জীবন ও সমাজ ডেস্ক : বরিশাল ক্যাথিড্রাল ধর্মপল্লীর ধর্মপাল বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার সিএসসি ধর্মপল্লীর সহকারী পাল-পুরোহিত ফাদার লরেন্স লেকাভালীর এর একান্ত উদ্যোগ-পরামর্শ, ফাদারগণের অনুপ্রেরণা-সহায়তা এবং বরিশাল বিসিএসএম ইউনিট বর্তমানে বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনের মধ্যদিয়ে নতুন উদ্যোমে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমানে বিসিএসএম ফাদার লরেন্স লেকাভালী গমেজ ও ফাদার অনল টেরেন্স ডি’কস্তা সিএসসি, ২ জন প্রতিনিধিসহ নতুন ১৯ জন সদস্য নিয়ে পথ চলছে লক্ষ্য়ণীয়ভাবে।
তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য :
১. প্রতিনিয়ত মিটিং আয়োজন করা;
২. পবিত্র বাইবেলের আলোকে অনুধ্যান করে স্টাডি সেশন করা হচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে;
৩. একতা প্রতিষ্ঠায় নতুন-নতুন সদস্য গ্রহণ।
৪. বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন;
৫. কার্যকরী পরিষদের সাথে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও তা সম্পন্ন করা হচ্ছে (যেমন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, চলমান);
৬. ধর্মীয় ও জাতীয় বিভিন্ন দিবস উদ্যাপনে সক্রিয় অংশগহণ;
৭. পালক-পুরোহিতের সাথে যুক্ত থেকে ধর্মপল্লীর যেকোন কাজে অংশগ্রহণ;
৮. তপস্যাকাল এবং আগমনকালে ছোট-ছোট কর্মসূচি গ্রহণ;
৯. সচেতনতা জাগরণে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে (যেমন ব্যক্তিগতভাবে অনেকে পরিবেশ রক্ষায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট ও বার্তা প্রেরণ);
১০. কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ এবং পরামর্শদানে অংশ;
![]() |
করোনাকালে তৃতীয় লিঙ্গের পাশে বরিশাল বিসিএসএম ইউনিট |
👉 অনলাইনে মিটিং করেছি;
👉 সদস্যদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি;
👉 করোনাকালীন সময়ে আমরা ৪০টি পরিবারের পাশে ভালবাসার ত্রাণ উপহারসামগ্রী নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছি।
👉 আমরা বৃক্ষরোপণ অভিযান চলমান রেখে বৃক্ষরোপণ করেছি।
👉 পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস কর্তৃক ঘোষিত “প্রকৃতি ও পরিবেশ বর্ষ”-উপলক্ষে আমরা লেখা-লেখি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি।
👉 ছুড়ে ফেলা কৃষ্টি বাদ দিয়ে যেন আমরা গ্রহণীয় মনোভাবের মানুষ হতে পারি তার জন্য তৃতীয় লিংঙ্গের সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে তাদের সাথে সময় কাটিয়েছি এবং তারাও আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ধর্মপল্লীতে এসেছে ।
করোনাকালে দেশের তৃতীয় লিংঙ্গের পাশে দাঁড়াতে মূলত কোন বিষয়টি আপনাদের অনুপ্রাণিত করেছে?
