রত্না বাড়ৈ ( আমেরিকা প্রবাসী) : বার্ধক্য যেন একটি দূরারোগ্য ব্যাধির ন্যায়। আর তাই তো যখন কোন বয়স্ক লোক দেখি, তখন যেন নিজের ভবিষ্যতের কথা স্মরণে আসে। মনের মধ্যে আওড়াতে থাকি, ওনারা তো অতীতে আমার মতোই ছিলেন। ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। বার্ধক্য! সে কি ভয়াবহ, যেন মরণঘাতী ক্যানসার রোগকেও হার মানায়। ‘মৃত্যু অপেক্ষা’ বিষয়টিই যেন দেহে এক ধরনের শিহরণ সৃষ্টি করে। তবে “বার্ধক্য” এর হাত থেকে কেউই রক্ষা পাবে না। তা শরীরে যতই চন্দনের প্রলেপ লেপন করা হোক না কেন অথবা টাকার বিছানায় শুয়ে থাক্ না কেন? কারণ এটি সৃষ্টিকর্তার কারসাজি, তাঁরই বিধান। মৃত্যুও তেমনি কাউকে ছাড়ে না। তেমনি পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না। পাপের বেতন একমাত্র মৃত্যু।
 |
বার্ধক্য |
সত্যি বার্ধক্য মানব দেহের সমস্ত শক্তি-সামর্থ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবকিছু কেঁড়ে নেয় সৃষ্টিকর্তার ঐ গোপন রহস্যকে ঘিরে, ক্ষীণ হয়ে আসে যৌবনদীপ্ত জীবন। “জন্মিলে মরিতে হইবে”-এটি বাস্তব ও তিক্ত সত্য কথা। নিশ্বাসের কোন বিশ্বাস নেই। কেননা মৃত্যু কখনো বলে কয়ে আসে না। কোন বছরের ক্যালেন্ডারের কোন তারিখটি কার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে সেটি কেউ জানে না। কখন যে ঐ প্রতীক্ষিত ডাক আসবে তা কারো বোধগম্য নয়। তবে গড় আয়ুর হিসেব মোতাবেক বার্ধক্যে উপনীতগণ অনুমান করে থাকেন, তাদের সময় সন্নিকটে। শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনা মাত্র। তাছাড়া এই বয়সটিতে মৃত্যুর ভয় সারাক্ষণ মনকে বিচলিত করে রাখে। তাড়নায় আরো ব্যাকুল করে দেয় বার্ধক্যের সকল ভালো লাগাকে। তার উপরে আবার হরহামেশাই মৃত্যু সংবাদে হৃৎপিণ্ড ধুক্-ধুক্ করতে থাকে। মনের কুটিরে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। জীবনের সন্ধিক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেয় অপেক্ষমান ঐ মৃত্যু দ্বারপ্রান্তে শুধু একটি কলিং বেলের আদেশ মাত্র। এহেন অবস্থায় আবার ছেলে-মেয়েদের শাসন ও পুত্রবধুদের অমর্যাদাপূর্ণ আচরণ। যাদেরকে পিতামাতা গড়েছিলেন মনের মাধুরী মিশিয়ে, আদরে-সোহাগে, হৃদয়ের অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে এবং নিজের জীবন বাজি রেখে। আপন দায়িত্বে যথেষ্ট সুখ-সমৃদ্ধির মাঝে গড়েছেন। কিন্তু সেই মানুষ আজ বোঝাস্বরূপ সকলের নিকট। প্রাণপ্রিয় সন্তানদের বিহনে কাটান একাকী জীবন।
যাদের ভবিষ্যত গড়ার চিন্তায় আত্মত্যাগ করেছেন, জীবনের কত বিনোদনকেই না বিসর্জন দিয়েছেন। জীবনের সাথে লড়াই করেছেন আদুরে সন্তানদের ভবিষ্যতকে ভাবনায়, নিজের সুখ-আহলাদ জলাঞ্জলি দিয়েছেন। নিজের শরীরের কথা না ভেবে মরিয়া হয়ে ছুটেছেন সন্তানদের একটুখানি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বিন্দু-বিন্দু রক্তক্ষরণে, শরীরে শক্তি সঞ্চয়ের ফলে তিলে-তিলে গড়ে তুলেছিলেন একটি সুউচ্চ ইমারত, তাদের মাথা গোঁজার আশ্রয়ের নিমিত্তে। পরন্তবেলায় বিনিদ্র একটি বাসস্থানের ভাবনায়। কিন্তু কপালের লিখন কেউ বদলাতে পারে না। বলা যায় যে, তাদের স্থান হয় সেই ইমারতেরই কর্নারে, যেখানে ময়লা-আবর্জনার স্ত‚প ও রান্না ঘরের ছোট্ট জায়গায়। সেই গার্ভেজাকার স্থানটুকু বার্ধক্যের অপরাহ্ণে তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। দেহের সমস্ত শক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, এই পরন্তবেলায়। শুধুমাত্র অপলক দৃষ্টিতে বিনে কোন কিছু নিজের আওতায় নেই।
এমতাবস্থায় জীবনের কিছুটা হিসেব মিলাতে সময় ও স্রোত আমায় তাগিদ দেয় যেন আমার হৃদয় গভীরের কিছুটা হলেও লিপিবদ্ধ করি। যদি একটুখানি অঙ্ক কষে দেখি, তবে দেখা যাবে- জীবনের প্রথম ২০টি বছর পিতৃলয়ে নিশ্চিন্তে-নির্ভয়ে, অতি আনন্দে, স্বাচ্ছন্দ্যময়, ও স্নেহ-মমতায় এবং ভালবাসা ও স্বাধীন জীবন যাপন করে থাকে। একই সাথে একান্ত কাছের ও প্রিয় মানুষগুলোর সান্নিধ্যে থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগে পরিপূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে সমাজে সৎ এবং সুস্থ সন্তানের পরিপূরক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ শুধু ক্ষাণিকটা জীবন খাতার হিসেব মিলিয়ে নেয়ার সুবিধা মাত্র।
