মানিক উইলভার ডি’কস্তা ॥ বহুমাত্রিক প্রতিভাবান একজন ব্যক্তি

লিটন আরিন্দা : এবারের ফিচার আমাদের যুবাদের সর্বাধিক পরিচিত ও প্রিয়মুখ মানিকদা। তার অফিসিয়াল নাম হলো মানিক উইলভার ডি’কস্তা। তিনি অসাধারণ ও বহুমাত্রিক প্রতিভাবান একজন ব্যক্তি। তাই লেখার শিরোনামে নির্দিষ্ট কিছু লেখার পরিধি সসীম করতে নারাজ। মি. মানিকের জন্ম ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ নভেম্বর। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ নামক স্থানে জন্ম। তিনি এসএসসি পাশ করেছেন ফেনী জেলা থেকে। পরবর্তীতে এইচএসসি এবং গ্র্যাজুয়েশন করেছেন চট্টগ্রাম থেকে। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭ বছর যাবত তিনি চট্টগ্রাম ডায়োসিসে সেবাদান করে আসছেন। এর আগে ২০০১-২০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই তিন বছর যাবত তিনি শিক্ষকতা করেছেন দিয়াঙের মরিয়ম আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ে। 



মি. মানিক উইলভার ডি’কস্তার জীবনে মূল সংগ্রামটা ছিল আর্থিক সঙ্কট নিয়ে। ফেনীতে এসএসসি পাশ করার আগেই বাবা পরলোকগমন করেন। এসএসসির পরেই দিয়াঙে চলে যান তিনি। সংসার চালানো, নিজের ও বোনের পড়ালেখার খরচ চালাতে খুবই বেগ পেতে হয়েছে। কাকা রবি ডি’কস্তা (প্রয়াত) আর্থিকভাবে নিয়মিত সাহায্য করতেন। পিসি ইলা ডি’কস্তা দিয়াঙে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে টিউশন পড়ানো, দেয়াল বা সাইনবোর্ড লিখে জীবিকা চলাতেন। পরে ব্রাদার যোয়াকিম গমেজ সিএসসি দিয়াঙ বোর্ডিং এর ছাত্রদের টিউশন দেয়ার কাজ দেয় তাকে। তার পড়ানোর প্রক্রিয়া পছন্দ হলে ব্রাদার সিলভেষ্টার মৃধা সিএসসি তাকে মরিয়ম আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেন। ধীরে-ধীরে শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ব্যাচ পড়ানো শুরু করেন এবং তখন কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করে। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে যখন ডায়োসিসে যোগদান করে তখন তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ২,৫০০.০০ টাকা। অথচ স্কুল ও টিউশন থেকে তখন প্রায় মাসিক ১৫,০০০.০০ টাকা নিয়মিত উপার্জন ছিল তার। প্রথম পর্যায়ে বেশি উপার্জন ছেড়ে কম বেতনে ডায়োসিসে যোগদান করা ছিল তার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। সেসময় দিয়াঙ থেকেই আসা-যাওয়া করে অফিস করতেন তখনকার যুবক মানিক ডি’কস্তা। ভোর ৪.৩০ মিনিটে উঠে জেলটিনে করে অনেক দূর থেকে বাসার জন্য পানি আনতেন। কুড়াল দিয়ে লাকড়ি কেটে মাকে দিয়ে, স্নান করে ও সকালের নাস্তা সেরে সকাল ৯টার মধ্যে অফিসে থাকতেন। দুপুরে দুটো রুটি খেয়ে শহরেই টিউশন করতেন। টিউশন সেরে দিয়াঙে ফিরতো রাত সাড়ে ৮টায়। তারপর ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ঘরে চারজন ছাত্রকে টিউশন দিতেন। এমনই ছিল তার জীবন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মাইকেল গোমেজ যখন জানতে পারেন, দুপুরে তিনি শুধু রুটি খেয়ে থাকেন, তিনি তাকে দুপুরে তার বাসায় জোর করে দুপুরের খাবার খাওয়াতেন। পরে ধীরে-ধীরে বেতন বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর একটি দরিদ্র এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে মা ও বোনকে শহরে নিয়ে আসি। কয়েক বছর পর ডায়োসিস স্বল্প ভাড়ায় দুই রুমের বিশিষ্ট ফ্ল্যাট দিলে চলে আসি পাথরঘাটায় কর্মস্থলের কাছে। স্বর্গীয় বিশপ মজেস কস্তা চট্টগ্রামের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিসহ অন্যান্য সেবাকর্মীদের বেতন উন্নীত করেন স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার মত। এখনো যা বেতন পান, বাইরের অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে তার তুলনায় দ্বিগুণ বেতন পেতেন নিশ্চই। তবে, মানুষের ভালবাসা ও ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাচ্ছেন অফুরান। সংসারে অনটন নেই, কিন্তু সুখ আছে। স্বর্গীয় বিশপ মজেস কস্তা ও তার মন্ত্রণা পরিষদ দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সুবিধায় ডায়োসিসের হাউজ বিল্ডিং-এ একটি ফ্ল্যাট কিনে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন তাকে। 

