ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতা নির্ধারণে শীথিলতা প্রয়োজন

রাশেদুজ্জামান রাকিব : 

১৯৭১ সালের পর দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোন পাবলিক পরীক্ষায় অটো-প্রমোশন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ১৯৭১ সালে দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে শিক্ষাব্যবস্থার কার্যক্রম ব্যহত হওয়ায় সে সময় অটো-প্রমোশন দিয়েছিল সরকার। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি এখন সমগ্র বিশ্বে। চলমান বিশ্বেও সকল কার্যক্রমে এর প্রভাব অকল্পনীয়। শিক্ষাব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়ায় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে জেএসসি, পিএসসি; এরপর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। 

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় পিএসসি এবং জেএসসি এর গুরুত্ব কোন সময়ই লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু এ বছর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেএসসি ও এসএসসি-এর ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসি এর ফলাফল নির্ধারণ করার সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যার পরিপ্রেক্ষিতে, জেএসসি’র ফলাফল গুরুত্ব পাচ্ছে এবারই প্রথম।সরকারের এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১.০৬ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশেও ৩৭৫ হাজার আক্রান্তের পাশাপাশি মারা গেছে প্রায় ৫৪৬০জন। দেশের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তা অনিশ্চিত। করোনা সংক্রমণের ফলে দীর্ঘ ৬মাস আটকে থাকা এইচএসসি পরীক্ষা স্বাস্থ্যবিধি মেনেও গ্রহণ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কেননা, যে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে কোন পরীক্ষার্থী কিংবা তার পরিবারের কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে তার করণীয় কি হবে? তাই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া কখনই উচিত হবে না। 

 ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতা নির্ধারণে শীথিলতা প্রয়োজন

সরাকরের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করা স্বাভাবিক। অসংখ্য শিক্ষার্থী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলবে। কারণ, প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অনুযায়ী এইচএসসি ও এসএসসি এর ফলাফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে এইচএসসি ও এসএসসি ফলাফলের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা প্রকাশ পায়। জেএসসি এর গুরুত্ব কখনই ছিলো না। জেএসসি পরীক্ষার গুরুত্ব না থাকায় বহু সংখ্যক শিক্ষার্থী জেএসসি এর তুলনায় এসএসসি ও এইচএসসি’তে ভাল ফলাফল করতো। জেএসসি ও এসএসসি এর ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসি এর ফলাফল দিলে কিছু সংখ্যক শিক্ষাির্থী লাভবান এবং কিছু সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা কম হলেও তাদের সাথে এ রকম ফলাফলের মাধ্যমে অন্যায় করা যায় না। যদি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী জিপিএ দ্বারাও ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়, তা হবে অন্যায় এবং অনুচিত। সামান্য পয়েন্টের জন্য যদি কোন শিক্ষার্থী তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়, কিংবা সে যদি নিজে প্রমাণ করার জন্য এইচএসসি এবং ভর্তি পরীক্ষা কোনটাতেই অংশগ্রহণ করতে না পারে, তাহলে, অবশ্যই তার সাথে অন্যায় করা হবে। সুতরাং সরকারকে অবশ্যই এ বছর ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতা নির্ধারণে শীথিলতা আনতে হবে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় অধিক শিক্ষার্থীকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করার শেষ সুযোগটুকু দিতে হবে। 

গত বছরগুলোর পরীক্ষার ফলাফল, পরীক্ষার্থী ও জিপিএ-৫ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় মোট ১৩,৫১,৫০৫ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে যাদের ৭৩.৯৩% পাশ করেছিল। ২০১৮ সালে ১৩,১১,৪৫৭ জন অংশগ্রহণ কর। পাশ করেছিল মাত্র ৬৬.৬৪% পরীক্ষার্থী। এ বছর অটো প্রমোশনে শতভাগ পাশ করানো হবে। এই ফলাফল কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এই প্রজন্মের শিক্ষার মান নিয়ে ভবিষ্যতে কি প্রশ্ন উঠবে না। চাকুরীর ক্ষেত্রে সাধারণত ৩-৪ বছরের পার্থক্যের শিক্ষার্থীরা চাকুরীসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যেন অবহেলার শিকার না হয়, তার দায়ভার কে নিবে?  

