নোবেলজয়ী লেখক হোসে সারামাগো

হোসে সারামাগো-পর্তুগাল
একজন নোবেলজয়ী লেখকের ধূসর জীবন


সাইফুল ইসলাম: মানুষকে আপনি খুব সহজেই পরিমাপ করে একটা উপসংহারে পৌঁছালে বুঝতে হবে আপনি জ্ঞানী। কিন্তু যখন দেখবেন আপনার ধারণা স্রেফ ভুল প্রমাণিত হয়েছে, তখন কিন্তু আপনি আর জ্ঞানী ব্যক্তি নন। একজন মূর্খ মানুষ হিসেবেই পরিচিত হবেন।

সুতরাং কাউকে এক দেখায় পরিমাপ করা যায় না। কারণ যাকে নিয়ে আজ লিখছি, তাঁর জীবনে এমনই কিছু ঘটেছিলো অথবা এমন জীবন তিনি অতিবাহিত করছিলেন যে- আপনাদের মতো মূর্খ-জ্ঞানী মানুষেরা তাঁকে পরিমাপ করতে পারেননি। আর অবহেলা এবং পারিবারিক দুঃখ-কষ্টে জীবন অতিবাহিত করেও আজ তিনি একজন নোবেলজয়ী লেখক।

অবহেলিত নোবেলজয়ী লেখকের রাজকীয় জীবনরাজ্য সম্পর্কে কিছু জেনে নেই-

তিনি রিবাতেজো প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম জিনহাগাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা-মা ছিলেন ভূমিহীন কৃষক। আমাদের আবাসস্থল ছিল লিসবন শহর থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে আলমন্ডা নদীর ডান পাশে। তার বাবার নাম জোসে ডি সোসা এবং মাতার নাম মারিয়া দ্য পাইডেড। তালিকাভুক্তির আগপর্যন্ত তার নিজের নামও ছিল জোসে ডি সোসা, এটা তার বাবার ইচ্ছাতেই হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি তার নামের সাথে ডাকনাম 'সারামাগো' যোগ করেন এবং সেই নামেই গ্রামের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। আসলে, সারামাগো একটি বন্য ভেষজ উদ্ভিদের নাম, সেসময় গরীব মানুষের জীবন রক্ষায়; পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে এই উদ্ভিদটি ব্যবহৃত হতো। তার বয়স যখন সাত বছর, তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শনাক্তকরণ নথিতে নামটি তালিকাভুক্ত করা হয়, তখন থেকেই তিনি হোসে ডি সোসা সারামাগো হিসেবেই পরিচিত।

ভূমিহীন একজন কৃষকের নোবেলবিজয়ী ছেলে

আজ তিনিই হলেন ভূমিহীন একজন কৃষকের নোবেলবিজয়ী ছেলে। যিনি সেচ্ছায় নির্বাসিত হয়েছিলেন। তাঁর লেখা বেশ কিছু বই প্রকাশ করা হয়নি রাজনৈতিক কারণে। পরে যদিও সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠককূলের কাছেও বইগুলো বেশ জনপ্রিয়।

একজন বিশিষ্ট লেখক হিসেবেই হোসে সারামাগো সর্বাধিক খ্যাতিলাভ করেছেন। তার জন্ম ১৯২২ সালের ১৬ই নভেম্বর এবং এক কৃষক পরিবারে তার বেড়ে উঠা। তার লেখক জীবন শুরু হয় ১৯৪৭ সাল হতে প্রকাশিত Terra do pacado উপন্যাস দিয়ে। এরপর দীর্ঘ তিরিশ বছর আর সাহিত্যচর্চা করেননি। ১৯৭৬ সালে দ্বিতীয় উপন্যাস Manual of painting and Calligraphy প্রকাশিত হয়। জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের বেশ কয়েকটি বই অনূদিত হয়েছে ২৫টিরও বেশি ভাষায়। সারা বিশ্বে তার বইসমূহ ২০ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। আদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন উদার সমাজতান্ত্রিক। উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখালেখির কারণেই মূলত তিনি বিভিন্ন সময়ে গোঁড়াধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনার শিকার হয়েছেন, বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক। রাজনৈতিক পরিসরেও তিনি ছিলেন প্রতিবাদী লেখক। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর বেশ কিছু কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই তিনি সর্বাধিক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তার লেখালেখির ওপর নিজ জন্মভূমি পর্তুগালের সরকার ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ নিয়ে তার মনক্ষুণ্ণ হয়। এমনকি ১৯৯২ সালে তার রচিত গ্রন্থ 'দি গসপেল অ্যাকর্ডিং টু জিসাস ক্রাইস্ট' ইউরোপের প্রভাবশালী 'অ্যারিস্টিয়ন পুরস্কার' এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে পর্তুগালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অ্যানিবাল কভাকো সিলভা তা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। সরকারের এমন ব্যবহারের ফলে তিনি স্বেচ্ছানির্বাসন গ্রহণ করে স্প্যানিশ দ্বীপ লানজারোতে চলে যান। এবং সেখানে নির্বাসিত থাকাবস্থায় ২০১০ সালের ১৮ জুন তিনি পরলোকগমন করেন।

পাঠক এবং সমালোচকরা ১৮৮২ সালে তার রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস Baltasar and Blimunda কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত The Gospel According to Jesus Christ দারুণ হইচই ফেলেছিল পাঠকসমাজে। বইটি যদিও পরে পর্তুগিজ সরকার ক্যাথলিক ধর্মের অজুহাত দেখিয়ে ইউরোপীয় সাহিত্য পুরস্কারের জন্য বিবেচনায় বিরোধিতা করেন। সারামাগো এবং তার স্ত্রী এরপর ল্যানজারোত দ্বীপপুঞ্জে পাড়ি জমান। সেখানেই বসবাস করেন এবং ১৯৯৫ সালে Blindness ১৯৯৭ সালে All the Names ২০০০ সালে The Cave ২০০৬ সালে Seeing প্রকাশিত হয়।
অভাবের মধ্যেই বেড়ে উঠেন হোসে সারামাগো। এমনকি বসবাসের জন্য ভালো ঘরও ছিল না তাদের। ১৯২৪ সালে তার বাবা লিসবনে চলে যান এবং পুলিশের চাকুরি নেন। তখনকার সময়ে চাকুরির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা শর্তহীন ছিল, ফলে তার বাবা চাকুরিটি পেয়েছিলেন। এরপর তাদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়। তবে সে বছরই তার বড় ভাই মারা যাওয়ার কারণে তাদের পরিবারে শোক নেমে আসে। এরপর তারা লিসবনে আরেকটি পরিবারের সাথে যৌথভাবে একটি ছোট বাড়িতে বসবাস করার সক্ষমতা অর্জন করেন। তখন হোসে সারামাগোর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ
বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ।
facebook : Syful Islam

Post a Comment

Previous Post Next Post