👉 দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতা ও বর্তমানে কোন-কোন কাজের সাথে তিনি সম্পৃক্ত আছেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন : 

চট্টগ্রাম ডায়োসিসের পালকীয় সেবাদলের (পিএসটি) চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সেক্রেটারী হিসেবে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারী বিশপ ভবনে যোগদান করেন। শুরুতে খণ্ডকালীন কর্মী হিসেবে আমি একবেলা কাজ করতাম। বিশপ মহোদয়ের ব্যক্তিগত সহকারী মিশনারী সিস্টার মনিকা দেশত্যাগ করলে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের তৎকালীন বিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও সিএসসি আমাকে তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করে পূর্ণকালীন কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ডায়োসিসান সেক্রেটারী মি. এরোল রবার্টসন চাকুরী হতে অব্যাহতি গ্রহণ করলে আমাকে ডাইয়োসিসান সেক্রেটারী’র অতিরিক্ত দায়িত্বও গ্রহণ করতে হয়। ঐ সময়ে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও পার্বত্য চট্টগ্রাম তিনটি অঞ্চলই চট্টগ্রাম ডায়োসিসের এলাকাধীন ছিল। পিএসটি’র মূল কার্যালয় ছিল বরিশালে ও চট্টগ্রাম ছিল আঞ্চলিক কার্যালয়। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে পিএসটি’র মূল কার্যালয় চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয় এবং পিএসটি’র পরিচালক পদ অবলুপ্ত করে পালকীয় সমন্বয়কারী পদ সৃষ্টি করা হয়। পালকীয় সেবাদল অর্থাৎ পিএসটি পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করে আমাকে ডায়োসিসের পালকীয় সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় একই বছরে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ডায়োসিসের অর্থনৈতিক প্রশাসক ফাদার পিয়ের বেনোয়া সিএসসি পরলোকগমন করেন এবং ফাদার আবশালোম লিন্টু রায়কে শূণ্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ফাদার লিন্টু রায় বছরের শেষভাগে বদলী হয়ে গেলে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দেই আমাকে ভারপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক প্রশাসকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এসময় আমাকে একাধারে ডায়োসিসের পালকীয় সমন্বয়কারী, ভারপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক প্রশাসক ও সেক্রেটারী এবং বিশপ মহোদয়ের ব্যক্তিগত সহকারী এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। স্বভাবতই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং বিশপ মহোদয়কে বিষয়টি দেখার জন্য অনুরোধ জানাই। অনুরোধে সাড়াদান করে চট্টগ্রামের তৎকালীন বিশপ স্বর্গীয় মজেস এম কস্তা সিএসসি আমাকে তার ব্যক্তিগত সহকারী পদ হতে অব্যাহতি প্রদান করেন এবং সিস্টার নিশা ঘাগ্রা এসএসএমআইকে নিয়োগ দান করেন। এছাড়াও সিস্টার নিশা পিএসটি’র একজন এনিমেটর হিসেবে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে আমাকে ভারপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক প্রশাসকের দায়িত্ব হতে অব্যাহতি প্রদান করে ফাদার পঙ্কজ ইগ্নেশিয়াস পেরেরা’কে অর্থনৈতিক প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন এবং এরপর আমার কাজের অতিরিক্ত চাপ কিছুটা কমে আসে। বর্তমানে আমি চট্টগ্রাম আর্চডায়োসিসের পালকীয় সমন্বয়কারী ও সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। চট্টগ্রাম আর্চডায়োসিসের কুরিয়া পালকীয়, অর্থ ও প্রশাসন এবং আইন এই তিনটি বিভাবে বিন্যস্ত। পালকীয় সমন্বয়কারী হিসেবে আমি ডায়োসিসের পালকীয় বিভাগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। পালকীয় সেবাদল (পিএসটি)’র সহযোগিতায় ডায়োসিস, অঞ্চল, ধর্মপল্লী এমনকি আরো তৃণমূল স্তরে সামাজিক, মানবিক, ধর্মীয় ও বিশ্বাসের শিক্ষাদান করাই আমার মূলকাজ। বিভিন্ন ধর্মপল্লীতে পালকীয় সফর করা ও বিশপ মহোদয়কে ধর্মপল্লীর পালকীয় অবস্থা জানানো, ডায়োসিস ও ধর্মপল্লীর বিভিন্ন ধরণের পালকীয় পরিকল্পনা, কৌশলগত পরিকল্পনা ইত্যাদি প্রণয়ন করা আমার দায়িত্ব। পিএসটি’র পাশাপাশি আমার আওতাধীন উন্নয়ন কার্যালয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্য উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন করাও আমাদের কর্মদায়িত্বের অংশ। ডায়োসিসান সেক্রেটারী হিসেবে আর্চবিশপের নির্দেশক্রমে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন কার্যালয়ে যোগাযোগ, তার প্রতিনিধিত্ব করা ইত্যাদিও আমার কর্মদায়িত্ব। 