পরবর্তী ত্রিশটি বছর! অনেক সংগ্রাম, যেখানে চিন্তা থাকে সংসার সৃষ্টি, পরবর্তী প্রজন্ম বৃদ্ধি ও প্রতিষ্ঠিত করার কথা। তথা সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। তাছাড়া যশ-সম্মান সমৃদ্ধিতে পরিচিতি লাভ। বলা যায় এটা জীবন যুদ্ধ। মোটকথা, ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া। তাছাড়া, প্রতিযোগিতাতো রয়েছেই, কে কার উর্ধ্বে থাকবে। যা সমাজের একটি প্রচলিত নিয়মের মধ্যে পড়েছে। সত্যি একেবারেই ক্লান্ত ভূপৃষ্ঠের এই অসমজোয়ালী পরিস্থিতির মধ্যে।
পরবর্তী পনেরো বছরে জীবনযাত্রার মান হয়ে যায় একটি কুকুরের মতো। জীবনের অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনই মূল্য থাকে না কারো কাছে। এসে যায় জীবনে পরনির্ভরশীলতা। যাকে বলে অন্যের ওপর নির্ভর করে বাঁচা।
বাকি ১০ দশ বছরে জীবন হয়ে ওঠে একটি বানরের মতো। ওরা যেমনটি এ গাছ থেকে সে গাছ, এক ডাল থেকে অন্য ডাল ঘুওে বেড়ায়। এছাড়াও বিভিন্ন ভাবভঙ্গি মাধ্যমে আনন্দ ও সন্তুষ্টি দান করে থাকে অসংখ্য জনসাধারণকে। বৃদ্ধকালীন সময়গুলো যেন ঠিক একই রকম। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ পিতা-মাতার কিছু করার থাকে না। সামর্থহীন হয়ে পড়ে। তখন তদেরকে নিয়ে টানাপোড়েনের শেষ থাকে না। আজ বড় ছেলে, কাল মেজো ছেলে; পরশু ছোট ছেলের বাসায়। চলে ভাগাভাগি-ঠেলাঠেলির পালা। বলা বাহুল্য, একজন সন্তানের পিতা-মাতার কষ্টগুলো আরো একটুখানি ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন রূপের হয়ে থাকে। তার ওপরে আবার নাতি-নাতনিদের খুশী করতে বিভিন্ন রকমের অঙ্গভঙ্গি করা। তাদের খুশী করা মানেই বাবা মায়ের সন্তুষ্টি লাভ করা। এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল। উহুঁ বড্ড ক্লান্ত। এই তো জীবন। এরই নাম বেঁচে থাকা। এরই নাম বার্ধক্য।
কাউকে হাতের লাঠি বানিয়ে অবলম্বনহীনভাবে বেঁচে থাকা। বিধির বিধান। মাঝে-মধ্যে মনে হয় নিশ্বেষিত জীবনের এই বেঁচে থাকাটাই যেন একটি ঘোর, তন্দ্রার মতো। ভুল হয়ে থাকলে বোধহয় “মৃত্যুই শ্রেয়”। যেখানে নেই কোন ধরাধরি, হিংসা-দ্বেষ, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, স্বজনপ্রীতি, ধনী-গরীব, মর্যাদা-অমর্যাদার দাম্ভিকতা। আছে শুধু শান্তি আর শান্তি। এমনকি কোন মরিচিকা পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারবে না কখনো। তারপরও জীবদেহের প্রাণবায়ু যে অতিপ্রিয় প্রতিটি জীবের নিকটে। হায় রে মানুষ রঙ্গিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস্। শুধুমাত্র এক সেকেন্ডের ভাবনা। কবির ভাষায়, তার লেখনীর মধ্যদিয়ে তার ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি লিখে গিয়েছেন। “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।” সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কেউই চলে যেতে চায় না। সৃষ্টির সেরা জীবকেও বিদায় নিতে হবে বৈকি। বিধির বিধান না যায় খণ্ডন । আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কে না চায় বেঁচে থাকতে এই বিশাল ভুবনে। আমার দিদিভাই ছিল এমনইট একজন। প্রায় বয়স তখন আঁশি পার করে নব্বই ছুঁই-ছুঁই। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীণ হানাদারবাহিনীরা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ছে। লাঠির আশ্রয়ে চলতে হতো দিদিভাইকে। শুনেছি তখন তিনিও প্রাণের ভয়ে লাঠিকে সম্বল করে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে এখান থেকে সেখানে গিয়েছিলেন শুধু বেঁচে থাকবার তাগিদে। বেঁচে থাকার আশা... এই তো জীবন...!! এই তো জীবনের পরিসমাপ্তি।
[ জীবন ও সমাজে পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]