মানবিক সহায়তা নিয়ে মানুষের পাশে বরিশাল ধর্মপ্রদেশ

লিটন আরিন্দা : বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত বরিশাল কাথলিক ধর্মপ্রদেশ। বৃহত্তর চট্রগ্রাম ধর্মপদেশ থেকে বিভক্ত হয়ে ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ মহামান্য প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস এম কস্তা সিএসসির অবদানে ভাতিকান সিটি হতে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস নতুন ধর্মপ্রদেশ হিসেবে বরিশাল কাথলিক ধর্মপ্রদেশকে স্বীকৃতি দান করেন। ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ধর্মপ্রদেশের শুভ যাত্রা শুরু হয়। এরপর বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার সিএসসি’র হাতে নতুন ধর্মপ্রদেশের দায়িত্ব দেয়া হয়। এবং ভিকার জেনালের হিসাবে ফাদার মাইকেল মিলন দেউরী’কে দ্বায়িত্ব দেয়া হয়।  সেসময় ১১টি জেলায় ছয়টি ধর্মপল্লীতে ১৬ হাজার খ্রিস্টভক্ত নিয়ে নতুন ডায়োসিসের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে ডায়োসিসের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার অনেক পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চলছে। বর্তমান বিশ্ব মহামারি করোনাকালীন বরিশাল কাথলিক ডায়োসিস সকল খ্রিস্টভক্তদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিয়ে এবং অর্থনৈতিকভাবে অসহায় ও অভাবি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বরিশাল কাথলিক ডায়োসিসের সেক্রেটারী ফাদার অনল টেরেন্স ডি’কস্তা সিএসসি’র সাথে সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে করোনা পরিস্তিস্থিতে অসহায় মানুষদের পাশে বরিশাল ডায়োসিসের একাত্মতা। “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য”, এই শ্লোগান অন্তরে ধারণ করে, বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার সামর্থ অনুযায়ী চেষ্টা করছেন করোনা পরিস্থিতে অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার জন্য এবং তাদের পাশে থাকার জন্য। আর তিনিও বলেছেন, এই অবস্থায় তাদের পাশে থাকাটাই হবে তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা। এবং আরো বলেন, করোনা মহামারীর কারণে যেখানে পৃথিবী আক্রান্ত, বহু মানুষ কর্মহীন, গৃহহীন, অসুস্থ, সেখানে কেউ স্বার্থপরের মতো নিজের চিন্তা করতে পারে না, তাই এই পরিস্থিতিতে ধনী-গরীবের ব্যবধান ভুলে গিয়ে একত্রে জীবন যাপন করাটাই আমাদের দায়িত্ব। করোনা এখনও শেষ হয়নি। তাই বিশ্বকে এই মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করতে প্রত্যেকেই যার-যার অবস্থান থেকে মানুষের পাশে দাঁড়াবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

মানবিক সহায়তা নিয়ে মানুষের পাশে  বরিশাল ধর্মপ্রদেশ
সাক্ষাৎকারে ছিলেন 
বরিশাল কাথলিক ডায়োসিসের সেক্রেটারী ফাদার অনল টেরেন্স ডি’কস্তা সিএসসি


করোনাকালীন সময়ে বরিশাল ধর্মপ্রদেশ মূলত কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? 

১৭ মার্চ ২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশ সরকারের লকডাউন ঘোষণা ও স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলার আহ্বানে, বরিশাল কাথলিক ডায়োসিসের সকল গির্জা, উপাসনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাবেশ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পোপের দপ্তর ও বাংলাদেশ বিশপ সম্মিলনীর সিদ্ধান্ত অনুসারে পূর্বপরিকল্পিত সকল কর্মসূচী স্থগিত করা হয়। প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথম অনলাইন প্রেসবিটারিয়ান মিটিং অর্থাৎ ধর্মপ্রদেশের যাজকদের অনলাইন যাজকসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় মহামারীর ভয়াবহতা ও করণীয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়।  এই মহামারীর বিষয়ে সচেতন হতে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সবাইকে আহ্বান করা হয় এবং সচেতনতামূলক নানাবিধ পোস্টার ও ফেস্টুন বিতরণ করা হয়। ধর্মপ্রদেশের ক্যাথেড্রাল ধর্মপল্লী থেকে প্রতি রবিবারে অনলাইন খ্রিস্টযাগ ও বিশেষ-বিশেষ প্রোগ্রাম সম্প্রচার করা হয়েছে। এবং ডায়োসিসের সামর্থ অনুযায়ী প্রতিটা ধর্মপল্লী ও ত্রাণ বিতরণের কার্যক্রমও পরিচালনা করা হয়েছে।

মহামারীর এই সঙ্কটময় পরিস্থিতির সময় বরিশাল ধর্মপ্রদেশের সব পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন তা সত্যিই অতুলনীয়। মূলত পরিবারগুলিকে কিভাবে ও কি ধরনের সহায়তা দান করেছেন? 

