তিন কোটি মানুষের ভাগ্যবদলের সেতু

তিন কোটি মানুষের ভাগ্যবদলের সেতু

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতুকে টপকে বিশ্বে দীর্ঘতম সেতু হিসেবে এগারোতম স্থান দখল করে নিতে যাচ্ছে আমাদের স্বপ্নের সেতু পদ্মা সেতু।  বিশ্বের উত্তাল নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা অন্যতম অস্থির এক নদী। দুই তীরে ভাঙ্গা-গড়া চলে প্রতি বছরই। বর্ষাকালে এই নদীতে স্রোতের বেগ থাকে অনেক বেশি। পদ্মার ওপর এরকম একটি সেতু অনেকের কল্পনারও বাইরে ছিল। কেননা বিশ্বের বিশাল এবং প্রমত্ত নদীগুলোর একটি পদ্মা। এর দুই তীরকে সেতু দিয়ে বাধঁতে অনেক ঝুঁকির মোকাবেলা করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেননা পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ ৪০ হাজার কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। আর এমন একটি নদীর উপর সেতু নির্মাণ খুব চ্যালেঞ্জিং কাজ। পানি প্রবাহের দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের পর ২য় বৃহত্তম নদী পদ্মা। কাজটা এত সহজ নয়। খুবই কঠিন কাজ। আর এই কাজটি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্যে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। কেননা এই কাজে ঝুঁকির অভাব নেই এবং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও সাহসিকতার ফলে এমন স্বপ্ন আজ বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে এটি সবচেয়ে বড় প্রকল্প। 

তিন কোটি মানুষের ভাগ্যবদলের সেতু



প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৬ দশমিক ১৫ কি.মি. এর দ্বিতল সেতুতে উপরের তলায় চার লেনের সড়ক এবং নিচের তলায় ট্রেন লাইন থাকবে। আর প্রকল্প পরিকল্পনা ঠিকমতো বাস্তবায়ন হলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পাবে নতুন গর্বের স্থাপনা পদ্মা বহুমুখী সেতু। আর তাই তো শ্রমিকদের দম ফেলার সময় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তাদের ঘাম ঝরানো শ্রমে এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতু। যতই দিন যাচ্ছে, দৃষ্টির মধ্যে ততই পুরো সেতুটি স্পষ্ট হতে লাগল। পদ্মা সেতু শুধুমাত্র সড়ক সেতু নয়। একই সঙ্গে এই সেতু দিয়ে যাবে ট্রেন। এছাড়াও যাবে গ্যাস পাইপ লাইন এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। এর দুইতলা ব্রীজের ওপর দিয়ে যাবে গাড়ি, আর সেতুর নীচের লেভেলে থাকবে ট্রেন লাইন। 

বাণিজ্য সম্প্রসারণে পদ্মা সেতু হবে মাইলফলক। তখন গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা হবে রপ্তাণিমুখী। দারিদ্র্য নিরসন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি পাটশিল্প হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। সেতুকে ঘিরে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের। গতি ও মাত্র বাড়বে অভ্যন্তরীণ ও আন্তদেশীয় যান চলাচলের। সবমিলিয়ে সেতুর উভয় পাশে বিকাশ ঘটবে সুষম অর্থনীতির। আমাদের এই স্বপ্নের সেতু হয়ে গেলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ১.২ শতাংশ বাড়বে এবং প্রতিবছর ০.৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হবে। আমরা যদি যমুনা সেতুর প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে যে, ব্রিজের পশ্চিমাঞ্চলে পাবনা ও সিরাজঞ্জসহ অন্য জেলগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্রিজ নির্মণের আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এতে করে সেখানকার কৃষক সহজেই কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রিয় করতে পারছে মসৃণভাবে। এছাড়াও শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ার কারণে। বাস্তবিক এটি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার আয় বাড়াবে এবং নতুন-নতুন কাজের জোগান দেবে। আমাদের বিশ্বাস, উৎপাদিত খাদ্যশস্য এবং পণ্য বাজারজাতকরণে দ্রুত উন্নতি ঘটাবে এই সেতু। ফলে কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য আর নদীতে বা রাস্তায় ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। এছাড়াও মুমূর্ষ রোগীরা ঢাকায় এসে চিকিৎসা সেবা নিতে পারবে খুব দ্রুতই। দক্ষিণ অঞ্চলের টাটকা মাছ তখন ঢাকা শহরে পাওয়া যাবে সহজেই। এতে মাছের উৎপাদনও বাড়বে এবং অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে।  

দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সমগ্র দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণের নিমিত্তে নির্মিত হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন কর্মকান্ড রাজধানী থেকে পরিচালিত হয় কিন্তু এ উন্নয়নের সুবিধাগুলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পদ্মা বড় একটা বাঁধা। এছাড়াও দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দু’টি নৌবন্দরের একটি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থিত। একটি হল মংলা বন্দর এবং এটার সংশ্লিষ্ট পরিবহন ব্যবস্থায় পদ্মা সেতু ব্যবহারের বিকল্প নেই। সেতু দ্বারা সৃষ্ট যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি দ্বারা বন্দরটির সম্ভাব্য উপযুক্ত গ্রহণযোগ্যতা ও উপকারিতা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ তখন নদীপথে বাণিজ্য করা দেশগুলোর সাথে অধিক ব্যবসায়িক ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং জাতীয় উন্নয়নের কার্যকরী প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে গুরুত্ত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপশি উৎপাদন বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনসহ জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়েতে হওয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থার পাশাপাশি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ও সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রায় তিন কোটি মানুষের জীবনের পরিবর্তন আসবে। পদ্মা সেতু চালু হলে সমৃদ্ধ হবে দক্ষিণের অর্থনীতি। আর এ আশা নিয়ে বড়-বড় শিল্প গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও পুঁজিপতিরা। ইতোমধ্যে, পদ্মা সেতু ঘিরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্রশিল্প। সরকার, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিক্ষিত পদ্মা সেতু সুসম্পন্ন হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে গ্যাস প্রয়োজন হবে। এটি নিশ্চিত হলেই বাড়বে ব্যাপক কর্মসংস্থান। মংলা বন্দরে আসবে গতিশীলতা। কুয়াকাটায় যে পায়রা বন্দর নির্মিত হচ্ছে, সেটি সচল হবে। আর সবকিছু ভাল হলে আগামীতে চট্টগ্রামের পর বরিশাল হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র।

একথা স্বীকার করতে হবে যে, দেশের উন্নয়নে সরকার কিন্তু সুষম অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করে এগুচ্ছে। তার মধ্যে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য গৌরবের ও অর্থনীতির জন্য যুগান্তকারি একটি ঘটনা। আর এটি সরকারের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পদ্মা সেতু দেশের বৃহত্তম নদী যা পদ্মার উপর প্রস্তাবিত একটি বহুমুখী সেতু। এটা দেশের বৃহত্তম প্রকল্প এবং নির্মাণ পরবর্তী সময়ে এটা হবে দেশের সর্ববৃহৎ সেতু। উত্তর দিকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া উপকূল এবং দক্ষিণ দিকে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের জাজিরা উপকূল হল সেতুটির প্রস্তাবিত স্থান। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কি.মি. কমবে। এই সেতু চালু হলে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানী ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে। এছাড়াও স্থানীয় জনগণ উন্নততর স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য খুব সহজেই রাজধানী ঢাকা যেতে পারবে। বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ বা কমপক্ষে তিনকোটি মানুষ সরাসরি এই সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবে। আর সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধিকবার বলেছেন, সরকারের একটি অন্যতম উন্নয়ন প্রকল্প হলো পদ্মা সেতু। আর আমরা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশা করি, সবকিছু ভালভাবে সম্পন্ন হবে এবং আমাদের দেশ একদিন বিশ্বে নেতৃত্ব দানে অবদান রাখবে। আর সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নিরলস শ্রম থাকলে সেই দিন আর বেশি দূরে নেই।

 লেখক : জ্যাষ্টিন গোমেজ

Post a Comment

Previous Post Next Post