বাঙালির সংস্কৃতি

বাঙালির সংস্কৃতি


নিশ্বাসের বায়ু যেমন আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রাখে, তার অস্তিত্ত্ব অনুভব করি, অথচ তাকে দেখতে পাইনে, সংস্কৃতিও তেমনি। ভাষা, সাহিত্য, ধারণা, ধর্ম ও বিশ্বাস, রীতিনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ, উৎসব ও পার্বন ইত্যাদি সবকিছু নিয়েই সংস্কৃতি। সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ যেসব শিক্ষা, সামর্থ্য এবং অভ্যাস আয়ত্ত করে- তাও সংস্কৃতির অঙ্গ। সংস্কৃতি আমাদের পরিণত করে সামাজিক জীব। সংস্কৃতি হলো একটি জাতির পরিচয়বাহক, যা অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক করে রাখে। বাঙালির সংস্কৃতি কোনো অখন্ড বা অভিন্ন সংস্কৃতি নয়। এ সমাজ যেমন বহু ভাগে বিভক্ত তেমনি এ সংস্কৃতিও বহু রঙে রাঙানো। রাজনৈতিক ও ধর্মের দৃষ্টিতে এ সমাজে রয়েছে বিভিন্ন ভাগ-বিভাগ। বাঙালিদের মধ্যে যতোই ভাগ-বিভাগ থাকুক, ধনী-গরীব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ সংস্কৃতি অর্থাৎ বাঙালির সংস্কৃতি সবার সংস্কৃতি। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাঙালিদের রয়েছে সর্বজনীন উৎসব। বারো মাসে তেরো পার্বণ। কোন-কোন উৎসবকে কেন্দ্র করে অনুুষ্ঠিত হয় মেলা। আর এ সবই হল বাঙালির আবহমান ঐতিহ্য।

বাঙালির সংস্কৃতি

আমাদের এই বঙ্গদেশ নদীমাতৃক দেশ। এখানে প্রচুর খাল-বিলও রয়েছে। এর ফলে এ দেশের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ প্রাচীন কালে সহজ ছিল না। বলতে গেলে রাঢ়, গৌড়, উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ, উত্তর-পূর্ব বঙ্গ প্রত্যেকটি আলাদা-আলাদা দেশের মতো ছিল। আর এই বিচ্ছিন্নতার কারণে এসব এলাকার ভাষাগুলোতে স্বাতন্ত্র লক্ষ্য করা যায়। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে প্রত্যহিক জীবনের অনেক কাজকর্মে পার্থক্য ছিল। এমনকি ধর্মের ব্যপারেও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। আঞ্চলিক সাতন্ত্র্য থাকা সত্ত্বেও বাঙালি সংস্কৃতি বলে যা পরিচিত হয়েছে, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ভাষানির্ভর। এখানে হিন্দু, মুসলমান, ব্রাক্ষণ, শূদ্র, ঘটী-বাঙাল, গ্রামীণ-নাগরিক ইত্যাদি নানা বিভাগ থাকা সত্ত্বেও যে সুতো দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি একই মালায় গাঁথা, তা হলো বাংলা ভাষা। এই ভাষা দিয়েই বাংলার বিভক্ত সমাজের সকল মানুষ বাঙালি নামে পরিচিত। আর এই ভাষিক পরিচয় কেড়ে নিলে এ সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্যই লুপ্ত হয়।

