![]() |
কীর্তিমান প্রবীণ লেখক সুনীল পেরেরা |
শুরুতে তিনি মূলত অভিনয় জগতের বাসিন্দা ছিলেন। ১৯৯৮ সাল থেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা ও অভিনয় শুরু করেন প্রবীণ প্রতিভাবান লেখক সুনীল পেরেরা। খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রের বাণীদীপ্তি’র বেশিরভাগ প্রোগ্রাম তার লেখা ও পরিচালনায় হয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি ডকুমেন্টারির স্ক্রিপ্ট লিখেছেন ও দক্ষতার পরিচালনা করেছেন।
চাকুরি জীবনের প্রারম্ভে তিনি ১২ বছর যাবত তথ্য দফতরে সরকারি চাকুরীতে
নিয়োজিত ছিলেন। এরপর ২৮ বছর কারিতাস বাংলাদেশ এর প্রজেক্টে কাজ করেছেন। আর বর্তমানে অবসর জীবনে খ্রীষ্টীয় যোগাযোগ কেন্দ্রে ১০ বছর ধরে সহায়তা করে যাচ্ছন। লেখকের অবসর সময় কাটে লেখালেখি করে। তিনি স্বভাবতই সাহিত্য সম্বন্ধে বই পড়েন। প্রথম জীবনে ডিকেটটিভ
শ্রেণির বই পড়তেন। কবিতার বই খুব অল্পই পড়েছেন। উপন্যাস, গল্প ও নাটক এসবই
ছিল তার পাঠ্য বিষয়। লক্ষণীয় বিষয় হল, সমাজসেবা তার জীবনের বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে।কর্মজীবনে সবার সাথে বন্ধুত্বসূলভ
সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
👉তার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, ৬০ বছর ধরেই তো আপনি সাহিত্য চর্চা করছেন। মূলত কবে থেকে সাহিত্যের যাত্রা শুরু করেছেন ও আপনার অনুপ্রেরণার উৎস কি?
তিনি বলেন : ১৯৬০ সাল থেকেই আমার লেখালেখির যাত্রা শুরু হয় সাপ্তাহিক প্রতিবেশীতে লেখার মধ্যদিয়ে। তারপর বিভিন্ন সাময়িকীতেও লিখতে শুরু করি। সাহিত্য চর্চাটা আমার কাছে অনেকটা নেশার মত । স্কুল জীবনে ছোট-ছোট নাটিকা লিখে অভিনয় করতাম। প্রথমত, গল্প লেখতাম তারপর ধীরে-ধীরে নাটক, প্রবন্ধ, টেলিভিশন স্ক্রিপ্ট, তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য এবং কিছু গান রচনার দিকে ঝুঁকে পড়ি।
সাক্ষাৎকারে আরো জানা যায়, কৈশোর থেকেই তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর জাগরণী সংঘ, তুমিলিয়া বালক উচ্চ বিদ্যালয় এবং ভাওয়াল খ্রীষ্টান যুব সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। এ ছাড়া গ্রামে-শহরে বিভিন্ন সংঘ সমিতির সাথে জড়িত। তুমিলিয়া মিশন ক্রেডিট ইউনিয়ন এর দুই টার্মের প্রেসিডেন্ট, কালব এর পরিচালক মণ্ডলীর সদস্য এবং বর্তমানে তিনি চড়াখোলায় নতুন গির্জা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তি।
👉যখন জানতে চাওয়া হয়, আপনার পারিবারিক জীবন কেমন অতিবাহিত হচ্ছে? আপনার সন্তানদের বিষয়ে কিছু বলুন। অবসর সময় কিভাবে কাটানো হয়?
তিনি বলেন : তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বেশ ভালভাবেই কাটছে পারিবারিক জীবন। তিনজনই বিয়ে করেছে। তিনজন নাতি-নাতনীর মধ্যে দুইজন ঢাকায়, একজন লণ্ডনে তার বাবা-মার সাথে। বড় ছেলে লণ্ডনে প্রবাসী ও তার স্ত্রী পেশায় একজন এমবিবিএস ডাক্তার। ছোট ছেলে স্ত্রীসহ কানাডায় থাকে। অবসরে এক নাতিকে স্কুলে নিয়ে যাই ও তার সাথে সময় কাটাই। সপ্তাহে দুইদিন প্রতিবেশী অফিসে আসি।
👉 লেখককে যখন প্রশ্ন করা হয়, আপনি বিভিন্ন সাময়িকি, ম্যাগাজিন ইত্যাদিতে লিখেছেন, আপনি কেন-কোন বই প্রকাশ করেননি?
