বিশ্ব এখন এক অস্থির সময় পার করছে


জ্যাষ্টিন গোমেজ : মূল্যবোধ মানুষকে ভালো হতে শেখায়। শেখায় মন্দকে চিনতে এবং মন্দ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। এটি সততা ও সৎ হতে উৎসারিত একটি স্বর্গীয় প্রত্যয়-যা ব্যক্তিকে মানবিকবোধে উজ্জীবিত করে। মানুষকে ন্যায়পথে পরিচালনা করে। বিশেষ করে, মানুষকে সৎবুদ্ধি ও মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ করে। এক কথায় বলা যায়, মূল্যবোধ হলো মানুষের সর্বজনীন আচরণ। সত্য, ন্যায় ও ভালবাসা-এগুলো মূল্যবোধের বহিপ্রকাশ। আর এগুলো মানুষের মানবিক গুণ। অর্থকড়ি, ক্ষমতা, মর্যাদা থাকার পরও শুধুমাত্র মূল্যবোধ আর যুক্তি-বিচারের অভাব থাকায় মানুষ নিতান্তই গরিব। মূল্যবোধ ব্যাপারটা উপলব্ধি করা বেশ কঠিন। মূল্যবোধের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মোতাহার হোসেন লিখেছেন, “মূল্যবোধের লক্ষণ হলো, নিকটবর্তী স্থুল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে আনন্দপ্রদ সুকুমারবিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ জানা এবং তাদের জন্য প্রতীক্ষা ও ক্ষতি স্বীকার করতে শেখা এবং জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা।”
বিশ্ব এখন এক অস্থির সময় পার করছে


মূল্যবোধ এর সাথে শিক্ষা অর্জনের বিষয়টি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। তার মানে এই নয় যে, শিক্ষিত মানুষ মাত্রই মূল্যবোধসম্পন্ন। শিক্ষা কেবল মূল্যবোধকে বিকশিত করে। আর যারা পারে তারাই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। যেসব মানুষ সুশিক্ষিত হতে পারেনি অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে সুকুমারবৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেনি তাদের মধ্যে মূল্যবোধ কখনো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তার শিক্ষাকে সৎ আর ন্যায়ের পথে কাজে লাগান। যৌক্তিক বিষয়াটিকে যৌক্তিকভাবে বুঝার পর নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে, অযৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্রতী হন। আর যারা এসব বৈশিষ্ট্যের ধারের কাছে নেই, তারা তাদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি যুক্তি-বিচারের বাইরে গিয়ে যে কোনো উপায়েই হোক না কেন তা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং এই গোত্রের মানুষগুলো খুবই বিপজ্জনক এবং এরা এক পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু পাওয়ার জন্য অনেকটা একরোখা আচরণের কারণে। যৌক্তিকতাকে মোটেই আমলে নিতে চায় না। আর আমাদের সমাজে এই সংখ্যাটা অনেক বেশি বলে সুশিক্ষিত মানুষগুলো তাদের কাছে প্রতিনিয়ত ঠকছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে এবং সর্বোপরি, সমাজ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। আরো অবাক করা বিষয় হল, মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। আবার এই মানুষের জন্যেই পুলিশ, আদালত, বিচার এর বিভিন্ন ব্যবস্থা। সবচেয়ে হতাশ হতে হয় তরুণ জনগোষ্ঠীদের দিকে তাকালে। কেননা তাদের মধ্যে সর্বদাই কেমন যেন হাহাকার, না পাওয়ার আক্ষেপ আর স্থুল সুখের দিকে ধাবমান দৃশ্য চোখে পড়ে। আর এখান থেকেই তো যেন মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মহোৎসব শুরু। 

