আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও ভাষাশহীদগণ


কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৯  সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ। মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন বিল’ পাশ হয়। যা কার্যকর হয় ৮ মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে।  
রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে প্রথম প্রহরে সর্বপ্রথম রাষ্টপতি এবং তার পরে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও ভাষাশহীদগণ


সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এদিন শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি  প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন ঘোষিত হয়। সর্বত্র ওড়ানো হয় শোকের কালো পতাকা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে ভাষা দিবসের বিশেষ ক্রোড়পত্র ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয়। এ উপলক্ষে সারা দেশেই থাকে নানা আনুষ্ঠানিকতা।  

ধীরাজ কুমার নাথ, ‘বাংলাদেশীরাই অর্জন করল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নামক প্রবন্ধে লিখেন, মাতৃভাষাকে সুরক্ষা এবং আরও উন্নত করে জীবনের সবস্তরে প্রয়োগ করার একটি উদ্যোগ হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। গ্রন্থমেলার সঙ্গে মিশে আছে আমাদের প্রাণের স্পন্দন, মনের আকুতি এবং হৃদয়ের অভিব্যক্তি। এ মেলার মাঝে উদ্ভাসিত হয়ে থাকে আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য, সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের উন্মেষ হচ্ছে আমাদের প্রত্যাশা। 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় একশ জনের বেশি। তাদের মধ্যে পাঁচজন ভাষা শহীদের নাম আমাদের অন্তরে গেঁথে রয়েছে। সেই সাথে আরো তিনজন ভাষা শহীদের পরিচয় পাওয়া গেছে বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষ্যতে। বিভিন্ন পত্রিকায় তাদের বিষয়ে লিখেছেন অনেকেই। অনেকের লাশ পুলিশ গুম করে দিয়েছেন। তাদের সন্ধান আজও মেলেনি। 

শফিউর রহমান : পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার হুগলীর কোন্নগর গ্রামে ভাষা শহীদ শফিউর রহমান ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি  জন্মগ্রহণ করে। কলকাতা গভর্ণমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে চব্বিশ পরগণার সিভিল সাপ্লাই অফিসে কেরানির চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে আকিলা খাতুনকে বিয়ে করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পরে পিতার সাথে ঢাকায় এসে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ঢাকা হাইকোর্টে হিসাবরক্ষণ শাখায় চাকরি কররেন।

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে দশটার দিকে নওয়াবপুর রোডে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্বদিনের পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ পুণরায় গুলিবর্ষণ করে। খোশমহল রেষ্টুরেন্টের সামনে পুলিশের রাইফেলের গুলি শফিউরে পিঠে এসে লাগে। গুলিতে শফিউরের কলিজা ছিঁড়ে গিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে ডা. এ্যালিনসন অপারেশন করেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষণের কারণে শফিউর সন্ধ্যা ৬টায় মারা যান। 

কয়েকজন ছাত্র মিলে শফিউর লাশ তিনদিন ঢাকা মেডিক্যালের স্টেরিলাইজ ডিপার্টম্যান্টে লুকিয়ে রেখেছিল। ঢাকা হাইকোর্ট গ্রন্থাগারের গ্রন্থাকারিক কামালউদ্দিন ঢাকার তৎকালীন এস.ডি.ও.-র নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ থেকে লাশ বের করে আনেন। কারণ লাশ দেওয়া হলে ছাত্ররা লাশ নিয়ে মিছিল করবে। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত বারোটায় আজিমপুর কবরস্থ্ানে তার লাশ দাফন করা হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার শফিউর রহমানকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন। ২০০৬ সালে ভাষা আন্দোলনে মৃত্যুবরণকৃত অন্যান্য পরিবারের পাশাপাশি তার স্ত্রী বেগম আকিলা খাতুনকে আজীবন ভাতা প্রদানের ঘোষণা দেয়।

আবদুস সালাম : ভাষা শহীদ আবদুস সালাম ফেনী জেলার দাগনভূঁইঞা উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে করিমুল্লা জুনিয়র হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণি এবং আতাতুর্ক মডেল হাই স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত  পড়াশোনা করেন। লেখাপড়া বন্ধের পরে কলকাতা মেটিয়াবুরুজে কলকাতা বন্দরে কাজ শুরু করেন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় ফিরে এসে আজিমপুরে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের ‘পিয়ন’ হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাংলা ভাষাকে পূর্ব-পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে মিছিলের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নেন। ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ এলোপাথাড়িভাবে গুলি চালালে অন্যদের সাথে আবদুস সালামও গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেড় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল  তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