মাণ্ডলীক কর্মী হিসেবে মূলকাজের পাশাপাশি আরো কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব ডায়োসিস কর্তৃক অর্পিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে পালন করেছি ও এখনো তা চলমান রয়েছে। ২০০৪-২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সহকারী যুব সমন্বয়কারী, ২০১০-২০১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যুব সমন্বয়কারী, ২০০৪-২০১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এপিসকপাল যুব কমিশনের সদস্য, মধ্যবর্তী ৩ বছর (সুনির্দিষ্টভাবে সাল মনে নেই) এপিসকপাল যুব কমিশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ হতে এযাবত ধর্মশিক্ষা ও বাইবেলীয় সেবাকাজ বিষয়ক কমিশনের সমন্বয়কারী ও এপিসকপাল কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ২০০৯ থেকে এযাবত ডায়োসিসের অর্থ পরিষদের সদস্য হিসেবে আছি এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে অর্থ পরিষদের সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। 

👉 আপনার জীবনে এমন কোন শুভাকাঙ্খি কি আছে যাদের কথা কৃতজ্ঞতাভরে উল্লেখ করতে চান? যাদের অবদান অনস্বীকার্য? 

আমার কাকা স্বর্গীয় রবি খ্রিস্টফার ডি’কস্তা, পিসি ইলা ডি’কস্তা, ব্রাদার সিলভেষ্টার মৃধা সিএসসি; মি. মাইকেল গোমেজ। আমার বড়বোন মুক্তা ডি’কস্তা আমার পরিবারের জন্য অনেক ত্যাগস্বীকার করেছেন, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করেছেন সংগ্রামের দিনগুলোতে। আমার জীবন সংগ্রামের মুহূর্তগুলোতে তারা আমার অনেক কাছে ছিলেন, বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। মাণ্ডলীক সেবাকাজে আসার প্রেরণা পেয়েছি ফাদার অতুল পালমা সিএসসি; ফাদার আদম এস পেরেরা সিএসসি; মিঃ বিপুল এলিট গোনছালভেস, প্রমুখের কাছ থেকে। সেবাকাজে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন ফাদার গিলবার্ট লাগু সিএসসি; সিস্টার সুপ্রীতি কস্তা আরএনডিএম, ফাদার জ্যোতি এফ গমেজ, ফাদার সুব্রত বনিফাস গমেজ, ফাদার লেনার্ড সি রিবেরু, ফাদার টেরেন্স রড্রিক্স, মিঃ জেমস্ গোমেজ, প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। নিজ পরিবারের পরে আমার জীবনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন পরম শ্রদ্ধাভাজন স্বর্গীয় আর্চবিশপ মজেস কস্তা সিএসসি। যার আকস্মিক মৃত্যু আমার জীবনে অনেক বড় শূন্যতা তৈরি করেছে এবং যার অভাব কোনদিনও পূরণ হওয়ার নয়। যাদের নাম স্মরণ করেছি এবং যাদের নাম হয়তো মনের অজান্তে বাদ পড়েছে, তাদের সকলের অবদানই আমার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 



👉 জীবনে এগিয়ে যেতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। আপনি কি কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন? আর করে থাকলে তা কিভাবে মোকাবেলা করেছেন সে সম্পর্কে কিছু বলেন। 

প্রকৃতপক্ষে, প্রতিবন্ধকতা বলবো না। তবে কিছুটা চড়াই-উৎরাই তো ছিলই। মাণ্ডলীক সেবাকাজে যখন আসি, আমি মাত্র এইচএসসি পাস করে ডিগ্রীতে ভর্তি হয়েছি। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা কষ্টসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং ছিল, বিশেষত, ধর্মীয় ও বিশ্বাসের গঠন। ধীরে-ধীরে দেশে ও দেশের বাইরে জার্মানী, মালয়েশিয়া, থাইল্যাণ্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইত্যাদি স্থানে প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে চট্টগ্রাম ডাইয়োসিস আমার জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ করে দিয়েছে। 