সারা বিশ্বই এখন অপ্রীতিকর ও অস্থির সময় পার করছে। আর এর ছোঁয়া থেকে বাংলাদেশও বাইরে নয়। একে আবার সভ্যতার সংকট বললেও ভুল হবে না। আর এর ফলে চাপা এক অস্থিরতার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে সবাই। স্বীকার করতে হবে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটছে কিন্তু বাড়ছে তীব্র ধনবৈষম্য। জীবনের মান বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জীবন সমৃদ্ধ হচ্ছে কতটুকু সেটা বড় একটা প্রশ্ন। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে যেসব ঘটনা দেখা গেছে এবং দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, শিক্ষা ও সমাজ উভয়ই আলাদা-আলাদাভাবে মানুষের মূল্যবোধ বিকাশে পরিপূর্ণভাবে সাফল্য লাভ করতে পারেনি। এদেশে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো খুন-হত্যা-জঙ্গি হামলার ঘটনা মানুষের মনুষ্যত্বের অধপতনের চরম প্রকাশ। এছাড়াও দেশে দুর্নীতির প্রসার ও বিচারহীনতার কথা নতুন কিছু নয়। অত্যাচার, অনাচার, মারামারি এবং অন্যায়ভাবে দ্রুত বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতা অহরহ। সমাজ যে নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে তা দৃশ্যমান। এটি স্পষ্ট যে, ন্যায়কে দাবিয়ে অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে অযাচিতভাবে। ভালকে সরিয়ে মন্দকে জায়গা করে দেয়া হচ্ছে। ফলে সততার স্থান হচ্ছে হাহাকারে। সমাজের চারিদিকে তাকালে বেশি বুদ্ধিমান লোকের অভাব নেই। কিন্তু বুদ্ধির উৎকর্ষতায় শীর্ষে এমন লোকের সংখ্যা হাতেগোনা। বেশি বুদ্ধির লোকদের বলা হয় চতুর, এরা বুদ্ধির উৎকর্ষ সাধন করে বলে এদের বলা হয় মনীষী। আর এই সংখ্যা সসীম। সবচাইতে বড় আক্ষেপ আর চিন্তার বিষয় হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধের অধিকারী ব্যক্তিরা শুধু দেশপ্রেমে উদাসীনই নয় বরং ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে ক্ষেত্রবিশেষে দেশকে ধ্বংস করতে উদ্ধত। প্রকৃতপক্ষে, ধর্মীয় শিক্ষা বা মূল্যবোধের মাধ্যমে নৈতিকতা আনা সম্ভব। আর যাই বলুন না কেন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দায় কিন্তু শিক্ষা ও সমাজকেই নিতে হবে। কেনানা গত কয়েক বছরে ধরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হত্যাকান্ড ও গুলশানে হামলা নতুনভাবে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। অনিশ্চিত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীরা বেকারত্বের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন পথ বেছে নেয়। ছাত্রজীবন শেষ করে অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে চাকুরী নিতে হয়। আর এতো টাকা পাবে কোথায়! সমস্ত জায়গায় হাতড়ে যখন আর কোন কূল-কিনারা পাওয়া না যায় তখন জঙ্গিবাদ এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কেননা, এখানে জড়াতে কোনো টাকা লাগে না বরং আরো সুযোগ-সুবিধার সমাহার। যারা এইসব কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত, তারা যদি কোনো আদর্শের কারণে এগুলো করে থাকে, তাহলে বলতে হবে; রাষ্ট্র তার নিজস্ব শিক্ষার আদর্শ অনুযায়ী সবাইকে গড়ে তুলতে পারছে না। শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় একটি আদর্শ থাকে। আর থাকতে হয়। কথা হচ্ছে রাষ্ট্র সেখানে কতটুকু সফল হচ্ছে সেটা বিচার্য বিষয়। লাখ-লাখ তথ্য শিখে কি হবে যদি সেগুলো হিংসামূলক ও ঘৃণামূলক প্রবৃত্তিগুলোকে দূর করতে না পারে! শুধু যে শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করছি তা নয় কিন্তু এখানে পরিবারের বড় একটা ভূমিকা অনস্বীকার্য। একজন জঙ্গীনেতা যদি একজন যুবাকে প্রভাবিত করে তার দলে নিয়ে যায় তাহলে পরিবারের কর্তা করছে টা কি! পরিবার কেন সন্তানের মধ্যে প্রত্যাশিত মানবীয় মূল্যবোধ সঞ্চারে ব্যার্থ হবে। বেশি কিছু না নিজ-নিজ দায়িত্বটুকু ভালভাবে পালন করা ও সকল কার্যকে কল্যাণমূখী করাই যথেষ্ট। একটা বিষয় মাথায়  রাখা দরকার, কোন শিশুই সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গী হয়ে জন্মায় না। বরং সমাজ ও পরিবেশই তাকে তার গন্তব্য নির্ধারণ করে দেয় যার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ আমাদের হাতে। অর্থাৎ শিশু কিভাবে বেড়ে উঠবে, বিকশিত হবে এবং পেশাগত জীবনে কি পরিচিতি লাভ করবে তার অনেকখানিই নির্ভর করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভূমিকার উপর। 

এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, এই হানাহানি আর লোভের পৃথিবীতে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। নৈতিকতার অভাব এখন আমাদের সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কলুষিত হয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজব্যবস্থা। আর এভাবে প্রতিদিন একটু-একটু করে কলুষিত হতে থাকলে শিঘ্রই আমাদের সমাজকে খুঁজে পাওয়া যাবে অন্ধকারের অতলে। তাই বলে কি কিছুই করা যাবে না! যাবে। প্রতিবাদী হয়ে মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসার ঘটানো না গেলে এর থেকে পরিত্রাণ দুসাধ্য। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টা সামাজিক সমস্যার চরম পর্যায়ে কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তাই সমস্যা যেহেতু আছে, এর সমাধানও করা দরকার। কিন্তু তার উপর আর একটি সমস্যা হলো, এটি যে একটি সমস্যা সেটাই স্বীকার করছে না। তাই আমাদের জপমন্ত্র হোক, মূল্যবোধ আর মূল্যবোধ। কেবলই মূল্যবোধ। এ কথা সত্য যে, আদর্শবান মানুষ হতে হলে তার সামনে কিছু অনুকরণীয় বিষয় থাকে তা তিনি যে ধর্মের অনুসারীই হোন না কেন। আর এই অনুকরণীয় বিষয়গুলো তার পার্থিব এবং অপার্থিব সকল জীবনের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন। তাহলেই আমরা বর্বরমুক্ত হয়ে সুন্দর ও সুসভ্য হতে পারব। যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে ও শিক্ষার পূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে সমস্যাটার সমাধান করতে পারব। প্রত্যেক মা-বাবাকেও তাদের সন্তানের প্রতি আদর, ভালবাসা আর যত্নে তাদের জন্য একটি নির্ভয় ও শিখন উপযোগী গৃহ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। 

ভাল চিরকালই কল্যাণের এবং আদর্শের, অপরদিকে মন্দ চিরকালই অকল্যাণকর ও ঘৃণ্য। আলোর রশ্মিতে অন্ধকার বিদূরিত হয় এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত সূর্যালোকের শুভাগমন করিয়ে রাতের অন্ধকারের অস্তিত্ব বিলীন করতে হবে। আমাদের আগামী দিনের প্রজন্ম যাতে সু-নাগরিক হিসেবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়, তার জন্যও তাদের মাঝে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ রাখতে হবে। আমরা এমন কোনো পরিবেশ চাই না, যেখানে কোন কারণে এক ভাই আর এক ভাইকে মারতে উদ্ধত হয়, হঠাৎ কোন নোটিশ ছাড়াই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে বিভেদের সৃষ্টি হয় ও সুশাসনের অভাব রয়েছে। এছাড়াও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সরকারের একার দায়িত্ব নয়, আর সেটা সম্ভবও নয়, নাগরিক হিসেবে আমরাও এর দায় এড়াতে পারি না।  

ছাত্রসমাজ যাতে উন্নত এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে সচ্চরিত্রের অধিকারী হতে পারে সেরকম শিক্ষাব্যবস্থা এবং নীতিশিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। একটি জাতির মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ ও সুন্দর মূল্যবোধ গড়ে ওঠে তখনই, যখন সেই জাতি মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। আমাদের আছে অনেক মর্যাদাপূর্ণ ইতিহাস। আমরাও চেষ্টা করলে সততা ও নৈতিক মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। দায়িত্ব, নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলাবোধ থাকলে ব্যক্তিজীবন যেমন সুখকর হয়, তেমনি সমাজজীবনেও আসে সুখ ও সমৃদ্ধি।

[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]  

Post a Comment

Previous Post Next Post