লিটন আরিন্দা: বাংলাদেশের বান্দরবানের মত দুর্গম এলাকায় এখনও শিক্ষা আলো ভালোভাবে ছড়ায়নি। সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলেও অনেকেই আর্থিকভাবে অ-স্বচ্ছলতার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। অনেক শিশুরাই তাদের শিক্ষালাভের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে না। হাজারো পরিবারের মধ্যে বেশিরভাগই বাস করে পাহাড়ী এলাকায় এবং তারা মূলত প্রকৃতির সাথে লড়াই করে জীবন-যাপন করে। স্কুলগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় এবং আদিবাসি শিশুদের বাড়ি থেকে তুলনামূলক দূরে থাকার ফলে এবং সেখানে আসা-যাওয়া করে শিক্ষা গ্রহণ করাও বেশ কঠিন। এছাড়াও, অনেক শিশুদের পরিবারই দরিদ্র, তাই তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশেষভাবে শিক্ষার আলো থেকে তারা বঞ্চিত। তাছাড়া আদিবাসী গোষ্ঠীর শিশুরা, ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু পরিবারের সন্তানেরা অথবা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী শিশুরাও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এসব শিশুদের বাবা-মায়েরা দরিদ্র আর বংশানুক্রমে তাদের সন্তানও এই দারিদ্র্যচক্রের মধ্যে আটকে যায়। অনেক মেয়ে শিশু বাল্যবিবাহের কারণে লেখাপড়া করার সুযোগ হারাচ্ছে। এসব বিষয়াদি অনুধাবন করে চট্টগ্রাম মহাধর্মপ্রদেশের প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস এম কস্তা সিএসসি পার্বত্য জেলা বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দুর্গম অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেছেন সেন্ট মেরী’স স্কুল। যা অত্র এলাকার নিরক্ষরতা দূরীকরণে মহতী এক পদক্ষেপ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি গৌরবের সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।
প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস এম কস্তা সিএসসি’র স্বপ্নের স্কুলটি আজ খ্রিস্টমণ্ডলীর সম্পদ সেন্ট মেরী’স স্কুল আলীকদম। পার্বত্য জেলা বান্দরবনের আলীকদম উপজেলার দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত এই স্কুলটি, বান্দরবান শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার ভিতরে আলীকদম দূরত্ব। প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস এম কস্তা সিএসসি দুর্গম পাহাড়ি ত্রিপুরাদের ভালোবেসে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই এই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন ব্রাদার রঞ্জন লূক পিউরীফিকেশন সিএসসি। নতুন প্রতিষ্ঠান হিসাবে শিক্ষা, পাহাড়ি কৃষ্টি-সংষ্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকার দিকসমূহ বিবেচনা করেই অবদান রেখে চলেছে স্কুলটি।
লিটন আরিন্দা এর সাক্ষাৎকার উঠে এসেছে প্রয়াত আর্চবিশপ মজেস এর স্বপ্নের স্কুলটি দুর্গম পাহাড়িদের স্কুলটি সেন্ট মেরী’স স্কুল আলীকদম এর কিছু দিক। সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে ছিলেন সেন্ট মেরী’স স্কুুল আলীকদম প্রতিষ্ঠার পর থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ব্রাদার রঞ্জন লূক পিউরীফিকেশন সিএসসি তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে স্কুলের সার্বিক দিক পরিবর্তন করছি এবং এখানের পাহাড়ি জীবনমান অনুযায়ী সৃষ্টি, কৃষ্টি-সংস্কৃতি স্কুল পরিচালনা করার চেষ্টা করছি। পাহাড়ি দুর্গম বলে অনেক কিছু চাইলেও সম্ভাবনা হয় না, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা পাসের হার যথেষ্ট ভালো। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী ১১ জন এর মধ্যে দুইজন হলিক্রস ব্রাদার ও একজন এলএইচসি সিস্টার কর্মরত আছেন। নতুন বিদ্যালয় হিসাবে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মোট সংখ্যা ৩৬৫ জন।
![]() |
