শুধু স্মৃতিই রয়ে গেল

মানুয়েল চাম্বুগং : সুহাস আমার বন্ধু। আমরা একই মেসে থাকি। কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি সে চুপ-চাপ।  আজকাল সে একাকী সময় কাটাচ্ছে। কারো সাথে কথা বলে না। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম ও পড়াশুনাও ঠিক মতো করে না। কি যে হয়েছে সেই শুধু জানে। এক গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। জেগে দেখি  সুহাস বিছানায় দেখি নেই। বাথরুমে গেছে মনে করে আমি শুয়ে পড়ি। কিন্তু ভয়ে আর ঘুমাতে পারলাম না। বিশ-পঁচিশ মিনিট পার হলো সুহাসের কোনো খবর নেই। বাথরুমে গিয়ে দেখি সুহাস নেই। মহাচিন্তায় পড়ে গেলাম। কি মনে করে যে ছাদে গেলাম, ও-মা! সেখানে গিয়ে দেখি জোৎস্নাশোভিত রাতে সে আপন মনে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “দোস্ত এখানে না ঘুমিয়ে কি করছিস? তার কোনো সাড়া-শব্দ নেই। চাঁদের দিকেই এক মন, এক প্রাণ হয়ে তাকিয়ে আছে। তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, “কিরে দোস্ত শুনতে পাচ্ছিস না, কি হয়েছে তোর, না ঘুমিয়ে এখানে কি করছিস?” সে আমার দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকায়। তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা দোস্ত কি হয়েছে রে তোর। আমার সাথে সহভাগিতা কর, সমাধান দিতে না পারলেও তো তোর কষ্টটা কিছুটা কমতে পারে।” সে আমার দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “দোস্ত, তুই তো গল্প-টল্প লিখিস আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নিয়ে যদি একটা গল্প লিখিস তাহলে আমি তোকে বলতে পারি। ঠিক আছে লিখবো। তুই আগে বল।সে বলতে শুরু করল--

একদিন প্যান্ট-শার্ট-টাই, জুতা-মোজা পড়ে কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে সাইকেলে করে কলেজে যাওয়ার জন্য আমি হোস্টেল থেকে বের হই। দেখলাম একটি মেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তার হাতে একটি কলেজ ব্যাগ, পড়নে আকাশি রং-এর কলেজ ড্রেস। দেখতে রুপবতী। আমাকে দেখামাত্রই সে মিটমিটে হাসে দিল। আমিও মুচকি হেসে তার দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ আমরা দুজনেই দুজনের দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকি। বেশ ভালই লাগছিল আমার। কিন্তু এ ভাললাগা বেশিক্ষণ থাকল না। একটি রিক্সা এসে তার সামনে দাঁড়ায় এবং ঐ রিক্সায় উঠে সে তার বান্ধবীর সাথে চলে গেল। সেদিনের মতো প্রায়ই এভাবে আমাদের চোখাচোখি হতো। কিন্তু কখনোই আমাদের কারোও আলাপ করার সাহস হতো না। 

                            

একদিন বন্ধুদের কাছে ঘটনাটি খুলে বললাম। এক বন্ধু শোনামাত্রই বললো, “দোস্ত, আজকে তো ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ অফার দিয়ে দেখ্” এই কথা শুনে কয়েকজন হাসি-ঠাট্টা করে বললো, “আয় অফার দিবি, অফার দেওয়া তো দূরের কথা; মেয়ের সাথেই কথা বলতে পারবে কি-না সন্দেহ!” তাদের বললাম, “অফার দেওয়া কি কোন ব্যাপার হলো; চাইলেই পারি কিন্তু না, এখন দিলে আমার পড়াশুনার ক্ষতি হবে।” একজন উত্তেজিত হয়ে বলল, “দূর বোকা প্রেম করলেই যে পড়াশুনার ক্ষতি হয়, তোকে কে  বললো? আমরা আর প্রেম করছি না।”একথা শুনে সবাই হা-হা করে হেসে দেই। তাদের সবার হাসি থামিয়ে একজন বললো, “তুই যদি অফার দিতে পারিস তাহলে তুই পুরুষ, না পারলে কাপুরুষ।” বন্ধুদের এসব কথাবার্তা শুনে রাগে জেদবশত আমি ঐ রাতেই একজনের কাছ থেকে মোবাইল নম্বরটা সংগ্রহ করে মেয়েটিকে মনের কথা জানালাম। সৌভাগ্যের বিষয় হলো মেয়েটিও কয়েকদিনের পরই আমাকে তার সম্মতির কথা জানায়। এরপর থেকেই শুরু হয় আমাদের প্রেমের যাত্রা । মোবাইলে প্রতিদিনই তার সাথে কথা বলতাম। রাতে কথা বলতে-বলতে কখন যে ২টা, ৩টা, ৪টা বেজে যেত বুঝতেই পারতাম না। মাঝে-মাঝে কলেজ ফাঁকি দিয়ে ময়মনসিংহের বোটানিকেল গার্ডেন ও কাচিঝুলি পার্কে বেড়াতাম। কিন্তু বড়ই বেদনাদায়ক যে, তার সাথে আমার প্রেমের সোনালীর দিনগুলো মাত্র কিছুদিনেরই ছিল। পাঁচ মাস যেতে না যেতেই আমাদের সর্ম্পক ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। 

