উদার চিত্তই শান্তি ও সম্প্রীতির সংস্কৃতি


 লেখক : জাসিন্তা আরেং : 

মানবজীবনে উদারতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা। যা বিশ^জুড়ে মানবতার মাঝে শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করে। উদার প্রকৃতির মনোভাবই পরিবারে, সমাজে, দেশে এবং বিশ্বে স্থিতিশীলতা, একাত্মতা, শান্তিপূর্ণ শৃঙ্খলা এবং সম্প্রীতি আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদারতাই একমাত্র পথ যা সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে গিয়ে সমাজে সদ্ভাব, সৌহার্দ্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে স্থায়ী করে তুলেছে। বিশেষভাবে, বাংলাদেশের মত একটা দেশে যেখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও বিভিন্ন ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের নাগরিকদের একত্রে সহাবস্থান, সেখানে একমাত্র উদারতার মনোভাব এবং শিক্ষাই শান্তি এবং সম্প্রীতির সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশে^ উদারতার মনোভাব পোষণ, রক্ষায় এবং প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের প্রচেষ্টার যেন কমতি নেই। নাগরিকদের মাঝে সহভাগিতা, সহযোগিতা এবং একে-অপরকে ভালবাসার মনোভাবই সম্প্রীতি এবং শান্তি আনয়নে মূলচালিকাশক্তি। 

উদার চিত্তই শান্তি ও সম্প্রীতির সংস্কৃতি  


পরিবারই উদারতা শেখার অন্যতম বিদ্যাপিঠ। পরিবারে গুরুজনেরা ছোটবেলা থেকেই তাদের সন্তানদের নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে থাকেন যার মধ্যে উদারতার শিক্ষা অন্যতম। সেই শিক্ষাই পরবর্তীতে পরিবারে গন্ডি পেরিয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্রে শান্তি এবং সম্প্রীতি আনয়ণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। পরিবারে বড়দের উদার এবং সহানুভূতিশীল মনোভাব পর্যবেক্ষণ করেই ছোটরা উদার এবং সহানুভূতিশীল হতে শেখে। পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা, রেষারেষি, মতবিরোধ, অশান্তি সন্তানদের কখনই অন্যের প্রতি উদার এবং দয়ালু হতে শেখায় না বরং নিজ স্বার্থে অন্ধ এবং অন্যের প্রতি বিদ্বেষ লালন করতেই শিক্ষা দেয়। পরিবারে পিতা-মাতা, ভাই-বোন এবং আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে মধুর সম্পর্ক রাখার শিক্ষাই সমাজে সকল ধর্মাম্বলম্বী, সম্প্রদায় এবং জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করে। পারিবারিক উদারতার উপর অনেকখানি শান্তি ও সম্প্রীতি নির্ভর করে। উদারতার উপর নির্ভর করে সন্তানের মনে শান্তি এবং সম্প্রীতির বীজ রোপিত হয়। গুরুজনদের শান্তিপূর্ণ বন্ধন এবং সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত পরিবারের ছোটদের শান্তি ও সম্প্রীতির গুরুত্ব বুঝতে এবং পরিবারে, সমাজে এবং বিশে^ এর কদর করতে শেখায়। যারা পরিবারে অশান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও বিবাদ-কলহের মাঝে বেড়ে উঠে, তারা সমাজে এবং বিশে^ শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। পরিবার থেকেই একজন সন্তান তার উন্মুক্ত হৃদয় নিয়ে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন সকলকে ভালবাসতে শেখে, তাদের বিপদে-আপদে পাশে দাড়াতে শেখে। এই পারিবারিক উদারতার শিক্ষা যখন তারা সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে, তখন বিশে^ শান্তি ও সম্প্রীতি আনয়নে মূলচালিকাশক্তি হিসেবে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

প্রতিটি ধর্মই উদারতার শিক্ষাদান করে থাকে। সকল ধর্মই শান্তি ও সম্প্রীতিকে সাধুবাদ জানায় এবং সহিংসতা, বিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, উদাসীনতাকে অনুৎসাহিত করে আসছে। সর্বকালের মহান মুনি-ঋষীগণ যিশুখ্রিস্ট থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সকলেই উদারতার অপূর্ব দৃষ্টান্তসমূহ স্থাপন করে আসছেন। ধনী-গরিব, ধার্মিক-অধার্মিক, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সকলের প্রতি সমান ভালবাসা এবং উদার চিত্তের পরিচয় দিয়েছেন। প্রতিটি ধর্মই সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান করতে শেখায়। মানবিক উদারতাই পারে সকল ধর্ম-বর্ণ-জাতকে পিছনে ফেলে সকল স্তরের মানুষকে আলিঙ্গন করতে। মানব সমাজের সকল মহান জ্ঞানী এবং বিজ্ঞজনেরা শান্তি ও সম্প্রীতিকেই তাদের মহান জীবনের পাথেয় করেছেন, বেছে নিয়েছেন উদারতার পথ; পরিত্যাগ করেছেন সহিংসতার অশুদ্ধ মন্ত্র। তারা প্রত্যেকেই তাদের হৃদয়ে উদারতার শিখাকে অনবরত জাজ্জ্বল্যমান রেখেছেন যেন তারা শান্তি ও সম্প্রীতির কিরণ ছড়াতে পারে। প্রতিটি মহান ধর্মই তার অনুসারীদের উদারতা, পারস্পরিক একতা এবং ভালবাসতে শিক্ষা দান করে, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে উদার চিত্তের অধিকারী হতে এবং ধর্ম-বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষদের ভালবাসতে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পারস্পরিক ঐক্য, সংহতি, মৈত্রি, সদাচার, সমঝোতার সম্পর্কই শান্তি ও সম্প্রীতিকে আরো দৃঢ় করে তুলতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে। একতা, সদাচার এবং সংহতির সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের হৃদয়কে উন্মুক্ত করতে হবে। উন্মুক্ত হৃদয়ের অধিকারীরা ভাল-মন্দ, আপন-পর সকলকেই তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়ে বিশে^ শান্তি ও সম্প্রীতিকে নিশ্চিত করার ক্ষমতা রাখে। উদারতার ফল ভালবাসা, ভালবাসার ফল শান্তি এবং শান্তির ফল সম্প্রীতি। তাই সমাজের বুকে উদারতাকে লালন এবং ধারণ করতে হবে যেন তার ফলস্বরুপ শান্তি এবং সম্প্রীতিপূর্ণ ধরণী গড়ে তুলতে পারি।