শুরুর দিকে স্বল্প সংখ্যক খ্রিস্টভক্ত, কয়েকজন যাজক ও সন্ন্যাসব্রতী মণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে একজন সাধারণ খ্রিস্টভক্ত নিয়োজিত আছেন বিষয়টি ভালভাবে নিতে পারতেন না। কিন্তু ধীরে-ধীরে সকলের ভালবাসা ও আস্থা অর্জন করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়েছি ঈশ্বরের আশীর্বাদে। বিভিন্ন জায়গায় শুনি মণ্ডলী অনেক বেশি যাজককেন্দ্রিক, সাধারণ খ্রিস্টভক্তকে নেতৃত্ব ছাড়তে প্রস্তুত নয়। কিন্তু চট্টগ্রামে আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। অফিসে, কমিশনে, ডায়োসিসের বড়-বড় অনুষ্ঠানে বহু যাজক, সন্ন্যাসব্রতী, খ্রিস্টভক্ত আমার পরিচালনায় কাজ করেছেন ও করছেন। আবার আমিও অনেকের পরিচালনায় কাজ করেছি ও করছি। কতনা শ্রদ্ধাভাজন খ্রিস্টভক্ত, ব্রাদার, সিস্টার, ফাদারদের সাথে দিনের পর দিন, রাত জেগে ছোট-বড় বহু ধরণের কাজ করেছি! আমি কখনোই কারো অসম্মান বা অশ্রদ্ধা পাইনি। কাউকে জ্ঞাতসারে অসম্মানও করিনি। চট্টগ্রাম ডায়োসিসে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু এখানকার খ্রিস্টভক্ত, সন্ন্যাসব্রতী, যাজকদের মধ্যে একসাথে একে অপরের নেতৃত্বে কাজ করার উদারতা আমি পেয়েছি এবং এখনো তা পাচ্ছি। 

👉 আজ অবধি একাধিক বিশপদের (বিশপ প্যাট্রিক (বর্তমান কার্ডিনাল) বিশপ সুব্রত, বিশপ মজেস) সাথে ও কাছে থেকে কাজ করেছেন। এবিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতার বিষয়ে কথা বলুন।  

প্রতিজন মানুষ অনন্য, অনন্য প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব। তিনজন বিশপকেই তাই তিনভাবে দেখেছি। একজনের মানদণ্ডে আরেকজনকে বিচার করা যাবে না। 

কয়েক বছর শিক্ষকতা করলেও ডায়োসিসে যখন যোগদান করি, তখন অফিসিয়াল কাজ কিছুই পারতাম না, এমনকি টাইপিংও জানতাম না। বিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও সিএসসি (বর্তমানে কার্ডিনাল) আমাকে হাতে কলমে চিঠি-পত্র লিখতে, বিভিন্ন ধরণের ডক্যুমেন্ট ও প্রেজেন্টেশন প্রস্তুত করতে হয়, মিটিঙের মিনিটস্ লিখতে, ফাইল ক্লাসিফিকেশন, ডক্যুমেন্ট সর্টিং ও ফাইলিং করতে, মিটিং পরিচালনা করতে, এমনকি বাংলা বানানও শিখিয়েছেন। ভুল হয় বলে লজ্জা পেতাম, তবু বিশপ প্যাট্রিক ইংরেজিতে কথা বলার জন্য জোর করতেন যেন শিখে নিতে পারি। বিশপ প্যাট্রিক খুব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতাম শুরুর দিকে। ধীরে-ধীরে তা কমতে থাকে। 

বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার সিএসসি যখন চট্টগ্রামের সহকারী বিশপ হিসেবে নিযুক্ত হয়ে আসেন, বয়সে তখন তিনি বেশ তরুণ, মাত্র ৪৪ বছর। তিনি সহজভাবে মানুষের সাথে মিশতেন, সহজভাবে মানুষের সাথে কথা বলতেন, সহজভাবে শিক্ষা দিতেন। প্রথম থেকেই পালকীয় সফরে ধর্মপল্লীর কেন্দ্রের চাইতে তিনি পাড়া ও গ্রামগুলো পরিদর্শন করার দিকে মনযোগী ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু পাড়ায় তার পদার্পণ হয়েছে। তিনি পরামর্শ গ্রহণে অত্যন্ত উদার প্রকৃতির। তাই দ্রুততার সাথে তার সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বিশপ প্যাট্রিক ঢাকার উত্তরসুরী বিশপ নিযুক্ত হয়ে চলে গেলে আমি বিশপ সুব্রত হাওলাদার সিএসসি’কে ধর্মপ্রদেশীয় প্রশাসক হিসেবেও পেয়েছি এবং অভিজ্ঞতা করেছি পালক হিসেবে তার দক্ষতা। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে নতুন সৃষ্ট বরিশাল ডায়োসিসের বিশপ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ চলে যাওয়ার পর, সঙ্গতকারণেই যোগাযোগ অনেক কমে গেছে। তথাপি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কটি এখনো নষ্ট হয়নি বললেই চলে। 

বিশপ প্যাট্রিক ও বিশপ সুব্রত দুজন ব্যক্তিই হিসাব ব্যবস্থাপনা খুব ভাল বোঝেন। তারা যখন চট্টগ্রামে ছিলেন, উভয়ই হিসাব ব্যবস্থাপনার নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে ডায়োসিসের হিসাব বিভাগকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করতেন। 