কিভাবে সর্ম্পক শেষ হলো জানতে চাইলে সে বললো, “একদিন প্রতিদিনের ন্যায় কলেজ থেকে সাইকেলে করে হোস্টেলে ফিরছিলাম। চড়পাড়া মোড় পার হওয়ার পর পিছন থেকে একটি মেয়েলী কণ্ঠে ডাক শুনতে পেলাম। সাইকেল থামিয়ে পিছনে ফিরে দেখি আমার প্রেমিকার বান্ধবী। কাছে এসে সে তার বান্ধবীর সর্ম্পকে অনেক খারাপ কথাবার্তা বলে চলে গেলো। দোস্ত, তুই যদি শুনতিস না, তাহলে তুইও আমার মতো তাকে ছেড়ে চলে আসতি। এমনি চাঁদনী রাতেই তার সাথে আমার আর সর্ম্পক রাখা সম্ভব নয় বলে আমি তাকে জানিয়ে দেই। তখন সেতো বেচারা কেঁদে-কেঁদে অনেক কথাই বলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি পাষাণ্ড কোন কথাই শুনতে চাইনি। কি আর বলবো দোস্ত, মনে হয় আমার মতো বোকা এই দুনিয়ায় আর কেউ নাই। আমি অন্যের কথায় বিশ্বাস করে, যাচাই-বাছাই না করেই আমাদের সুন্দর পবিত্র সর্ম্পককে চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। এক সপ্তাহের পর এক মেয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে আমাদের ব্রেকআপের কয়েকদিন আগে না-কি আমার প্রেমিকার সাথে তার বান্ধবীর কি একটা বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়। আর সেই ঝগড়ার সমস্ত রাগ, হিংসা, ক্ষোভের কারণেই সে আমার সাথে তার সম্পর্ক  নষ্ট করে প্রতিশোধ নিল।”

“দোস্ত, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”

“ও-কে নো প্রব্লেম, তোর যা ইচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করতে পারিস।”

“আচ্ছা দোস্ত, তোর প্রেমিকা যদি কখনো ফিরে এসে বলে যে, সে এখনো তোকে ভালবাসে, তুই কি করবি?”

“না দোস্ত, আমি মনে করি না সে আমাকে পুনরায় ভালবাসবে। আর যদি সে ভালবেসেই থাকে তাহলে সেটা হবে আমার ভাগ্যের ব্যাপার। আমার হৃদয়দুয়ার তো এখনও তার জন্য খোলা আছে। আমি যেমন আগে তাকে ভালবাসতাম, ঠিক তেমনি এখনও ভালবাসি এবং আজীবন ভালবেসে যাবো। সমস্ত হিমালয় পর্বত একসময় গলে যেতে পারে কিন্তু তার প্রতি আমার ভালবাসা কখনোই বিলীন হবে না। বিশ্বাস কর দোস্ত আমি কিন্তু তাকে নিজে থেকে ত্যাগ করিনি। অন্যের কথায় প্ররোচিত হয়েই রাগে-দুঃখে-অভিমানের বশবর্তী হয়ে তাকে ত্যাগ করেছি। যা আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আর সেই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আমি আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি। জানি না সে আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছে কিনা।”