বান্দরবানস্থ সেন্ট মেরী’স স্কুল আলীকদম |
স্কুলটি নিয়ে বিশপ মজেসের স্বপ্ন সম্বন্ধে কিছু বলুন।
প্রয়াত বিশপ একজন মহাপ্রাণ মানুষ ছিলেন। তার মতো বিচক্ষণ, দূরর্দশী, দরদী চিন্তাশীল বিশপ চট্টগ্রাম মহাধর্মপ্রদেশে বিশেষ আশীর্বাদ হিসাবে এসেছিল। তার দূরর্দশীতার ফলে চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো পার্বত্য বান্দরবানের দুর্গম, প্রত্যন্ত ও পাহাড়ী জনপদে একটি স্কুল স্থাপন। যার নাম সেন্ট মেরী’স স্কুল। তার স্বপ্ন ছিল এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী, বঞ্চিত, গরীব, মেধাবী ও অসহায় শিক্ষার্থীরা যেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারে এবং পরিবার সমাজ তথা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। যেহেতু কয়েক দশক যাবত আলীকদম উপজেলায় কোন কলেজ ছিল না, তাই বিশপ মহোদয়ের বড় স্বপ্ন ছিল, এই স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করবেন যেন এলাকার ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়। তার সকল কার্যক্রমের মধ্যে দেখেছি, তিনি প্রান্তিকদের গুরুত্ব দিতেন বেশি। আর তাই গুরুত্বসহকারে এই স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করেছেন। বিভিন্ন ধরনের বাঁধা থাকা সত্ত্বেও কাজটি সুসম্পন্ন করেছেন। আর পরিপূর্ণতা দান করেছেন।
করোনাকালে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম জানতে চাইলে বলেন : বিশ্ব করোনাভাইরাসে যখন সকল স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, তখন শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস আয়োজন করার চেষ্টা করেছি। শিক্ষকরাও যেন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে তার জন্য তাদের নিয়মিত বেতনের ব্যবস্থা করেছি। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরা যেন ঘরে থেকে যেন পড়াশুনা অব্যাহত রাখতে পারে সেজন্য অভিভাবকদের বার-বার কল করে বা মেসেজ করে করেছি। যখন দেখেছি, স্কুল খোলার সম্ভাবনা খুবই কম থাকায় তখন আমরা শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার কথা চিন্তা করে বাড়িতে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। যতদিন শিক্ষাব্যবস্থা পুরোদমে শুরু না হচ্ছে, ততদিন এভাবেই পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। তবে অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, বান্দরবান এলাকায় ছাত্র-ছাত্রীরা তেমন উপকৃত হয়নি। কারণ তাদের কাছে ইন্টারনেট পোঁছায়নি এবং মোবাইল বা লেপটপ কিছুই নেই। প্রথমত, তারা গরীব এবং দুর্গম এলাকা যেখানে এগুলো এগুলো সম্ভব হচ্ছে না।
যেহেতু, বিদ্যালয় এখনও আর্থিকভাবে তেমনটা স্বচ্ছল নয়, তাই করোনা মহামারিতে আর্থিকভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। আর ভৌগোলিকভাবে অত্র স্কুলের শিক্ষার্থীরা বান্দরবানের বিভিন্ন দুর্গম জায়গায় অবস্থান করায় তাদেরকে বিদ্যালয়মুখী করা সম্ভব ছিল না। তবে এই করোনায় তাদের মাস্ক দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
এই মহামারী করোনায় আমাদের সেবাদানের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, স্কুলের দৈন্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিমাসে শিক্ষকদের বেতন দিতে সক্ষম হয়েছে। যেন তাদের পরিবার নিয়ে ভালোভাবে জীবন-যাপন করতে পারে। এছাড়াও তাদের নিরাপত্তার কথা অনুধাবন করেই নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং তাদের খোজ-খবর নিয়ে একে অন্যের পাশে থাকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। স্কুল থেকে না হলেও উপজেলা থেকে শিক্ষকদের জন্য ত্রানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে ব্রাদার সকল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন : আগামীতে যারা দেশের নেতৃত্ব দিবে, তাদেরকেই আমরা