বর্তমানে বিশে^ নৈরাজ্য এবং অসহযোগিতার মনোভাব দিন-দিন বেড়েই চলেছে। উদারতা, পারস্পরিক ভালোবাসা, সহযোগিতা, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষাকে পায়ে ঠেলে শত্রুতার পক্ষ নিয়ে যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে আপামর জনসাধারণ। দেশে-বিদেশে, জাতিতে-জাতিতে, ছোট-বড় সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনবরত লেগেই আছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী লোকদের, এবং ব্রতধারী ও ব্রতধারীনিদের নানাভাবে নির্যাতন ও অত্যাচার করা হচ্ছে এবং তাদের ঘর-বাড়ি, ধর্মীয় উপাসনালয় আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। পাকিস্তানে এবং ফিলিপাইনে খিস্টান ধর্মযাজকদের হত্যা এবং উপাসনালয় ধ্বংস করা হচ্ছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে এবং অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ধরণের অসাম্প্রদায়িকতা এবং অশান্তি কারোরই কাম্য নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সকলকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং নিজ-নিজ ধর্ম পালনে সহায়তা করতে হবে। যে দেশে সাম্প্রদায়িকতা সচল, সেখানে কখনই শান্তি বিরাজ করতে পারেনা। তাই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বৃহত্তর স্বার্থে দেশের সকলের পারস্পরিক উদারতা ও ভালবাসার সম্পর্ক বজায় রাখা অতিব গুরুত্বপূর্ণ। যতদিন মানুষের মাঝে ঝগড়া-কলহ, বিবাদ-বিদ্বেষ, শত্রুতা-অসংহতি, স্বার্থপরতা, মতবিরোধ, ঘৃণা, নির্লিপ্ততার বীজ নিহিত থাকবে, ততদিন সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতির অঙ্কুর মাথা তুলে দাড়াবে না। মানুষের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ, উদারতাই পারে সমাজে শান্তির বীজ বপন করতে এবং সকলকে সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে সমাজকে নবায়ন করতে। একে-অন্যের প্রতি উদারতার বাণী ও স্পর্শই পারে স্বার্থপরতার কালিমা এবং অন্তরের মলিনতাকে মুছে দিতে। 

বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠিতে মতবিরোধ এবং দ্বন্দ্ব থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই মানবিকতার কারণে হলেও পারস্পরিক উদারতা প্রদর্শন করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সকলের সংঘবদদ্ধ প্রয়াসের ফলেই একমাত্র তিক্ত সম্পর্ক মিষ্টতায় পরিণত হতে পারে। অন্য জাতি-গোষ্ঠি বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের প্রতি উগ্র এবং হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করে কখনই কোন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যে দেশে ভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতির সহাবস্থান, সে দেশে উদারতার মনোভাব গড়ে তোলা বাঞ্চনীয়। যে দেশের লোকেরা একে-অপরের দুঃসময়ে পাশে দাড়ানোর এবং আপনজনের মৃত্যুতে সান্ত¡না দেয়ার মনোভাব রাখেনা, সে দেশে কখনই সম্প্রীতি গড়ে ওঠবে না। সাম্প্রদায়িকতা এবং অশান্তি যে কোন দেশের অগ্রগতির পথে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত। সাম্প্রদায়ীকতা এবং অনুদার মনোভাবকে সমঝোতা এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মাধ্যমে মিমাংসা করতে হবে, এবং অবিলম্বে ধর্ম ও মত বিরোধিতার অবসান ঘটাতে হবে। প্রতিশোধপ্রবণতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এবং সংকীর্ণতার গ-ি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে, একত্রিত হতে হবে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সহযোগিতা, সহভাগিতা, সুমধুর সম্পর্ক এবং উদার মননশীলতাই সার্বিক উন্নয়ন-অগ্রগতি এবং কল্যাণ সাধনের চাবিকাঠি। তাই আসুন, আমাদের সংকীর্ণ হৃদয়কে উন্মুক্ত করি এবং উদারতাকে মনে-প্রাণে ধারণ করি যেন এ বিশ^ শান্তি ও সম্প্রীতির একক দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। 

Post a Comment

Previous Post Next Post