বাঁচতে চাই

 কাজল রোজারিও : 

তখনও আমি বাবার কাছেই ছিলাম। শান্ত ছিলাম, আমায় কেউ চিনতো না তখন। আবদ্ধ ছিলাম তাই বাইরের আলো চোখে পড়েনি। বাবার শরীরটা মাঝে মাঝে খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠতো। কেমন জানি হিংস্রতার জন্ম নেয় বাবার মধ্যে। এরকম প্রায়শই ঘটে, তবে বুঝতে পারি না কেন এরকম হয়! একটা সময় বাবা একজন নারীকে নিয়ে আসে তার রুমের ভেতর। জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ রাত ছিল। এক ফোঁটা বীর্য যখন তোমার জরায়ুতে ঠাঁই পেয়েছিল, সে ছিলাম আমি। সেই রাতে লাখো শুক্রানুর মাঝে আমিও লুকিয়ে ছিলাম একই সাগরের মাঝে। আমরা সবাই দৌঁড় প্রতিযোগিতায় মত্ত ছিলাম। কে কাকে হারিয়ে কে প্রথম হবো। এ এক মরণ খেলা। যে জিতবে, সেই শুধু বাঁচবে বাঁকি সবাইকে মরতে হবে। সেখানেও ভয় ছিল কিন্তু সে প্রতিযোগিতায় আমি সেদিন জয়লাভ করেছিলাম। সবাইকে পিছনে ফেলে আমি সবার আগেই পৌঁছে ছিলাম। অনেকেই রাস্তায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কেউ দৌঁড়াতে গিয়ে রাস্তার বাইরে চলে গেল লক্ষ্যহীনভাবে। কেউ ছিটকে পড়লো বনের ধারে। আবার কেউ দুর্বল হয়ে পায়ের তলায় পিসে মারা গেল। আর আমি সেই যে দৌঁড় শুরু করেছিলাম, ঠিক লাল নিশানাটি অতিক্রম করে তবেই থেমেছি। আমিই একমাত্র শক্তিশালী ছিলাম সকলের মধ্যে। একজন নারী আমাকে সহযোগিতা করেছিল। তাই আর বুঝতে বাঁকি রইলো না যে, সেই নারীই আমার 'মা'। 

বাঁচতে চাই 

আমার মনে হলো অন্তত একটি নিরাপদ জায়গায় এসে পৌঁছাতে পেরেছি। মা কিন্তু প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিল তার মধ্যে একটা পরিবর্তনের চিহ্ন। আশার সঞ্চার হয়েছিল। মনে-মনে কল্পনায় ছবি এঁকে ছিল আমার। তবে একটু সময় লাগবে কল্পনা গভীর হতে। কিছু দিন পর মা নিশ্চিত হতে পারলো যে, সুপ্ত একটি কলির সৃষ্টি হয়েছে। আমি মায়ের জঠরে অন্ধকার গভীরে লুকিয়ে ছিলাম। পৃথিবী কেমন তার কোন ধারণা ছিল না আমার! তবে শুনেছি পৃথিবী অনেক সুন্দর। একদিন আলোর সন্ধান হবে। আমাকে আর আবদ্ধ থাকতে হবে না মায়ের অন্ধকার গর্ভে। দুচোখ ভরে দেখতে চাই তাকে যিনি আমাকে পরম যত্নে আগলে রাখছে। আমার যেন কোন প্রকার কষ্ট না হয় সেদিকে সর্বদাই যত্নবান তিনি। আমাকে নিয়ে মায়ের যত চিন্তা-ভাবনা আছে সবই আমি জানতে পারি, শুনতে পারি। তাই আমিও মনে-মনে অনেক স্বপ্ন এঁকে ছিলাম সুন্দর ধরণী নিয়ে।

অনেক দিন পর আবার মার সাথে বাবার দেখা হয়। মা বাবাকে পেয়ে অত্যন্ত খুশী। এতো খুশী তারপরও এতদিন তা চেপে গিয়েছে বাবার কাছে। মার একান্ত ইচ্ছে ছিল এই খুশীর সংবাদটা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলবে, এই তুমি বাবা হতে চলেছ। বাবা সেদিন কামনার দাবী নিয়েই এসেছিল মার কাছে। আমি কিন্তু ধীরে-ধীরে বড় হতে চলেছি। বাবা যখন মাকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসা বিনিময় করছিল ঠিক তখনই মা বাবাকে এই সুখবরটা দিল যে, এই তুমি কিন্তু বাবা হতে চলেছ! তুমি খুশী হওনি? এই কথার কোন গুরুত্বই যেন পেল না বাবার কাছে। বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার! আমি চাই মা-বাবার মধ্যে এই ভালোবাসা চিরদিন অটুট থাকুক। মার কথায় তেমন গুরুত্ব পেল না। কামনার অগ্রাধিকার এখন বেশি। কিন্তু মা থেমে থাকেনি আবারও বলল এই কথা। বাবার হাতটি মার পেটের উপর আলতোভাবে বুলিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি বাবা হতে চলেছ। বাবা হাতটি মার পেটের উপর থেকে সরিয়ে নিলো, রীতিমতো চমকে উঠলো! এর আগে বাবাকে মা অনেকবার বিয়ে করার কথা বলেছে কিন্তু বাবা কোনমতেই রাজি হয়নি। এক নিমেষেই যেন বাবার চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। বাবা রীতিমতো অস্বীকার করছে এবং আমি যে পৃথিবীর মুখ দেখতে না পাই সেই ব্যবস্থা করতে। সে কখনও মেনে নিবে না আমাকে। আমাকে যেন ধ্বংস করা হয় সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মা কোনমতেই রাজি নন। বাবার এই ব্যবহার আমায় খুবই কষ্ট দিচ্ছে। বাবা মাকে ঐ মূহুর্তে একা রেখে চলে যায়। আমরা দুজনই এখন নিস্ব। 