লালন-পালন করছি। কুমারের হাতে নরম কাঁদা মাটি যেমন, তেমনি আমাদের হাতেও নরম মাটির মত আমাদের শিক্ষার্থীরা। আমরা যেভাবে শিক্ষা দিব, তারা সেভাবেই বেড়েও উঠবে; যেভাবে গঠন দিবো সেভাবেই গড়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদেরও উচিত তাদের আদর্শ মানুষ হয়ে বেড়ে উঠা। পিতা-মাতার বাধ্য থেকে নিয়মিতভাবে লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করা এবং সঠিক মানুষ হওয়া। লক্ষ্যণীয় যে, কিছু ছাত্র-ছাত্রী পিতামাতার বাধ্য থাকতে চায় না। আমি তাদের বলবো, তারা যেন পিতা-মাতার বাধ্য থাকে, গুরুজনকে সম্মান করে এবং ছোটদের স্নেহ করে। নৈতিকভাবে তাদের যেন কোন অবক্ষয় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। বর্তমান প্রজন্মের বিরাট একটি অংশ নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যা সামাজিক অবক্ষয় হিসাবে দেখা যাচ্ছে। এটি রোধকল্পে ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতন হওয়ার জরুরী।
মিডিয়া/গণমাধ্যম এর দ্বারা সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হতে পারে বলে আমি ধারণা করি যেমন অপ-সংস্কৃতির কুপ্রভাব এবং প্রযুক্তির অত্যাধিক সহজলভ্যতা। বর্তমানে প্রযুক্তিগত কল্যাণে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বিদেশী অনুকরণীয়তা এবং বিভিন্ন অপ-সংস্কৃতির কুপ্রভাব আমাদের সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। অপসংস্কৃতির সহজলভ্যতা যা প্রযুক্তির কল্যাণে হাতের মুঠোয় পাওয়া যাচ্ছে তা সামাজিক অবক্ষয় ঘটাতে সাহায্য করছে। এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে প্রযুক্তি নির্ভর একটি জেনারেশন গড়ে ওঠেছে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা, পারিবারিক অসচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচারিতার ফলে এ তথ্য-প্রযুক্তির চরম অপব্যবহার সামাজিক অবক্ষয়ের এক অন্ধকার দিকের সূচনা করছে। এই ব্যাপারে অভিভাবকসহ সকলকেই সচেতন হওয়া জরুরী। তবে গণমাধ্যম নিসন্দেহে আমাদের কাছে কার্যকরী একটি মাধ্যম, যা দ্বারা আমরা বর্হিবিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে পারি ও এর ইতিবাচক প্রভাবগুলো আমাদের মধ্যে বিদ্যমান।
👉সেন্ট মেরী’স স্কুল আলীকদম নিসন্দেহে স্বাক্ষরতা বৃদ্ধিতে একটি বাতিঘর সম যা আর্চবিশপ মজেসের মহতী উদ্যেগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আলোকিত মানুষ গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তাই এখানে দরিদ্র পরিবারগুলোকে মূলত গুরুত্ব দেয়া হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনা করে উচ্চমানের পাঠদান করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে স্কুল প্রধান শিক্ষক ব্রাদার লূক রঞ্জন প্রতিজ্ঞাবদ্ধভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সেজন্যই এর লক্ষ্য অতি দরিদ্র এবং অবহেলিত গোষ্ঠীর পরিবারের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ গড়ে তোলা। প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হলো, অতিদরিদ্র এবং অবহেলিত গোষ্ঠী বা পরিবারের শিশুদের সমান শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। আর তাদের ভালো ভবিষ্যতের লক্ষ্যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশের বান্দরবানের মত দূর্গম এলাকায় যেখানে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষাটুকু পায় না; সেখানে আর্চবিশপের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে হচ্ছে পূরণ হয়েছে হাজারো শিশুর শিক্ষালাভের স্বপ্ন। এভাবেই প্রতিষ্ঠানটির ইতিবাচক শিক্ষাকার্যক্রমের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠুক ভবিষ্যত কর্ণধারেরা এটাই প্রত্যাশা।
[জীবন ও সমাজে পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]
Tags:
ফিচার