মৃতদেহ এবং ফিউনারেল

রত্না বাড়ৈ (আমেরিকা প্রবাসী) : 

 “তোমার সমাধি ফুলে-ফুলে ঢাকা, কে বলে আজ তুমি নেই, তুমি আছ মন বলে তাই।”

 এহেন ভাবনায় সকলকেই একদিন চলে যেতে হবে না ফেরার দেশে। মাঝে-মধ্যে চিন্তা হয় জন্ম মৃত্যুর এই ভাগাভাগিটা না হলেই কি ভালো হতো না? আর কেনইবা সৃষ্টিকর্তা একই মাটি দিয়ে তৈরি করে এই নশ্বর ভুবনে পাঠিয়েছেন। আবার একই মাটিতে শুইয়ে রাখেন জীবনান্তে। হর-হামেশায় শোনা যায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা কিভাবে সম্ভব? হ্যাঁ, বিশ্বাস করি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে এখানে একটি প্রশ্ন আছে, তাহলে কি সৃষ্টিকর্তা যখন যাকে তাকে তুলে নিচ্ছেন। শুধু কি তার জন্য পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে ধরে নিতে হবে? কারণ তিনি তো প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তিনি আর কখনও পৃথিবীকে একেবারে ধ্বংস করে দিবেন না।

মৃতদেহ এবং ফিউনারেল

আসলে সৃষ্টিকর্তার রহস্য উদ্ঘাটন করতে কার সাধ্য আছে? ভাবতে অবাক লাগে বটে। আশ্চর্য হওয়াটাই স্বাভাবিক, কেননা মানুষ যে চামরার পোষাকে এই পৃথিবীতে আসে, আবার সেই পোষাকেই বিদায় নেয়। তারপরেও অবুঝ মানুষ এই নশ্বর পৃথিবীতে ভিটে-মাটি নিয়ে কতই না সংগ্রাম করে চলেছে জীরনের সঙ্গে।

সত্যিই অর্পূব ও অদ্ভুত তার কীর্তিকলাপ।  সৃষ্টিকর্তার এই  লীলাখেলা বোঝা বড় দায়। তবে জন্ম-মৃত্যু এ সবটাই যে বিধাতার হাতে। এসত্যকে তো কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কারণ জন্মিলে মরিতে হইবে বৈকি। পৃথিবীতে আসা অর্থ আবার ফিরে যেতে হবে। এই চিরসত্যকে মেনে নেওয়া ব্যতিরেকে মানব জাতির নিকট কোন বিকল্প নেই। আর সেই মৃত্যুদেহকে কেন্দ্র করে একটি ডেডবডিকে কেন্দ্র করে কতো যে সিস্টেম; কতো যে টাকার খেলা! এখানে বসবাসরত প্রত্যেকেই যেন ওই ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। কেননা জন্মিলে মরিতে হইবে। বাস্তব সত্যকে ধারণ করে কবরস্থ করাও যে চিরসত্য এবং জীবিতদের দায়িত্ব। আর সেকারণেই এখানে এটি একটি নিয়মের মধ্যে পড়েছে। না ঘটলে বিশ্বাস করা মুশকিলই বটে। তবে কিছুটা আমার পাঠকদের অবগতির জন্য লিপিবদ্ধ না করলে মনের ভিতরে আফসোসটা রয়েই যেত।

বলা যায় এটি একটি বিজনেস্। মৃত্যুদেহকে (ডেডবডি) নিয়ে যেন পুরো বিজনেসে মেতে উঠেছে এই ‘ফিউনারেল হোম’গুলোর মালিকেরা। প্রতিটি এলাকায় বলতে গেলে গিটে-গিটে কয়েকটি করে এই  ফিউনারেল হোম রয়েছে যারা মৃতদেহের সৎকার করে থাকে। এ যেন একটি রমরমা বিজনেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটা সত্য যে, তারা যেভাবে শ্রম দেয়, ঠিক সেভাবেই পারিশ্রমিক নিয়ে থাকে।