পিতা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই যে, তিনি আমাদের সুন্দর একটি সুযোগ দিয়েছিলেন তৃতীয় লিংঙ্গের মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। আমাদের বরিশাল বিসিএসএম ইউনিট স্রষ্টার সৃষ্টি তৃতীয় লিংঙ্গের মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছিল। আর সেক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল তা হল “সৃষ্টির প্রশংসায় আমরা সকলে আহূত” অর্থাৎ আমরা যখন পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস কর্র্তৃক ঘোষিত “প্রকৃতি ও পরিবেশ” বর্ষ বা “লাউদাতো সি” নিয়ে চিন্তা করছি আর তখনই আমরা আবিস্কার করতে পেরেছি যে, তৃতীয় লিংঙ্গ অর্থাৎ আমরা যাদের হিজড়া বলে চিনি তারা মানুষ। আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি, বড় কিছু করতে না পারলেও ছোট-ছোট পদক্ষেপ নিতে পারি যা তৃতীয় লিংঙ্গেরাও যে মানুষ এবং আমরা একই স্রষ্টার সৃষ্টি তা উপলব্ধি করতে সহায়তা করবে। অর্থাৎ সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টা বিরাজমান এবং সৃষ্টির মধ্যদিয়েই আমরা ঈশ্বরের প্রশংসা করতে পারি আর সৃষ্টির যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব, এই চিন্তাধারাই আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে করোনাকালে তৃতীয় লিঙ্গের পাশে দাঁড়াতে।
তাদের সাথে একাত্ম হওয়ায় তারা অনুভূতি কেমন ছিল?
আমরা যখন এই উদ্যোগ সম্পর্কে তাদের জানাই যে, আমরা তাদের কাছে যেতে চাই প্রাথমিকভাবে তারা একটু ইতস্তত বোধ করলেও তারা আমাদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। লক্ষ্য করেছি তারাও আনন্দিত ছিল। তাদের সহভাগিতায় তারা বিভিন্ন দিক তুলে ধরলেও তাদের ব্যবহার ছিল খুব মার্জিত; এ থেকেই বুঝতে পারলাম খ্রীষ্ট ও তাঁর অনুসারী খ্রীস্টানদের প্রতি তাদের রয়েছে এক ভিন্ন ধারণা, তারা অনুভব করেছে যে আমরা কোন বৈষম্যের মধ্যে থাকি না আমরা সকলের জন্য কাজ ও সেবা দিয়ে যাই। তারা অনেকেই মনের কথা আমাদের সাথে প্রকাশ করে হালকা হয়েছিল। আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি তারা চায় সমাজে স্বাধীনভাবে এবং ন্যায্য অধিকার নিয়ে বসবাস করতে। মানুষের কাছ থেকে তারা ভাল ব্যবহার প্রত্যাশা করে। আমাদের সাথে একাত্ম হওয়ায় তারা আনন্দিত এবং খুশী। আমরা যখন তাদের সাথে কথা বলেছি আমাদের উপস্থিতি তাদেরকে কিছু সময়ের জন্য হলেও পরিবর্তন করেছিল, যেমন থাকার জায়গা পরিচ্ছন্ন করা, নিজেরা প্রস্তুত হওয়া অর্থাৎ তাদের বাসস্থানে অন্যদের স্বাগত করার একটি আকাঙ্ক্ষা চোখে পড়েছে।
তাদের সাথে কাটানোর কিছু সময় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিন বলেন :
আমরা যখন সেখানে গিয়েছি আমরা তাদের সাথে খুব সহজেই মিশে গিয়েছি। অনেক ভাল লেগেছে তাদের যার ফলে আমরা কৌতূহলমনা হয়ে তাদের সাথে কথা বলেছি যার মধ্যদিয়ে বিভিন্ন বিষয় আমরা জানতে পেরেছি। নিম্নে তার কিছু বিষয় তুলে ধরা হল:
পরিচয় হলো কাজলী নামের একজনের সাথে। তিনি হচ্ছেন গুরুমায়ের প্রিয় শিষ্যা। তিনি আমাদের সাথে সহভাগিতা করেন তার কাজল থেকে কাজলী হওয়ার কথা। ছেলে হিসেবে জন্ম নিলেও ছোটবেলা তাকে মেয়েদের কাপড় পরতে ভাল লাগত, মেয়েদের সাথে মিশতে ভাল লাগত, আর এজন্য তিনি মা-বাবার অনেক মারধরের শিকার হতেন। তার বয়স যখন সাত-আট তখন থেকেই তার চলাফেরায় মেয়েলি ভাবটা চলে আসে এবং উপলব্ধি করতে থাকেন যে, তিনি অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি স্বাভাবিক একজন মেয়ের মত চলাফেরা শুরু করেন কিন্তু রাস্তায় বের হলেই মানুষ বিভিন্ন বাজে মন্তব্য করতো যা তাকে বেশ কষ্ট দিত। তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয় ও ক্ষোভের সাথে বলেন, “আজ আমি একজন হিজড়া হওয়ার কারণে গাড়িতে আমার পাশে কেউ বসে না, আমি বসলে উঠে চলে যায়, বাসা ভাড়া নিতে গেলে পাই না।” তিনি আরো বলেন, তার পরিবারের সাথে বসবাস করতে তার খুব ইচ্ছা করে কিন্তু সমাজ ও মানুষের ভয়ে তার পরিবার তাকে গ্রহণ করে না। তার ভাস্তির বিয়েতেও তিনি যেতে পারেননি কারণ তার পরিবার থেকে তাকে জানানো হয়নি। তিনি তার অনেক কথা সহভাগিতা করেন। এভাবে অনেকের সহভাগিতা আমরা শুনলাম আর বুঝলাম প্রত্যেকজন হিজড়া সমাজে আশ্রয় না পেয়ে অন্তরে এক ভারী পাথর নিয়ে জীবন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আমরা অনুপ্রেরণা পেয়েছি আরো তাদের কাছে যেতে এবং তাদের মধ্যদিয়ে স্রষ্টার প্রশংসা করতে।
তাদের সাথে সংলাপে যে ঐক্য স্থাপন করেছেন আপনারা তা সত্যিই অতুলীয়। আর এতে অংশগ্রহণ করার আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলেন।
এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য খুবই ভিন্ন একটি অনুভূতি নিয়ে এসেছে। আমি তাদের সাথে একটি সংলাপ করতে পেরেছি। পূর্বে অনেক সময় হিজড়া দেখলে মনে কৌতুহল জাগত, তাদের দেখে হাসাহাসি করতাম কিন্তু এখন তাদের খুব কাছে গিয়ে তাদের সাথে মিশে, তাদের কষ্টের কথা শুনে ব্যক্তিগতভাবে অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছি তাদের পাশে দাঁড়াতে। অন্যদেরও উপলব্ধি করতে সহায়তা করতে পারব এই যে, হিজড়ারও মানুষ, আমরা একই স্রষ্টার সৃষ্টি তাই তাদের হেয় করা বা তাদের ব্যঙ্গ করা বা তাদের সুবিধাবঞ্চিত করার কোন অধিকার আমাদের নেই। আমি মনে করি, আমরা যদি সঠিক ধাপ অনুসরণ করে তাদের কাছে যাই, তাদের সাথে কথা বলি, তাদের কথা শুনি তা হলে তারা মানসিকভাবে বলবান হবে। এতে তারা আলোর সন্ধান পাবে এবং তাদের সমন্ধে আমাদের চিন্তাধারা পরিবর্তন হবে। তাহলেই তারা আমাদের সমাজে একটি ইতিবাচক অধিকার নিয়ে জীবন যাপন করতে পারবে। এবং এর মধ্যদিয়ে আমরা সকলে একই স্রষ্টার সৃষ্টি হয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করতে পারবো।
শেষের কথা : এভাবেই এগিয়ে যাক আমাদের সমাজের যুবসমাজের সংগঠন অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলো। বরিশাল বিসিএসএম ইউনিট যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা সকল যুবাদের অন্তরে অনুধাবিত হোক প্রতিনিয়ত। আর এভাবেই চারিদিকে ধ্বনিত হোক আমাদের যুবসমাজের জয়গান।
সাক্ষাৎকার প্রদানকারী : সেবাস্টিনা শাওলী বাড়ৈ
Facebook : Sebastina Shawle