লিখতে-লিখতে যে এত সময় পার হয়ে গেছে বুঝতে উঠতে পারিনি। বই প্রকাশ করিনি এই কারণেই যে, আমার লেখা বিভিন্ন জায়গায় ছাপা হচ্ছে এতেই আমি খুশী। তাছাড়া অর্থেরও একটা ব্যাপার আছে। বই তো বিক্রি হবে না। আমার সম্পাদিত প্রথম বই হলো, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমরা: খ্রীষ্টানদের অবদান’, এরপর ‘পালক সাধক আর্চবিশপ মাইকেল রোজারিও’ এবং ‘ঈশ্বরের সেবক আর্চবিশপ থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী বাংলাদেশ মণ্ডলীর গৌরব । আমার লেখা ছোট গল্প আছে ৮০টিরও বেশি, এবং নাটক ১৭টি। নাটক ও গল্পের সংকলন করার প্রস্তুতি চলছে।
সুনীল পেরেরা মূলত সাবলীল ভাষায় লিখতেই পছন্দ করেন। কঠিন কোন কিছু কিংবা নিরীক্ষাধর্মী কোন জটিল বিষয় লিখতে আগ্রহী নন। আর ইদানিং নাটক ও টেলিভিশন স্ক্রিপ্ট লেখার প্রতি বেশ মনোযোগি হচ্ছেন তিনি। লিখতে বসলে সময়ের প্রতি খেয়াল থাকে না লেখকের। তিনি বলেন, মনে হয় আজীবন লিখতে পারলে ভাল হতো। আর নবীন লেখকদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি জানি না নবীনরা কিভাবে আমাকে গ্রহণ করে। খ্রিস্টান লেখকগণ তেমন সমাদৃত হয় না কোথাও। তাছাড়া আমাদের লেখকগণ অনেকটাই খ্রিস্টীয় সাহিত্য রচনা করে থাকে যা অন্যান্য সাহিত্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। তবে খোকন কোড়ায়ার লেখা অনেকটা সর্বজনীন হয়। মূলত প্রয়াত নিধন ডি’রোজারিও ছিলেন তার পথিকৃত।
👉উল্লেখ্য, সারা বিশ্ব যখন করোনার করাল গ্রাসে, তখন তিনিও রেহায় পাননি এর থাবা থেকে। আর এমন পরিস্থিতিতে তিনি মনোবল নিয়ে করোনাকে জয় করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। লেখককে করোনাভাইরাস জয়ী হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন-
করোনাভাইরাসের রক্ত পরীক্ষার ফলাফল যেদিন মহাখালী থেকে জানানো হয়, সেদিন অনুভব করেছিলাম আমার আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই। করোনায় এত কষ্ট জানা ছিল
না। করোনার সাথে আমার ক্রমাগত ডায়রিয়া শুরু হয়। দিনে রাতে ৮বার পাতলা পায়খানা হলে এবং এটা যদি একমাসের অধিক হয় তাতে সেই রোগি বাঁচার কথা নয়। কষ্টের কারণে প্রথমে মৃত্যু কামনা করেছি। নিজেই নিশ্বাস বন্ধ রেখে মরতেও চেয়েছি। পরে উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, করোনাকে জয় করতে হলে মনোবল দরকার। সেই আত্মবিশ্বাসে ও চিকিৎসার ফলেই সুস্থ হয়েছি। একেকটা ট্যাবলেট কিনেছি ৪০০ টাকা করে। এটা ৭০টা খেয়েছি। এছাড়া সেলাইন ও অন্যান্য ঔষধ এবং হাসপাতালের আরও খরচ তো ছিলই। পরিবারে পাঁচজন সদস্য সবাই একসাথে আক্রান্ত হয়েছিলাম। এখন সকলেই সুস্থ।
আমাদের সমাজের নবীন লেখকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রচুর বই পড়তে হবে। লেখার চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। দুই চারটা লেখা ছাপার পরেই যেন বই প্রকাশের চিন্তা না করি। বই ছাপানোটাই বড় কথা নয়। লেখনির মধ্যদিয়ে সমাজকে কতটুকু জ্ঞান দিতে পেরেছি সেটাই বড় প্রাপ্য।
সুনীল পেরেরা-এর মত প্রতিভাবান লেখক আমাদের সমাজের ও দেশের
অমূল্য সম্পদ। মানসম্পন্ন সাহিত্য সৃষ্টির রুচিবোধ সৃষ্টি করতে হলে সুনীল পেররার মত
প্রবীণ লেখকদের রচিত সাহিত্য পড়তে হবে। লেখকের যৌবকালের অগ্রসর চিন্তা ও ধারণা
সুরুচিবোধ তৈরি করুক উত্তরসূরীদের। প্রবীণ এই লেখকের জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে রচিত
সৃষ্টিকর্ম, আগ্রহী ও বই পড়ুয়াদের আলোকিত করুক যুগের পর যুগ এবং স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকুক
চিরকাল।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : জাসিন্তা আরেং ও জ্যাষ্টিন গোমেজ
[ জীবন ও সমাজে পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]