একজন ব্যক্তি শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সঙ্গে-সঙ্গে তার মৃতদেহ (ডেডবডি) আত্মীয়েরা সমর্পণ করে দেয় ফিউনারেল হোমের নিকট। আর সেকারণেই ফিউনারেল হোম এতটা প্রয়োজনীয় এই নাম্বার ওয়ান কান্ট্রিতে। যা বলে বুঝানো যাবে না। আর তাই তো ফিউনারেল হোমের খোঁজে বের হওয়াটা যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃতের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট। তা যেখানেই জীবনাবসান ঘটুক না কেন; হাসপাতাল কিংবা  ঘরে। ফিউনারেল হোমের সাহায্য ব্যাতিরেকে যেন অচল এ দেশের মানুষেরা। তবে স্মরণে রাখতে হবে, ভুলে গেলে চলবে না। ফিউনারেল হোমের নাম নেয়াটাই যেন ব্যায়বহুল। সে চিন্তাটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। তাই তো বাস্তব সত্যকে ধারণ করে এদেশের (আমেরিকা) মানুষ জীবিত অবস্থায় নিজের সমাধির জন্য কবর খরিদ করে কিংবা কিনে রাখে। ফিউনারেলের জন্য মোটা অঙ্কের ডলার গচ্ছিত রাখে। কেননা শেষ নিশ্বাসের পরে যেন তাকে পুড়ে ভষ্মিভূত হতে না হয়।

টাকার ব্যাপারটি একেকটি ডেডবডির জন্য অন্তত দশ থেকে পনের হাজার ডলার তো খরচ হয়ই। অনেক সময় আবার রুচির ওপর নির্ভর করে টাকার পরিমাণ। দামী জিনিসপত্রের দাম তো একটু বেশিই হবে। তা হতে পারে পনেরো থেকে বিশ হাজার ডলারও। তাছাড়া, দিনকে দিন দাম বাড়ছে, কমছে না। যেমন:  কফিন বক্স, ফুলের তোড়া, লিমজিন, কবরের জায়গা বরাদ্দ করা, ক্রয় করা, ফিউনারেল সার্ভিস পাস্টর যিনি পরিচালনা করবেন তার পারিশ্রমিক। বলা বাহুল্য, পাস্টরগণের বেতন ওটা অবশ্য নির্ধারিত থাকে। তাছাড়া, এটাই তো বাস্তবতা মৃত্যুর পরের ধাপ কবরস্থ করা। নিয়মানুসারে চিরসত্যকে তো মেনে নিতেই হবে। কবরস্থ তো করতেই হবে বা হতেই হবে। আর সেই কারণে এসব ব্যবস্থাগুলো যেন একটু মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সকলের নিকটই। অবশ্য দরকারীও বটে। শুধু একটুখানি কম দাম এবং বেশি দাম এই আর কি। তবে ধনাঢ্য যারা। উপঢৌকন দিয়ে যাদের ফিউনারেল বা শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করা হয়। তাদের জন্য তো একটু  লাকজারিয়াসভাবেই সমাধিস্ত করা হবে বৈকি।

নিম্নমানের হোক আর দামী হোক, প্রয়োজনীয় ডলার দিয়েই খালাশ। কেননা এসব কিছু রেডি করা একটু মুশকিল। বলতে গেলে অনেক কাঠখড়ি পোড়াতে হয়। সাধারণ মানুষদের পক্ষে সেটি একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া, সরকারের অনেক নিয়ম-কানুন তো রয়েছেই। সেক্ষেত্রে তাদের পরিবারকে কোন দৌঁড়ঝাঁপ করতে হয় না। এমতাবস্থায় চিন্তার কোন ভার বহন করতে হয় না। আর ফিউনারেল হোম-এর তো লাইসেন্স আছে। এ দেশে লাইসেন্স মানে জিন্দাবাদ। যে ধরণের ব্যবসাই করুক না কেন লাইসেন্স থাকতেই হবে।

এরপরে ফিউনারেল হোম কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়মানুসারে যথাযথভাবে সবকিছু সম্পন্ন করে থাকে। যদি কোনো মৃতুদেহ (ডেডবডি) ডোনেট করা থাকে। অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদিচ্ছায় তাদের শরীর (ডেডবডি) তথা সমস্ত অর্গানগুলো দান (ডোনেট) করে দিয়ে থাকে। যদি পুঙ্খানুপুঙ্খ ডকুমেন্টস আইন সম্মত থাকে। তখন তারা মৃতুদেহ (ডেডবডি) থেকে চোখ, হার্ট, লিভার, কিডনি, ব্রেইন ইত্যাদি সবকিছু সেই ডোনারদের কাছে  হ্যান্ডওভার করে দেয়।

