দুধকুমার নদ ও মানুষের জীবন-জীবিকা

কাজল রোজারিও: ছোট বেলার কথা। এখন থেকে প্রায় ২০-২৫ বছর আগের ঘটনা। তখন স্কুলে পড়ালেখা করি কিনা সেটা ঠিক মনে পড়ে না। আর পড়ালেখা করলেও কেজি ক্লাশের বেশি নয়। কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম  জেলার ভূরুঙ্গামারি উপজেলা, পাইকেরছড়া ইউনিয়নের একটি গ্রামে। তিনটি বাস পরিবর্তন করতে হয়েছিল সে সময়। এক বাসে সরাসরি কুড়িগ্রাম যাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না তখন। বাস থেকে নেমে নদী পার হতে হয়েছিল নৌকায় করে। ভূরুঙ্গামারী উপজেলা ভারতীয় সীমান্তের খুবই নিকট। তিব্বতের কৈলাশ শৃঙ্গ থেকে উৎপত্তি ব্রহ্মপুত্র নদের। আর ভারতের সিকিম পর্বত থেকে উৎপত্তি হয় তিস্তা নদীর। ব্রহ্মপুত্র কুড়িগ্রাম এবং তিস্তা লালমনিরহাট জেলা দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে মিলিত হয়েছে। দুই নদীর স্রোত থেকেই বাংলাদেশের ব্রাহ্মপুত্র নদ। পাইকেরছড়া ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দুধকুমার নদ। 

বর্ষা মৌসুমে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে এই দুধকুমার নদ। নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যায় শত-শত ঘর-বাড়ি। বর্ষার মৌসুমে গিয়েছিলাম ভুরুঙ্গামারী তাই দেখেছিলাম পানির উথাল-পাথাল খেলা। নদীর পারে যাদের বাড়ি তাদের অধিকাংশই ছিল জেলে পরিবার। নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে তারা। একমাত্র পেশা নদীতে মাছ ধরা। যাদের টাকা-পয়সা আছে, তাদের হয়তো বাজারে ছোট-খাট মুদির দোকান ছিল। নদী, নৌকা এবং জীবন যেন একই সুত্রে গাঁথা। এই তিনের মধ্যে এক নীরব সম্পর্ক বিদ্যমান। ভরা বর্ষার মৌসুমে নদী বড় হয় এবং শুরু হয় নদীতে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা। নদী এবং সাগরপারের মানুষেরা অনেক সাহসী হয়। তবে ভরা মৌসুমে নদীর ভয়ংকর চিত্র দেখে মাঝি এবং জেলেরা তাদের সাহস হারায়। নদীতে মাছ ধরা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। জীবন রক্ষায় আয়ের কোন পথ না থাকায় তিন বেলা নয়, এক-দু’বেলা খেয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। ভাত খাওয়ার জন্য সবজী না থাকলে চাউল ভাজা খেয়ে জীবন ধারণ করে। এসবই  খুব কাছ থেকে দেখেছি, দূর থেকে শুনেছি উর্মিলার কলরব ধ্বনি । 

দুধকুমার নদ ও মানুষের  জীবন-জীবিকা

মনে পড়ে চালকুমড়া কুচি করে কেটে চিংড়ি দিয়ে রান্না করেছিল ঘন্ট। আহ্ কি সুস্বাদুই না ছিল খেতে। আর একদিন রান্না করেছিল চালকুমড়া আর সরিষা দিয়ে খাসি। দুটোই মজার খাবার ছিল। ছোট-ছোট ঘর, বাড়িতে অতিথি আসলে থাকার ব্যবস্থাও তাদের ছিল না সে সময়। তবে যতই অভাব-অনটন থাকুক না কেন তারা আতিথেয়তায় বেশ ভালো ছিল। তাদের সামর্থ অনুযায়ী অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল তারা। পাশের বাড়িগুলোও ঘুরে দেখেছি। কারো বাড়িতে অতিথি আসলে আশেপাশের মানুষজন দেখতে আসে। নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী অতিথিপরায়ণে সদা ব্যস্ত থাকে।