স্বর্গীয় আর্চবিশপ মজেস কস্তা সিএসসি ছিলেন মাটির মানুষ। যে কোন পর্যায়ের যে কোন মানুষের সাথে তিনি মিশতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা সময় দিতেন, নিজের বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনার কথা সহভাগিতা করতেন। তিনি খুব নীচু স্বরে কথা বলতেন ও মানুষ হিসেবে লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। তবে ডায়োসিসের স্বার্থরক্ষায় এবং দরিদ্র, বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার প্রশ্নে নীতিতে তিনি ছিলেন আপোষহীন। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা, এমনকি বিশপ, যাজক ও সন্ন্যাসব্রতীগণকেও নানাবিধ চ্যালেঞ্জ দিতে ভীত হতেন না। এই মনোভাবের জন্য চট্টগ্রামে ও দেশব্যাপী তিনি বহু মানুষের বিরাগভাজন হয়েছেন। তবে সংখ্যায় তারা খুবই কম। তবে তাকে ভালবাসে, এমন মানুষের সংখ্যা অগণিত। অবকাঠামোগত উন্নয়নে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। তার সময়ে চট্টগ্রাম ডায়োসিসে প্রভূত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন হয়েছে। বিশেষভাবে, চট্টগ্রামের আর্চবিশপ ভবন এবং ক্যাথিড্রাল গির্জার সংস্কারমূলক কাজ উল্লেখযোগ্য। তিনি মানুষকে ক্ষমতায়ন করতে পারতেন, মানুষের মধ্যে মণ্ডলীকে নিজের ভাবার মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে পারতেন। চট্টগ্রামের ফাদার, ব্রাদার, সিস্টার, খ্রিস্টভক্তগণ তার অনুপ্রেরণায় সাহসের সাথে চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ গ্রহণ করতে শুরু করেছে। মণ্ডলীর কাজে অংশগ্রহণ ও আর্থিক অনুদান প্রদানও তার সময়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি একজন উত্তম মেষপালক। নিজের খ্রিস্টভক্তদের দেখার আকুলতা তার মধ্যে সর্বদাই ছিল। মাসে ১০ দিনের বেশি খুব কমই আমি তাকে আর্চবিশপ ভবনে আরাম-আয়েশে কাটাতে দেখেছি। সবসময় তিনি ছুটে যেতেন দূর্গম এলাকাগুলোতে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে। তিনি বলতেন, “মেষপালকের শরীর থেকে মেষের গন্ধ আসতে হবে, নয়তো কেমন পালক হলাম?” ওয়াইসিএস থেকে শেখা ক্যাথলিক একশন- ‘দেখা-বিশ্লেষণ করা-কাজ করা’ প্রক্রিয়াটি জীবনের সর্বাবস্থায় ব্যবহার করার মূল্যবান শিক্ষা আমি তার নিকট হতেই পেয়েছি। ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যেকোন পর্যায়ের মানুষের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে তিনি ছিলেন খুবই উদার। 

👉 অনেক যুবারা আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দ করে, বিশেষত, আপনার কাজ-কর্ম, জীবনমান গঠন, ইত্যাদি। তারা চায় আপনার মত একজন মানুষ হতে। ইতোমধ্যে, বেশ কয়েকজন যুবাদের নিকট হতে আপনার বিষয়ে আদর্শিক মতামত পেয়েছি। তার মধ্য থেকে তিনজনের মতামত নিম্নে তুলে ধরা হলো।  

ফ্লেভিয়ান ডি’কস্তা :  মানিকদার সাথে পরিচয়টা সেই কিশোর বয়স থেকে। আমি যখন ওয়াইসিএস করি তখন, তিনি এসেছিলেন ওয়াইসিএস ম্যাথোলজি নিয়ে সহভাগিতা করতে। এরপর আরো কিছু যুব প্রোগামে তার কাছে থেকে কিছেু শেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তার সেশনগুলো আমাকে মুগ্ধ করতো। বিভিন্ন তথ্য ও আকর্ষণীয় ছবি ও ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি সেশন পরিচালনা করতেন। এছাড়াও কথা বলার ভঙ্গী ও ভাষার ব্যবহার এতো সুন্দর ছিলো যা আমাদেরকে সেশন চলাকালীন পুরোটা সময় মনোযোগী করতো। পোষ্ট এসএসসি প্রোগামে একবার আমি বলেছিলাম, যদি কখনো সামনে এসে সেশন নেয়ার সুযোগ হয়, তবে তাঁকে অনুসরণ করবো। 

যুব কার্যক্রম ছাড়াও তার নিকট আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ, কারণ তার কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছু শিখেছি। আমার প্রোগামের স্ক্রিপ্টিং, ভলেন্টিয়ার ম্যানেজমেন্ট, প্রোগামে বাজেট তৈরি ইত্যাদি। মজার বিষয় হচ্ছে, তাকে আমি কখনো রাগ করতে দেখিনি। তিনি কোন ভুল সরাসরি বলেন না। তিনি পজিটিভভাবে নেগেটিভ বলেন। যার ফলে, যুবারা মন খারাপ করে না, বরং তাদের ভুলগুলো বুঝতে পারে। তিনি বিসিএসএম চট্টগ্রাম ইউনিটের সম্মানিত উপদেষ্টা, তাই তার কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে আমি তার কাছে ছুটে যাই। তিনি আন্তরিকভাবে কথা শুনেন এবং ভালো পরমর্শ দেন। বলতে দ্বিধা নেই যে, আমি তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি এবং এই পর্যন্ত আসার পিছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসা রয়েছে আমার জীবনে।