আমি শুধু বার-বার একটি কথাই বলেছি আমি 'বাঁচতে চাই'.... আমাকে তোমরা মেরো না, একটি সুযোগ দাও। আমি একবার পৃথিবীর আলো দেখতে চাই। আমি তোমার মুখখানা একবার দেখতে চাই মা। তোমাকে জড়িয়ে ধরে একবার মা বলতে চাই। আমার কি আর মা বলা হবে না? আমি বাঁচতে চাই। আমাকে মেরে ফেলো না বাবা। মাকে তুমি বাধ্য কর না। শুধু একটি সুযোগ চাই বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু সে শুনলো না আমার আর্তনাদ। তখন মার সিদ্ধান্ত ছিল তিনি আমাকে পৃথিবীর আলো দেখাবে। আর তখন আমিও মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার কোন বাবা নেই। কোনদিন তার মুখ দেখবো না। সে আমার বাবা হতে পারে না কখনও। তিন মিনিটের উচ্ছ্বাসে মেতে ছিলে এক মিনিটের সুখের আশায়। ভালোবেসেছ যখন তাহলে কেন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না? রঙ্গমঞ্চে যৌবনে আবেগের জৌলুসে মত্ত ছিলে তখন। কাঁচা মাংসের স্বাদ-গন্ধে জিভ থেকে লালা ঝরে ছিল, কই তখন তো একবারও বলনি যে, তোমাদের কোন কামনা-বাসনা নেই! তোমাদের কোন ক্ষুধা নেই! যৌন ক্ষুধায় হিংস্র হায়েনার মতো উত্তপ্ত শরীরে, অন্য একটা শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে। মাংসপিণ্ডই তোমার কাছে ছিল অমৃত যাতে হয়ছিলে তৃপ্ত? যা লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে পারবে না তবে কেন ভোগ করেছিলে? 

এই তোমাদের মতো যারা, তোমরা তো আমার মতো হাজার-হাজার ভ্রুণ হত্যা করে চলেছ অবিরাম। হাজারো সম্পদ এখন ঘুমিয়ে আছে আবর্জনার স্তুপে। যেখানে কোন পশুর ভোজের উপযুক্ত খাবার হিসেবেই অংশ নিতে হয়েছে। যে বাবা-মা তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে, তারা কখনও মানুষ হতে পারে না। পশুর থেকেও অধম। তোমরা শুধু দেহের পূজারী। শরীরকে ঘিরে ছিল তোমাদের যত কামনা-বাসনা, যত আয়োজন। এই যে নারী তুমিও শেষ পর্যন্ত আমাকে রক্ষা করতে পারনি। তুমি শেষ পর্যন্ত হেরে গেলে পরাজয় মেনে নিয়ে। হেরে গেলে পুরুষ শাসিত সমাজে। হেরে গেলে সমাজ ব্যবস্থার কাছে, পরিবারের কাছে। "যা তুমি হারিয়েছ, সেটা ছিল তোমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।" তুমি কিভাবে এই ঘৃণ্যতম কাজ করতে পারলে? আমাকে যখন তোমার দেহ থেকে আলাদা করা হচ্ছিল, তখন অনেক চিৎকার করে বলেছিলাম, বাঁচতে চাই বাঁচতে চাই.....।  শেষ পর্যন্ত গলা টিপেই শান্ত হলে! তুমিই পারতে আমাকে রক্ষা করতে কিন্তু তুমি তা করোনি। তোমাদের প্রতি আমার কোন রাগ-অভিমান নেই, কোন অভিযোগও নেই। কাউকে অভিশপ্তও করছি না। শুধু এইটুকু অনুরোধ, আমার মতো যেন আর কোন ভ্রুণকে পশুর এক বেলার খাবার হতে না হয়।

kazolrozario@gmail.com


[  জীবন ও সমাজে   পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]


Post a Comment

Previous Post Next Post