গ্রামীণ সংস্কৃতি : বাঙ্গালি সংস্কৃতির আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল : এ সংস্কৃতি গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি। জনগোষ্ঠীর শিকড় গ্রামের মাটি ও সমাজে প্রথিত। বাংলার সাহিত্য, বিশেষ করে কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকাররা বরাবরই গ্রামের দিকে ফিরে তাঁকান। বাংলায় নাগরিক জীবন নিয়ে যতো গল্প-উপন্যাস এবং সম্প্রতি নাটক লেখা হয়েছে, সে তুলনায় গ্রামজীবন ভিত্তিক গল্প উপন্যাস এবং নাটকের সংখ্যা অনেক বেশি। কবিতা সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। গ্রাম বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতি সাহিত্য জগতে এক অমূল্য আঁকর। নাগরিক কবিরা বারংবার গ্রামের নিসর্গেও বন্দনা করেন। সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি বলে পরিচয় দিতে শহরের লোক বিশেষ অনুষ্ঠানে নারকেল কোড়া আর মুড়ি খায়। সেই সঙ্গে চিড়ের মোয়াও থাকে। ঘর সাজানোর জন্য গ্রামের কারুশিল্প ব্যবহার করা হয়। এ হচ্ছে হারানো জীবনের দিকে এক ধরনের মায়াভরা চোখে ফিরে তাকানোর মতো।

মাছে-ভাতে বাঙ্গালি : বাঙ্গালির রয়েছে একটি নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস। এক নামে পরিচিত মাছে-ভাতে বাঙ্গালি। অন্যান্য এলাকার লোকেরা বাঙ্গালির মতো ভেতো বলে পরিচিত নন। এবং বাঙ্গালির মতো মাছেরও এতো ভক্ত নন। বাঙ্গালির মিষ্টান্ন এবং পীঠেপুলিতে অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা। অনেকের মতে, রসগোল্লা অর সন্দেশ বাঙ্গালির ঐতিহ্যবাহী খাবার। বাঙ্গালিরা খেতে এবং খাওয়াতে ভালবাসেন। তাদের আতিথেয়তা এবং সৌজন্যের  একটা প্রধান বহিঃপ্রকাশ হলো অন্যকে খাওয়ানো। শুধুমাত্র নিমন্ত্রিত অতিথি নয়, বাড়িতে কেউ এলেই তাকে কিছু খাওয়ানো বা খাওয়ার জন্যে সাধাসাধি করা বাঙ্গালি ভদ্রতার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাওয়ার সময় না হলেও অন্তত চা অথবা সরবত অথবা চা পান খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করাও ভদ্রতার লক্ষণ বলে বিবেচিত হয়। তদুপরি, অতিথি খেলেই নিমন্ত্রণকর্তা খুশি হন না, অতিথিকে পেট ভরে খেতে হয়। অর্থাৎ খেয়ে হাঁসফাঁস করলে অথবা তৃপ্তির ঢেকুর তুললে তবেই নিমন্ত্রণকর্তা সন্তুষ্ট হন। কোন-কোন উৎসবের সময়ে আাতœীয় এবং প্রতিবেশীদের মিষ্টি পাঠানোর রীতিও আছে।

বাঙ্গালির পোশাক: খাদ্যের মতো বাঙ্গালির পোশাকেও রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য যা বাঙ্গালি সংস্কৃতিকে একটি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। আমাদের এ বঙ্গদেশের পাশর্^বর্তী রাজ্য তথা আসাম, উড়িষ্যা এবং বিহারের সঙ্গে বাঙ্গালির পোশাকে মিল রয়েছে। কিন্তু খালি মাথায়, খালি গায়ে থাকা বাঙ্গালি পুরুষদের দেখলেই চেনা যায় এরা বাঙ্গালি। ধুতি, লুঙ্গি ইত্যাদি বাঙ্গালি পুরুষের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। বাঙ্গালি নারীরাও তাদের শাড়ির জন্যে অন্যান্য এলাকার নারীদের থেকে সহজেই চোখে পড়েন। কেননা বাঙ্গালি নারীরা শাড়ি পড়েন বিশিষ্ট ভঙ্গিতে।  