তন্নী রায়: ২০১৪ সালে এর পোস্ট এসএইচসি প্রোগ্রামে মানিক দাদার সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমার কাছে একজন শিক্ষকসম। একজন লে পার্সন হিসেবে তিনি অনুকরণীয়। তার দেয়া কেরিয়ার গাইডেন্স আমার মত অনেক যুবক-যুবতীর জীবনের দিশা দিয়েছে। ওয়াইসিএস, বিসিএসএমসহ অনেক যুব সংগঠনে দাদার অবদান বলার অপেক্ষা রাখে না। মন্ডলী সম্পর্কে তার যে নিগুঢ় জ্ঞান তা কোনো ব্রতধারী-ব্রতধারিনীর থেকে কম নয়,  মন্ডলীর প্রতি দ্বায়িত্ববোধ ও ভালবাসা দ্বারাই তা সম্ভব হয়েছে। মানিক দাদার মতো মানুষ আছে বলে ব্রতধারী- ব্রতধারীনি ও সাধারণ জনগণের মধ্যে একটা সমন্বয় রয়েছে। পরলোগত মিঃ রবি খ্রিষ্টফার ডি’রোজারিও’কে বরিশাল তথা বাংলাদেশের সকল স্থানের খ্রিস্টভক্তদের প্রাণের মানুষ ছিলেন তিনি, মানিক দাদাকে চিনেছিলাম মিঃ রবি ডি রোজারিও-এর ভাতিজা হিসেবে। আজ মানিক দাদার মধ্যে তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। আমরা যারা যুবক-যুবতী রয়েছি আমাদের উচিৎ তার কাছ থেকে ক্যাথলিক ধর্মের নানা শিক্ষা সম্পর্কিত তথ্য সম্পর্কে জানা। মন্ডলীতে তার মত একজন উদার ব্যক্তি সেবাদান করে যাচ্ছেন; তার কাছে আমরা সকলেই কৃতজ্ঞ।

জ্যাষ্টিন গোমেজ : আমার বেড়ে উঠা চট্টগ্রামে হলেও মানিকদাকে আমি কখনও কাছ থেকে পায়নি। তাকে আমি সব সময় দূর থেকে দেখেছি। ২০১২ সালে বরিশালে পোস্ট এসএসসি প্রোগ্রামে তাকে আরো ভালভাবে অভিজ্ঞতার সুযোগ পাই। আমার অভিজ্ঞতায় তাকে আবিস্কার করেছি একজন প্রচণ্ড কর্মঠ ব্যক্তি হিসেবে। তাকে দেখেই আমার কেমন যেন ভাল লাগত। দাদার মধ্যে অন্য ধরনের একটা ব্যক্তি ফুঁটে থাকে সব সময়। অনেকের কাছে সেটা কঠোর মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে অমায়িক লাগে। তাকে দেখলে, তার সৃজনশীল কার্যকলাপ ও উপস্থাপনা দেখে আমি প্রতিবার মুগ্ধ হই। দাদা হয়তো নিজেই জানেন না, আমি তার কতো বড় ভক্ত। তার অনেক কিছুই আমি অনুসরণ করি। তিনি নিজেকে কি মনে করেন সেটা জানি না। তবে আমি মনে করি, তিনি আমাদের যুবসমাজের কাছে পাবলিক ফিগার। একদিন আমি আমার ব্যক্তিগত একটা কাজের জন্যে তার সাহায্য চেয়েছিলাম। আর অবাক করা বিষয় হলো, তিনি আমার জন্যে তা করেছিলেন অকপটে ও অতি সুন্দরভাবে। তাই আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। ধন্যবাদ মানিকদা। আর মৌরী বৌদির বিষয়ে না বললে কেমন যেন অপূর্ণতা থেকেই যায়। মনে হয়, দুজনকে ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে মানিয়েছে ভাল। বৌদিও খুব সুন্দর ব্যবহার করেন ও কঠোর পরিশ্রমী। 

👉 কম-বেশি যারা আপনাকে চেনে এবং জানে তাদের মুখে শোনা যায়, মানিকদা এতো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তারপরও ক্লান্ত দেখায় না। বরং কাজের পর কাজ করে যান। এখন প্রশ্ন হলো মূলত কোথা থেকে এতো এ্যানার্জি পান আপনার কাজগুলো আনন্দসহকারে করতে?