বরিশাল কাথলিক ডায়োসিস প্রতিটি ধর্মপল্লীর সকল খ্রিস্টভক্তদের আধ্যাত্মিক ও আর্থিক যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করেছে। জনগণের ব্যক্তিগত প্রার্থনার জন্য প্রতিটি গির্জার দরজা ও যাজকদের অফিস খোলা রাখা হয়েছে। এই সময়ে সকল মানুষই আর্থিক সঙ্কটে ছিল, তার মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি দরিদ্র ও অভাবীদের তালিকা প্রস্তুত করে ডায়োসিসের সামর্থ অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে তাদেরকে কয়েকবার ত্রাণ (অর্থ ও প্রয়োজনীয় খাবার) দেওয়া হয়েছে। ধর্মপল্লীর প্রতিটি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে মাস্ক, সেনিটাইজার, সাবান ও প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ করা হয়েছে। প্রতিটি গির্জা প্রাঙ্গনে হাত-পা ধুয়ে করোনা মুক্ত হওয়ার জন্য বেসিন-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কোন ভাল কাজ সুসম্পন্ন করতে সাধারণত বেগ পেতে হয়। আপনারা কি কোন কারণে বাঁধাগ্রস্ত হয়েছেন, যদি হয়ে থাকেন তাহলে কিভাবে তা মোকাবেলা করেছেন?

লকডাউনের সময় ত্রাণ বিতরণে যানবাহন চলাচলে একটি বাঁধা ছিল। বিশপ মহোদয়ের ও কারিতাস বরিশাল অঞ্চলের দুটো গাড়ী সরকারের বিশেষ অনুমোদনে সমস্ত ডায়োসিসে জরুরী ত্রাণ বিতরণে সেবা দিয়েছে। এই মহামারীর সঙ্কটকালে যেখানে সবারই সাহায্যের প্রয়োজন সেখানে তালিকা প্রস্তুত করা ও তাদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করা নিশ্চয়ই একটি সমস্যা ছিল, তারপরও সব সমস্যা মোকাবেলা করে মানুষের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রাইভেট স্কুলগুলো যেখানে ছাত্র বেতনের ওপর নির্ভরশীল সেখানে শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিরাট আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। তারপরও শিক্ষক ও কর্মচারীদের মাসিক বেতন প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বৈশ্বিক এই দুর্যোগকালীন খ্রিস্টভক্তদের পালকীয় যত্নে আপনাদের অগ্রণী ভূমিকা কি ছিল? 

সেবা কর দুঃখীজনে, সেবা কর আর্তজনে”, প্রয়োজনের তাগিদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো এতো যীশুরই শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। পুণ্যপিতা পোপ মহোদয় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণবশত প্রার্থনার আহ্বান করেছেন, প্রযুক্তির সহায়তায় জনগণকে সেসকল প্রার্থনায় অংশগহণ করতে সহায়তা করা হয়েছে। আধ্যাত্মিক যত্ন হিসেবে প্রতি রবিবারে ও বিশেষ-বিশেষ প্রোগ্রামে অনলাইন খ্রিস্টযাগের আয়োজন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি পালন করে রোগীদের বাড়ি পরিদর্শন, আশির্বাদ ও কম্যুনিয়ন বিতরণ অব্যাহত আছে। মৃতদের সৎকারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অনেকেরই গির্জায় আসা, খ্রিস্টযাগে অংশগ্রহণ করা, কম্যুনিয়ন গ্রহণ এসবের প্রতি জনগণের প্রবল ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও লকডাউন সংক্রান্ত ধর্মপ্রদেশের সকল নির্দেশনা গ্রহণ ও পালন করেছে।

এই মহামারীকালীন আপনাদের প্রতিজন কর্মীকে সেবাদানের ক্ষেত্রে কিরূপ ভূমিকা পালন করছেন? 

লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে অনেক কর্মীকে ছুটিতে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিজেরাই নিজেদের রান্নাসহ অন্যান্য কাজগুলো সম্পন্ন করেছি। কখনও-কখনও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাউকে কাজে ও কাউকে বাড়িতে রাখা হয়েছে। এক পর্যায়ে সকলকেই দায়িত্বে ফেরত আনা হয়েছে। তাদের বেতন ও ছুটি স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। তাদের পরিবারগুলোর প্রতিও বিশেষ খেয়াল রাখা হয়েছে।

উপকারী বন্ধুদের অবদানের কথা কি উল্লেখ করতে ইচ্ছুক যাদের কাছে আপনারা সত্যিই কৃতজ্ঞ। 

“মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য”, মহামারীর এই মহাদুর্যোগে অনেকেই আমাদের পাশে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, বিশেষ করে অর্থ ও পরিশ্রম দিয়ে সহায়তা করেছেন। জরুরী প্রজেক্ট লেখা, দাতা সংস্থার সাথে যোগাযোগ, ত্রাণ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও বিতরণে ফাদার, ব্রাদার, সিস্টার, সেমিনারীয়ান, প্রার্থীবৃন্দ ও গৃহকর্মীগণ উদারভাবে সাহায্য করেছেন। বিভিন্ন এনজিও, সরকার, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকেই আর্থিক সহায়তা দান করেছেন। তাদের প্রতি বরিশাল কাথলিক ডায়োসিস অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

মানবিকতার উদাহরণ তৈরি করেছেন বরিশাল কাথলিক ধর্মপ্রদেশ। তাদের উদারতায় সহায় পেয়েছে অসহায় মানুষ। এভাবে আরো অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হোক আমাদের সমাজে। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে এটাই তো স্বাভাবিক। আর এর ফলে আমাদের জীবন ও সমাজে সর্বত্রই জেগে ওঠুক মানবতা ও ধ্বনিত হোক মানবতার জয়গান। এভাবে সকলে সকলে পাশে থাকার অঙ্গীকার করি। 

Facbook :Liton Isaac Arinda

Gmail : litonarinda1996@gmail.com


[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]  


Post a Comment

Previous Post Next Post