যে বাড়িতে গিয়েছিলাম সে পরিবারটি একটু স্বচ্ছল ছিল তাদের মতো করে। অভাব কাকে বলে অভাবী না হলে অথবা সেই পরিস্থিতিতে না পড়লে তা অনুধাবন করা যায় না। অভাব মানুষকে অনেক সময় নীরব হতে বাধ্য করে। টাকাওয়ালাদের চিন্তা আকাশ সমান অট্টালিকা তৈরি আর অভাবীদের চিন্তা কোনমতে কিভাবে রাত পার করা যায়। পাশের বাড়ির একটি মেয়ে ছিল মাত্র ১২ বছর। ওরা হিন্দু সম্প্রদায়ের, ওর বাবা পেশায় জেলে। মাছ ধরে সংসারের খরচ বহন করে। অভাবী সংসারে সদস্যও কম নয়। অভাব থাকা সত্বেও যেন যৌন ক্ষুধার কোন কমতি নেই। নেই কোন জন্মনিয়ন্ত্রণের সচেতনতা। হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্নশ্রেণির মানুষদের ক্ষেত্রে মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা বেশ কষ্টকর। একদিকে অভাবী সংসার, পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি আবার অন্যদিকে, নিম্নশ্রেণির মানুষ। মেয়েদের কোনমতে পাত্রস্থ করতে পারলেই যেন বাঁচে। সংসারের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে যেন সংসারের জন্য তা অভিশাপ! একেবারে নিম্নশ্রেণির মানুষ হলে যা হয়। 

একদিকে মেয়ে হলে মনে করা হচ্ছে, অভিশাপ; অন্যদিকে এর দায়টা নিজেদের কাঁধেই পড়ছে। এ দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। মন-মানসিকতা একটি বৃত্তের ভেতর অবস্থান করছে। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার প্রসার ব্যতীত কোনমতে আলোর পথের দেখা মিলবে না। যেখানে তিন বেলার আহার জোটে না, সেখানে শিক্ষার আলো পৌছানো কোন সহজ ব্যাপার নয়। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের যে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদার প্রয়োজন তা পূরণ করতেই হিমশিম খেতে হয়। পোশাকের কথা তো কল্পনাই করা যায় না! ১২ বছরের এবং এর উর্ধ্বে মেয়েদের শরীরে ছিল একটিমাত্র ব্লাউজ ও শুধু পেটিকোট। ১২/১৩ বছরের নিচে মেয়েদের শরীর পেটিকোট আর গামছা জড়ানো ছিল। ছেলেরাও যাদের ৫/৭ বছর উলঙ্গই ছিল কারণ সেসময় ঐ এলাকার মানুষদের চাহিদা অনুযায়ী পোশাক কিনার সামর্থ ছিল না। তবে যা ছিল বৃষ্টির দিনে তা একবার ভিজালে সহজে শুকায় না, তাই পড়ার অনুপযুক্ত থাকতো। অভাবের তাড়না এবং শিক্ষার আলো প্রবেশ করনি বলে ১২ বছরের কিশোরীকেই যেতে হতো স্বামীর ঘরে। কিছু বোঝার আগেই সংসারের দায়িত্ব নিতে হতো। বাল্যবিবাহ সেখানে নতুন কিছু নয়। বাল্যবিবাহের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তাদের। যে সময় দুরন্তপনায় মেতে থাকার কথা, সেখানে তার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হতো। বানের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো দুটি জীবনকে।

ভাঙ্গা-গড়ার জীবনে দুঃখ-কষ্ট অনিবার্য। নতুনভাবে জীবন সাজাতে না সাজাতেই পুনরায় সেই অভাবের সাথে আরও নতুন অভাব একইভাবে জর্জরিত করে। তাই সঠিকভাবে জীবন সাজাতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষার আলোতে আলোকিত হতে পারলে জীবনের সকল অভাব ঘুচে যাবে।

লেখককাজল রোজারিও, 

রাজশাহী থেকে

FacebookKazol Rozario

Email : kajolrozaria@gmail.com

[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]  


Post a Comment

Previous Post Next Post