ঐ যে বললাম, ভালবাসা। মণ্ডলীকে আমি আমার নিজেরই ভাবি। আমি খ্রিস্টের দেহেরই অংশ। আমার নিষ্ক্রিয়তা মানে খ্রিস্টের দেহের একটি অংশের নিষ্ক্রিয়তা। খ্রিস্টের দেহের একটি অংশ প্যারালাইজ হোক তা আমি চাই না। আমার সেবাকাজটাকে তাই আমি ভালবাসি। এই ভালবাসাই আমাকে এনার্জি দেয়। সাধু পল আমার জীবনাদর্শ। তার একটি উক্তি আমার মস্তিষ্ক আর হৃদয়ে গেঁথে গেছে আর তা হলো, “হায় রে আমি, মঙ্গলসমাচার যদি না প্রচার করি!” এই উক্তিই আমাকে সজীব রাখে, আনন্দের সাথে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়। 

👉 আপনাকে দেখা যায় প্রায় কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। যেমনটা জ্যাষ্টিন গোমেজ বলেছে। এক্ষেত্রে পরিবার থেকে কেমন সমর্থন পান। পরিবরের সদস্য আপনার ব্যস্ততাকে কিভাবে দেখেন?

বিয়ের আগে আমার মা ও বোনেরা আমার ব্যস্ততা, দিনের পর দিন বাড়ির বাইরে থাকা নিয়ে কখনো আপত্তি করেনি। বাজার করা, অন্যান্য প্রয়োজন চালিয়ে নেয়া আমার মা ও বোনই দেখেছে। তাদের মধ্যে কোন কষ্ট দেখিনি, বরং সমর্থন পেয়েছি। বিয়ের পরে কিছুটা সংশয়ে ছিলাম, নতুন একজন মানুষ আমার এই জীবন, আর্থিক অবস্থা কিভাবে গ্রহণ করবে! তবে আমার স্ত্রী মৌরী পাড়ৈ আমার সব সংশয় মিটিয়ে দিয়েছে। তাকে আমি আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে পরিচয় করাতে পারিনি সময় এবং সম্পর্ক রক্ষায় আমার মনযোগের অভাবে। সে আমাকে অভিযোগ তো করেইনি, বরং নিজেই পরিচয় হয়ে নিয়েছে ও তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। পরিবার নিয়ে কোন সেলিব্রেশন, ঘুরতে যাওয়া আমি কখনোই পরিকল্পনা করতে পারি না। মৌরী একাই সব করে যাচ্ছে, অভিযোগ ছাড়াই। তাই চেষ্টা করি, তার পরিকল্পনা অনুযায়ী এসবে সাড়া দিতে ও অংশ নিতে। আমাদের বাসার কেনা-কাটা, বাজার, বাড়ির সবার কার কি প্রয়োজন, সবই আমার স্ত্রীই সামলায়। আমি সাথে থাকি মাঝে-মাঝে। সব সময় পারি না। অর্থবিত্তের জন্য, ভাল চাকুরীর জন্য ঘুর্নাক্ষরেও সে কোনদিন চাপ দেয়নি। আমার কাজটাকে সে শ্রদ্ধা করে, সমানভাবে ভালবাসে। আসলে, ঈশ্বরই যুগিয়ে দেন। মৌরীকে তাই তিনি আমার জীবনে নিয়ে এসেছেন। তার সমর্থন আমার জীবনে অনেক কিছু। আমার ৪ বছরের মেয়ের নাম মিরাবেল। তাকে সময় দিতে চেষ্টা করি। এই বয়সেও সে অনেক কিছু গ্রহণ করতে শিখেছে। আমি একটানা ১০-১৫ দিন যখন থাকি না, তখনো সে চিৎকার, চেঁচামেচি বা কান্নাকাটি করে না; মিস করে যদিও।  

👉 বর্তমানে আপনি আপনার জীবন নিয়ে কতটুকু সুখ অনুভূত করেন? আর তরুণদের উদ্দেশ্যে কিছু  মূল্যবান পারামর্শগুলো দিন? 

২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারী আমি মৌরী পাড়ৈ’র সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। আমাদের চার বছরের কন্যা মিরাবেল। বর্তমানে আমি আমার জীবন নিয়ে সুখী। আমার কাকা স্বর্গীয় রবি খ্রিস্টফার ডি’কস্তা বহু যুগ ধরে চট্টগ্রাম ও বরিশাল ডায়োসিসে সেবা দিয়েছেন। তিনি বলতেন, “তুমি জীবনে কতটুকু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আশা করছো, কতটুকু উচ্চাকাঙ্ক্ষা তোমার আছে; তার ওপরই নির্ভর করেই ঠিক করো মাণ্ডলীক সেবাকাজ করবে নাকি অন্য কোন পেশায় যাবে। নতুবা ২০-২৫ বছর পর তোমার বন্ধু ও সহপাঠীদের অবস্থান দেখে তুমি নিজের জীবন নিয়ে অসুখী হতে পারো।” কাকার পরামর্শে অনেক চিন্তা করেই এসেছি। লোভনীয় অনেক চাকুরীর আমন্ত্রণও পেয়েছি বেশ কয়েকবার। কোনবারই যেতে পারিনি। ঐশরাজ্যের জন্য কাজ করে যাওয়াটা রক্তে ঢুকে গেছে। নিজেকে এই জীবনের বাইরে ভাবতেই পারি না। 