জেএসসি- ২০১৯ এ মোট জিপিত্র-৫ ছিল ৭৮,৪২৯জন। ২০১৮ তে মোট ছিল ৬৮,৯০৫জন। এসএসসি- ২০১৯ এ মোট জিপিএ-৫ ছিল ১,০৫,৯৫৪ জন এবং ২০১৮ তে ছিল ১,১০,৬২৯ জন। জেএসসি আর এসএসসির গড় করলে প্রায় ৯০ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ- ৫ পাওয়ার কথা, সেখানে এইচএসসি ২০১৯ এ জিপিএ-৫ ছিল মাত্র ৪৭,২৮৬ জন এবং ২০১৮ তে ছিল মাত্র ২৯,২৬২ জন। 

শিক্ষাব্যবস্থায় সেখানে জিপিএ-৫ কে প্রাধান্য দেয়া হয়, সেখানে প্রকৃত মেধাবি কিংবা এইচএসসি’তে প্রকৃত ভাল শিক্ষার্থী নির্বাচনের ওপর এক ধরণের প্রভাব পড়বেই তা নিশ্চিত। এটাই স্বাভাবিক যে, এইচএসসি পরীক্ষা নিলে কম জিপিএ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই হয়তো তুলনামূলক ভালো করত। তাই এই সিন্ধান্তে এসে শিক্ষার্থীরা কতটুকু সন্তুষ্টজনক ফলাফল পাবে তা নিয়ে সন্দিহান। অধিক সংখ্যক জিপিএ-৫ পেলে, কিছু দুর্বল শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় তুলনামূলকভাবে যোগ্যতায় এগিয়ে থাকবে। আবার সামান্য কারণে কোন ভাল শিক্ষার্থীও পিছিয়ে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে অবশ্যই সর্তকতামূলক সিদ্ধান্তটি পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। অন্যদিকে, মেডিক্যালসহ অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষায় এইচএসসি ফলাফলের জন্য আলাদা নম্বর প্রযোজ্য না করা উচিত। 

২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রচুর পরিমাণ শিক্ষার্থী পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পেয়ে অধিক নম্বর অর্জন করেছিল। জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের অনেকেই প্রশ্ন পেয়েছিল। সে ক্ষেত্রে নম্বর অর্জনে ভালো শিক্ষার্থীও পিছিয়ে পড়েছিল। সমযের গরিমায় সেসব ঘটনা এখন ধামাচাপা পড়েছে। প্রশাসনিক কারণে কেউই হয়তো প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি এখন শিকার করবে না। তবে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। তাহলে, এ বছর প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক জিপিএ-৫ পেতে যাচ্ছে। ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অনেক বেশি গুরুত্ব রাখে। মেডিক্যাল ভর্তিতে এসএসসি ও এইচএসসি এর জিপিএ-৫ প্রায় ২০০ মার্ক, যা মেধাতালিকায় প্রভাব ফেলে। 

এখন এইচএসসি ফলাফলে যারা ভালো ফলাফল অর্জন করবে, প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে কারা ভাল শিক্ষার্থী, তা যাচাই করা মোটামুটি কষ্টকর। ভাল শিক্ষার্থীদের নিজেকে প্রমাণ করার একমাত্র সুযোগ এখন ভর্তি পরীক্ষা। তাই ভর্তি পরীক্ষায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে সুযোগ প্রদান করা উচিত। বিষয়টি যতই চ্যালেঞ্জের হোক, সরকারকে এ বিষয়ে শিথিলতা প্রয়োজন। 

কোভিড-১৯ এর সঙ্কটকালীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান ধরে রাখতে এইচএসসি পর্যায়ে ভালো মানের শিক্ষার্থী নির্বাচন করা চ্যালেঞ্জিং হলেও সরকারকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোন শিক্ষার্থীর উপর যেন অন্যায় না করা হয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ দেয়া উচিত। 


[জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ] 


Post a Comment

Previous Post Next Post