অবশ্য ডেডবডিকে কবরস্থ করতে প্রায় সপ্তাহখানেক লেগে যায়। সেই কারণে শুনেছি ডেডবডির ভিতর থেকে পঁচে-গলে যাওয়া সম্ভবনাময় অর্গানগুলো তারা বের করে ফেলে এবং ইমবালমিং এর মাধ্যমে বডির ভিতর থেকে তরল পদার্থগুলোকে নির্গত করে ফেলা হয়। প্রবেশ করানো হয় ঔষধ (মেডিসিন)। যার মাধ্যমে ডেডবডি ধরাতলে রাখার টাইম পর্যন্ত সতেজ থাকে। বলা বাহুল্য, এই মেডিসিন প্রয়োগের পূর্বে তার আত্মীয়স্বজনদের পারিশ্রম অত্যন্ত গুরুত্বর্প্ণ। এরপর মেকাপের মাধ্যমে পোশাক-আশাক পরিয়ে অবিকল একজন জীবন্ত মানুষের মতো করেই ডেডবডটি ফিউনারেলের ফ্রিজজাত কক্ষে কফিন বক্সে  করে রেখে দেওয়া হয়। এরপর ফিউনারেল ডেট অনুসারে আত্মীয়স্বজনদের সম্মুখে উপস্থাপন করা হয়।

এদিকে মৃতের পরিবার আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষায় থাকে ফিউনারেল এবং সমাধির তারিখ (ডেট)-এর  আকাঙক্ষায়। কারণ অপেক্ষা ব্যতিরেকে পরিবার, স্বজনদের কিছুই করার থাকে না । শুধুমাত্র আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে শোক বিনিময় করা ব্যতিরেকে। এরপর তারিখ অনুসারে আপনজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-পরিজন সকলে ফিউনারেল হোমে এক সঙ্গে মিলিত হয়। বলা বাহুল্য, ফিউনারেল সার্ভিস শেষ হলে পরে মৃতদেহটিকে দামী লিমুজিন সাজিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের গাড়ির বহরের সামনে অতি নম্রতার সঙ্গে কবরস্থানে শেষকৃত্য সম্পন্নের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য বেড়িয়েল, এই দিনটিতে সবাই কলো ড্রেস পরিধান করে শোক প্রকাশ করে থাকে। একটি অনুভূতির কথা না বললে মনে হবে কিছুটা বোধহয় বাদ পরে গেল। যেটা হলো বাংলাদেশের একজন আপনজন স্বর্গবাসী হলে আত্মীয়দের কান্নায় বিলাপের শব্দে যেন দশ গ্রামের মানুষ একসাথে হয়।  কিন্তু এখানে একটুখানি চোখ মুছেই শেষ।

যা হোক ফিউনারেল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবার পরেই সমাধিস্থ করা হয়। তবে কফিন বক্সটি যখন সমাধিতে রাখা হয় বোঝাই যায় না কফিন বক্সটি মাটির নিচে রাখা হয়েছে। মনে হয় যেন এক বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে উঠল। চারিপার্শ্বে দেওয়াল, দেখে মনে হয় মাঝখানে ঘরটি। তাছাড়াও পরের কবরস্থানটিও সবুজ ঘাসে সজ্জিত থাকে। দেখতে একেবারে যেন কার্পেট বিছানো। ভিতরে কিছু বড় গাছ। ওগুলোর দূরত্ব যেন একই মাপে সীমাবদ্ধ। ফুলের বাগান যেন পবিত্রতার ছাপ। একেবারেই সিস্টেমেটিকভাবে লাইট পোস্টে লাইটগুলো  চব্বিশ ঘন্টা আলোকিত থাকে। বলা বাহুল্য, দিন-রাত দাঁড়োয়ান পাহারায় রত থাকে। তাদের ড্রেসআপ মিলিটারি বাহিনীর মত করে। একটি বিরাট পরিসরে কবরস্থানটি স্থাপন করা হয়েছে। সত্যি বলতে কি পরিবেশ পরিমণ্ডল দেখে যেন কিছুটা স্বর্গের অনুভূতি আসে।

আমেরিকার এই ফিউনারেল হোমে কত যে নিয়ম-কানুন রয়েছে। লিখতে গেলে যেন শেষ হতে চাইবে না। তাই শুধুমাত্র বিশেষ অংশটুকু তুলে ধরলাম।

[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com]  

Post a Comment

Previous Post Next Post