দীর্ঘ এক দশক যুব কার্যক্রমে জড়িত হওয়ায় অনেক যুবক-যুবতী আমাকে চেনে। কারো-কারো ভালবাসা পাওয়াতাই স্বাভাবিক, এটি আমার কোন যোগ্যতা নয়। আমি নিখুঁত ব্যক্তিত্বের অধিকারী নই। ব্যক্তিজীবনে আমার অনেক ত্রুটি আছে। তাই আমার আদর্শ অনুসরণ বা আমার মত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বা জরুরী নয়। বরং জরুরী হলো, আমার মধ্যে যদি ভাল কিছু থেকে থাকে, সেটুকু মাত্র খুঁজে বের করে অনুসরণ করা ও ত্রুটিগুলো পরিহার করা। 

যাজক ও সন্ন্যাসব্রতী ব্রাদার, সিস্টার হওয়া যেমন একটি আহ্বান, মাণ্ডলীক সেবাকর্মও তেমনি একটি আহ্বান। শুধুমাত্র বেতনভূক কর্মী হিসেবে মাণ্ডলীক সেবাকর্মী হওয়া যায় না। কারণ এখানে কম বেতনে, বেশি পরিশ্রমে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যেতে হয়। মণ্ডলীর কাজে যতটুকু কষ্টভোগ ও আত্মত্যাগ করতে হয়, মণ্ডলীকে ভাল না বাসলে তা কখনোই গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমার সুসজ্জিত, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কার্যালয় আছে ঠিকই, কিন্তু খুব কমই এই কার্যালয়ে বসতে পারি। কারণ আমার ছুটে বেড়াতে হয় শিক্ষাদানের জন্য। আমার শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি আছে ঠিকই, কিন্তু কাটাতে পারি না, কারণ শুক্রবারেই বিভিন্ন সভা, সেমিনার, কর্মশালা আয়োজন করতে হয়। আজ বিভিন্ন ডায়োসিসের কার্যালয়গুলোতে, বিভিন্ন কমিশন ও কমিটিতে, ধর্মপল্লীর কর্মী হিসেবে, কাটেখিস্ট হিসেবে তরুণরা এগিয়ে আসছে না। যেভাবে যাজকীয় ও সন্ন্যাসব্রতীয় জীবনে আহ্বানের ঘাটতি এসেছে, একইভাবে মাণ্ডলীক সেবাকর্মে যুবাদের এগিয়ে আসাতেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। কোন যুবা যদি আগ্রহ নিয়ে মাণ্ডলীক সেবাকর্মে এগিয়ে আসতে চায়, তবে তাকে সহযোগিতা করার জন্য যতটুকু সম্ভব, ততটুকু করতে আমি প্রস্তুত আছি সর্বান্তকরণে। 

আর বলতে চাই, নিজের জীবন নিয়ে সুখী থেকো। যতটুকু পেয়েছো, তার পুরোটাই পরমেশ্বরের দান। তোমার চাইতে ভাল যেমন অনেকেই আছে, তেমনি তোমার চাইতে কষ্টে আরো বেশি মানুষ আছে। ঈশ্বর তার প্রতিটি সৃষ্টির যত্ন নেন। যে যেখানেই কাজ করো না কেন- কষ্টভোগ, আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা, সততা, ন্যায্যতাকে জীবনের ভূষণ করে নিও। সর্বোপরি, কাজকে ভালবাসতে হবে, নয়তো কর্মক্ষেত্র নরকের সমতুল্য হয়ে উঠবে। কর্মক্ষেত্রে কারো বস হয়ো না, সহকর্মী হও। নির্দেশ দিয়ে নয়, তাদের মধ্যে তোমার প্রতি এমন ভালবাসা জাগাও যেন তোমায় একটুু সাহায্যের অপেক্ষায় তারা অধীর হয়ে থাকে। আমি মনে করি, জীবনে কষ্টভোগ, আত্মত্যাগ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়ন অনেক জরুরী। শুধু পেশাগত দক্ষতা অর্জন করে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার সাধনা চালানো যায় না। 

👉 শেষের কথা : মানিকদা আমার প্রিয় একজন মানুষ। তার ব্যক্তিত্বকে ভালবাসা ও ভাললাগার কারণেই তার সংগ্রামময় জীবন ও সফলতাকে ঘিরে ব্যক্তিধর্মী ফিচারটির আয়োজন। কোটি যুবপ্রাণ থেকে তাকে জানাই শ্রদ্ধা ও সম্মান। প্রার্থনা ও শুভকামনা এভাবেই সেবাদায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ হোক ও সেই সক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা তাকে দান করুক। এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে হাজারো যুবপ্রাণের জীবন আলোকিত হোক সেটাই প্রত্যাশা করি । 

‘কর্মক্ষেত্রে কারো বস হয়ো না, সহকর্মী হও। নির্দেশ দিয়ে নয়, তাদের মধ্যে তোমার প্রতি এমন ভালবাসা জাগাও যেন তোমায় একটুু সাহায্যের অপেক্ষায় তারা অধীর হয়ে থাকে।’                                                                  - মি. মানিক উইলভার ডি’কস্তা

 


Post a Comment

Previous Post Next Post