কাজল রোজারিও :
“দুটি সন্তানের বেশি নয় একটি হলে ভালো হয়” এর বিপরীতে আছে “সন্তান দিয়েছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি” এই কথা দুটি অনেক দিন হলো আর শোনা যায় না। এর অর্থ এই নয় যে, সন্তান জন্মের হার হ্রাস পেয়েছে। বিয়ে যখন হচ্ছে, তখন সন্তান জন্ম তো হবেই। এটা তো মানুষের জৈবিক অধিকার। বাল্যবিবাহ এখনও হ্রাস পেলো না বরং বেড়েই চলছে উর্ধ্ব গতিতে! মেয়ের ১৩ বছর হলেই হয়ে যায় ১৮ বছর আর ছেলের ১৮ বছর না হতেই হয়ে যায় ২১। জন্ম নিবন্ধনে আর আহামরি ব্যাপার নয় মেয়ের বয়স ১৩ কে ১৮ আর ১৮ কে ২১ বছর করতে। আর তাই ঘটে চলছে অবারিত। আর সেই বাল্যবিবাহ পাচ্ছে আইনগত স্বীকৃতি। কারণ কাগজপত্রে বয়সের কোন ঝামেলা নেই। নেই কোন যাচাই-বাছাইয়ের তোয়াক্কা। বিয়ে দিতে পারলেই যেন পিতা-মাতার দায়িত্ব শেষ!
রোজ স্কুলে যাওয়া পূর্বে 'মা' লাল ফিতা দিয়ে যার চুল বেঁধে দেয়, যে কিনা নিজের দায়িত্বটাই নিজে নিতে পারেনা বা বুঝতে পারে না সে কিভাবে স্বামী- স্ত্রী, সন্তানের দায়িত্ব নিবে সেটাই প্রশ্ন। বিয়ে, পরিবার, সন্তান জন্মদানের জন্য যে শারীরিক-মানসিক গঠন, প্রস্তুতির এবং পরিপক্বতার প্রয়োজন তা এখনও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে দানা বাঁধেনি। কিন্তু কিশোর মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই জীবন ধ্বংসাত্মক বীজ। যেখানের সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্বে অসচেতনতা প্রকাশ পায়। তাদের মতে, কোনমতে বিয়ে দিয়ে মাথার বোঝা কমাতে পারলেই তারা বেঁচে যায়। পিতা-মাতার এমন ভাবনা-চিন্তা নষ্ট করছে হাজারো সন্তানের জীবন।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯ এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ সংশোধন আইন- ২০১৭ এর মতে, যাদের অর্থাৎ মেয়ের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১৮ বছর এবং ছেলের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২১ বছর বয়স তারা হল প্রাপ্ত বয়স্ক। যারা ২১ বছর পূর্ণ করেননি এবং ১৮ বছর পূর্ণ করেননি এমন পুরুষ-নারী অপ্রাপ্তবয়স্ক। বাল্যবিবাহ: “বাল্যবিবাহ হলো এইরূপ বিবাহ যার কোন এক পক্ষ বা উভয়পক্ষ অপ্রাপ্তবয়স্ক।” তবে কিছু ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক যে কারো বিয়ে হতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি থাকতে হবে।
বাল্যবিবাহ
যখন কোন ছেলে-মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক অথবা উভয়ের একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন সে বিবাহ আইনগত বৈধ নয়। তবে কে বা কারা এর খবর রাখে? বিয়ে হয়ে গেলে উভয়ই একসাথে বসবাস করার আইনগত স্বীকৃতি পেয়ে যায়। কিন্তু এ স্বীকৃতি কতটা যুক্তিসঙ্গত তা প্রশ্নবিদ্ধ। করোনাকালে এবং করোনা থেকে আরও ভয়ানক বিষের থাবায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে হাজারো কিশোর-কিশোরীদের। যার নাম হলো 'বাল্যবিবাহ'।অন্যদিকে, একজন মেয়ের শরীর থেকে কাঁচা হলুদের গন্ধ যায়নি, যেখানে মেয়েটির হাতে লেগে থাকা মেহেদীর রঙ মুছে যায়নি; সেখানে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে হাজারো ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশে সরকারি হিসাব মতে, বাল্যবিবাহের হার ৫২%। বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকারী বাংলাদেশ। কথাগুলো এখন শুধু পাঠ্যবই আর শিক্ষকের মুখেই শোভা পায়। আর এরকম হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ মানুষ গড়ার কারিগরের কাছে যখন কিশোরীকে ক্লাসরুমে ধর্ষিত হয়, প্রাইভেট পড়ানোর নামে যখন ধর্ষিত হয়, কিশোরী বয়সে বিয়ের প্রস্তাব পেতে হয়; তখন নিরাপত্তাহীন মেয়ে ও তার অভিভাবক বাধ্য হয়ে মেয়ের জন্য আশ্রয় খোঁজে আর তা হল বাল্যবিবাহ।
বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি, যার সৃষ্টিও ভুক্তভোগী এবং এর জন্য দায়ী সমাজব্যবস্থা। আর সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারের অংশ। সুতরাং বলা যায় যে, এটি মূলত কেন্দ্র থেকেই জাত। আইনের শাসন আছে, কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। তাই, পরিবার থেকেই বাল্যবিবাহ রোধে এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। তাই প্রসঙ্গতই গুণীজন বলেছেন-
“সৎ পথে চলব সত্য কথা বলব
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব”
বাল্যবিবাহ সংগঠিত হওয়ার কারণসমূহ হলো:
- দারিদ্র্যতা
- সুশিক্ষা ও শতভাগ শিক্ষার অভাব
- পারিবারিক অসচেতনতা ও গণসচেতনতার অভাব
- পরিবারে মেয়েদের প্রাধান্য কম দেওয়া
- সামাজিক নিরাপত্তার অভাব
- অধিক সন্তান জন্মদান
- ধর্মীয় গোঁড়ামি
- যৌতুক প্রথা
- আইনের যথাযথ ব্যবস্থার অভাব
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
- নারী সমাজের বোঝা
বাল্যবিবাহের কুফল:
- ভিত্তি মজবুত হয় না
- শারীরিক ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি
- মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি
- পুষ্টিহীনতা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি
- রক্ত এবং পানি শূন্যতা
- অধিক সন্তান জন্মদান
- রোগাক্রান্ত ও চিকিৎসা ব্যয়
- পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পায়
- প্রতিবন্ধী বা অস্বাভাবিক শিশু জন্মদান
- পরিবার ভাঙন
- পরিবারের বোঝা হয়
বাল্যবিবাহ নিরোধে করণীয়:
- সুশিক্ষার বিস্তার
- দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ
- পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সচেতনতা গড়ে তোলা
- আইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা
- নারী সমাজের বোঝা নয় সম্পদ
- যৌতুক প্রথা বন্ধ
- নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- নারী সচেতনতা গড়ে তোলা
- সভা, সেমিনার, লিফলেট, নাটিকার মাধ্যমে
- জন্ম নিবন্ধনে বয়স কমানো বা বাড়ানোর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা
- সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এর কুফল তুলে ধরা
- যুব সমাজকে বাল্যবিবাহে নিরুৎসাহিত করা
- স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের ভূমিকা পালন করা
- বিভিন্ন সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সচেতনতা গড়ে তোলা
- ধর্মীয় গোঁড়ামি বন্ধ করা
তবে ১৮ বছর হলে প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র নিশ্চিত করা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যাতীত কোন বিয়ে সংগঠিত হতে পারবে না, এই আইন প্রণয়ন করলে বাল্যবিবাহ রোধ অনেকাংশে হ্রাস পাবে।বাল্যবিবাহ সংগঠিত হওয়ার অনেক কারণ, কুফল এবং করণীয় লক্ষণীয়। তবে নিজেকে সচেতন হতে হবে এবং অন্যের মাঝে এ সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সব কিছুর মূলে রয়েছে, পারিবারিক সচেতনতা, দারিদ্র্যতা বিমোচন ও শিক্ষার প্রসার।
kazolrozario@gmail.com | |
[ জীবন ও সমাজে পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]