নীরব থাকতে দেখে তাকে আবারও প্রশ্ন করলাম, “তোদের ব্রেকাপের পর তুই কি কখনও তার খোঁজ নিয়েছিলি?” এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সুহাস বললো, “কতবার যে নিয়েছি তার হিসেব নেই। কিন্তু সে কোনদিনই আমার কল রিসিভ করেনি। শুধু একবার কল রিসিভ করে এমন বকা দিল যা বলার মতো নয়। তার কথা শেষে ক্ষমা চেয়ে আমি তাকে অনুনয় করে বলেছিলাম, আমরা কি আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারি না? এই কথা শুনে সে রাগে কটমট করে প্রতারক, মিথ্যাবাদী, লুচ্চা, আমার জীবন নষ্ট করেছো বলে লাইন কেটে দেয়। সেদিন ছাড়াও আরো অনেকবার তাকে ফোন দিয়েছিলাম । কিন্তু কোন সময়ই তার ফোন খোলা পাইনি।

জানি না দোস্ত আজকাল কেন জানি বার-বার তাকে মনে পড়ে। বিশেষ করে আজকের মতো এই চাঁদনী রাতে। মনে পড়ে এমনই এক চাঁদনি রাতে আমাদের প্রেম শুরু হয়েছিল আবার বিচ্ছিন্নও হই। মনে পড়ে যেদিন তার সাথে প্রথম দেখা করতে যাই সেদিন অনেক দেরি করায় আমি তাকে বলেছিলাম, সরি ডিয়ার একটু দেরি হয়ে গেল। তখন সে রাগ না করে মুচকি হেসে বলেছিল, ঠিক আছে, ওটা কিছু না। তার সেই মুচকি হাসিমাখা মুখটা আমার খুবই ভাল লাগতো। বোটানিকেল গার্ডেনে মুখোমুখি বসে বাদাম খেতে-খেতে দুজন-দুজনার সুখ-দুঃখের কথা সহভাগিতা করার কথা মনে পড়ে। আরো মনে পড়ে তার জন্মদিনে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল, কার্ড ও ছোট একটা গিফট্ দিয়ে তাকে বলেছিলাম, হ্যাপি বারথ্ডে টু ইউ ডার্লিং তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “থ্যাংক্ ইউ ডার্লিং, আই লাভ ইউ টু।” মনে পড়ে সে খুব আইসক্রিম খেতে পছন্দ করতো। তার সাথে আমার যখন মনোমালিন্য হতো তখন আমি শুধু একটা আইসক্রিম নিয়ে তার সামনে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াতাম। আইসক্রিমটা পেয়েই সে তার সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে যেতো। আমাকে কয়েকটা ধুপ-ধাপ মেরে বলত, “আচ্ছা, তুমি এমন কর কেন, জান-না আমি তোমাকে কত ভালবাসি।” তার এধরনের পাগলামোটা আমার খুবই ভাল লাগত। কিন্তু কি করবো দোস্ত এগুলো শুধু স্মৃতিই হয়েও রইল। মাঝে-মাঝে সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়লে অন্তরে অনেক কষ্ট পাই। 

এই কথা বলার পর সুহাস কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকে। তখন কি একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। হঠাৎ! আকাশে বিদুৎ চমকালো এবং একটা ঘুরুম-ঘুরুম শব্দ হয়ে রিমঝিম বৃষ্টি পড়তে লাগলো। তখন সুহাস কি কাদঁছিল কি-না আমি বুঝতে পারছিলাম না। কারণ তার কান্নামিশ্রিত অশ্রু রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজে টপ্ টপ্ করে মাটিতে পড়ছিল। তবে লক্ষ্য করলাম সে জোরে-জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিল। ঐ মুহূর্তে আমি তাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শুধু তার পাশে গিয়ে, কাঁধে আমার এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলাম। 

[  জীবন ও সমাজে  পাঠাতে পারেন আপনারও লেখা। 

লেখা পাঠানোর ঠিকানা : jibonoshomaj@gmail.com ]

Post a Comment

Previous Post Next Post