বাঙ্গালির চরিত্র : বাঙ্গালিদের চরিত্র এবং আচরণ সম্পর্কে কতোগুলো জনপ্রিয় ধারণা আছে। বাঙ্গালিদের সাধারণভাবে মনে করা হয় দুর্বল, ভদ্র এবং ন¤্র স্বভাবের। গত দেড় হাজার বছরের দেশী-বিদেশী অনেকেই বাঙ্গালিদের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নানা রকমের মূল্যায়ন করেছেন- যার কিছু আংশিকভাবে সত্য, কিছু অতিরঞ্জন। যেমন, উনিশ শতকের বিখ্যাত ইংরেজ কর্মকর্তা এবং লেখক ব্যাবিংটন মেকলি লিখেছিলেন, এঁরা অলস-শারীরিক পরিশ্রমের সম্ভাবনা দেখলে সংকোচ বোধ করেন। দেশীয়দের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র বাঙ্গালিদের কর্মবিমুখতার নিন্দা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বাঙ্গালিদের সাধ আছে, কিন্তু সে অনুপাতে চেষ্টা নেই। এই মন্তব্যগুলো আপাতদৃষ্টিতে রূঢ় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। এক কথায় বাঙ্গালিরা আরামপ্রিয়। শস্যের প্রাচুর্যের কারণেই হয়তো বাঙ্গালিরা পরিশ্রমী জাতিতে পরিণত হননি। দুপুরে খওয়ার পর ঘুমানো এবং আড্ডা দেওয়া বাঙ্গালির চরিত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কিন্তু এ বৈশিষ্ট্য দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। বিশ শতকের শেষে যে বাঙ্গালিদের দেখা যায় তারা অনেকেই ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি। সীমিত অভিজ্ঞতা এবং অপর্যাপ্ত মূলধন নিয়ে এগিয়ে এসেছিল বাঙ্গালিরা। পৃথিবীর প্রত্যন্ত এলাকায় বাঙ্গালিরা এখন ভাগ্য গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন, আগে যেখানে বাঙ্গালিদের চোখে প্রবাস ছিল মৃত্যুর মতো ভয়ানক।

উপসংহার : বাঙ্গালির সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করলে লক্ষ্য করা যায়, এ সংস্কৃতি রয়েছে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য ইত্যাদি। কুটির শিল্প বাঙ্গালির একটা নিজস্ব সংস্কৃতি। শীতলপাটি, নকশিকাঁথা, নকশি-পাখা, বেতের কাজ, রন্ধন শিল্প বাঙ্গালির জুড়ি নেই। নানা রকমের পিঠাপুলি, বিচিত্র ধরনের আচার, মিষ্টান্ন, কাসুন্দি ইত্যাদি একান্তভাবে বাঙ্গালির। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত একদল ধর্মান্ধ লোক ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল এদেশকে একটি ধর্ম-রাষ্ট্রে পরিণত করার দিবাস্বনে বিভোর হয়ে আছে। এমনকি প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে কিছু ছদ্মবেশী বুদ্ধিজীবিও তাদের এই প্রচেষ্টার সঙ্গে শামিল হয়েছে। কিন্তুু বাঙ্গালি সংস্কৃতির যে হাজার বছরের ইতিহাস, তাকে এত সহজে পরাজিত করা যাবে না। বাঙ্গালি তাদের সংস্কৃতিকে চিরকাল অপরাজেয় রূপে দেখতে চেয়েছে, আর চেয়েছে বলেই পরাজিত হতে দেয়নি। তাই তো প্রতিবছর নববর্ষের সময় সমগ্র বাঙ্গালি উদ্বুদ্ধ হয় এক নব জাগরণে।
 লেখক : জ্যাষ্টিন গোমেজ

কৃতজ্ঞতা স্বীকার :

১. মুরশিদ গোলাম , হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি, অবসর প্রকাশনী , ঢাকা ২০০৬
২. কামাল মোস্তফা আহমাদ , বাঙ্গালির সংস্কৃতি, সাপ্তাহিক ২০০০, ঈদসংখ্যা ২০০৯
৩. রায় মৃত্যুঞ্জয়, বাংলাদেশের উৎসব ও মেলা , সাপ্তাহিক ২০০০

Post a Comment

Previous Post Next Post