মধ্যেই প্রকৃত আনন্দকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। সেবা পেতে নয় বরং সেবা দেওয়াটা হোক আমাদের অভাব। 

সকল বাঁধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে নিয়ম মেনে হোক সবার মাঝে বড়দিনের নির্মল আনন্দ। সর্বস্তরের জনগণকে জানাই শিশু যীশুর জন্মবারতার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। শুভ বড়দিন।

লেখক : কাজল রোজারিও,

শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, সমাজকর্ম


Post a Comment

Previous Post Next Post