এই ভাষা শহীদ সালামকে বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অন্যতম যুদ্ধ জাহাজ ‘বি এন এস সালাম’ নামে নামকরণ, ফেনী স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে ‘ভাষা শহীদ সালাম স্টেডিয়ামে, নামকরণ, দাগনভূঁইয়া উপজেলা মিলনায়তনকে ‘ভাষা শহীদ সালাম মিলনায়তন, নামকরণ, ২০০৮ সালে ‘ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা, লক্ষ্মণপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ‘সালাম নগর’, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক ছাত্র হল প্রতিষ্ঠা 'ভাষা শহীদ আবদুস সালাম নামে, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভাষা শহীদ সালাম মেমোরিয়াল কলেজ’।

আবুল বরকত : ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ভাষা শহীদ আবুল বরকত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহাকুমার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে ১৯২৭ সালের ১৬ জুন জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এর পর ১৯৪৮ সালে ঢাকার পুরানা পল্টনে মামা আব্দুল মালেকের বাসায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে তিনি অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ স্থান লাভ করে এবং এবং একই বিষয়ে এম.এ শেষ পর্বে ভর্তি হন। বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন আবুল বরকত। ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি অবস্থায় রাত সাড়ে ৮টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। রাত ১০টার দিকে  আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। 

১৯৬৩ সালে ২১ জুলাই বরকতের বাবা শামসুজ্জোহা ভারতে মারা যাওয়ার পরের বছর মা হাসিনা বানু ১৯৬৪ সালে আংশিক সম্পত্তি বিনিময় করে  বাংলাদেশে চলে আসেন ভারত থেকে এদেশে চলে আসেন আজিমপুরের কবরস্থানে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেকে বছরে একদিন একটু আদর করার জন্য। বাংলাদেশের গাজীপুর মহানগরের চান্দনা গ্রামের ‘বাবলা বিথী’তে নিবাস গড়ে তোলেন। শহীদ আবুল বরকতকে ২০০০সালে মরনোত্তর একুশে পদক প্রদান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালাটি ২০১২ সালে উন্মুক্ত করা হয়। তার জীবনী নিয়ে বায়ান্নর মিছিল নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন বরকতের মা হাসিনা বানু।

আব্দুল জব্বার: ময়মনসিংহ জেলার গফরগাও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামে ১৯১৯ সালের ১০ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার। তিনি ধোপাঘাট কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করেন। আর্থিক দৈনতার কারণে লেখাপড়া বাদ দিয়ে পিতাকে কৃষি কাজে সাহায্যে করেন।ভালো কাজের আশায় নারায়নগঞ্জে যাওয়ার পরে এক ইংরেজের সাথে পরিচিত হয়ে বার্মায় (মায়ানমারে) ১২ বছর চাকরি করেন। দেশে ফেরার পর পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডে (পিএনজি) যোগদান করেন। পিএনজি ভেঙ্গে দেওয়া হলে পরবর্তীকালে তিনি আনসার বাহিনীতে যোগদান করেন। ময়মনসিংহ থেকে প্রশিক্ষণ শেষে নিজ গ্রামে ‘আনসার কমান্ডার’ হিসেবে কাজ করেন। এরই মধ্যে বিয়ে করে এক ছেলের বাবা হন জব্বার।

 শাশুড়িকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। হাসপাতালে তার শাশুড়িকে সেবা প্রদানের সময়  ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল মিছিলটি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে আসলে জব্বার তাতে যোগদান করেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করে এবং জব্বার গুলিবিদ্ধ হন। ছাত্ররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে যারা হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের মধ্যে ছিলেন ২০/৯ নম্বর কক্ষের সিরাজুল হক। শহীদ আব্দুল জব্বারকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে মরনোত্তর একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।  মহান ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

রফিক উদ্দীন আহমদ: রফিক উদ্দীন আহমদ মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের পারিল গ্রামে ১৯২৬ সালে ৩০ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে স্থানীয় বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, পরে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ এবং পরবর্তীতে জগন্নাথ কলেজে (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করে। রফিক ভাষা আন্দোলনের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এবং সক্রিয় একজন আন্দোলনকারী হিসেবে মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গনে আসলে পুলিশ গুলি চালায়, এতে রফিকউদ্দিন মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মেডিকেল হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তার লাশ পড়ে ছিল। আন্দোলনকারীদের মধ্যে তাদের মাঝে ডা. মশাররফুর রহমান খান রফিকের গুলিতে ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে নিয়ে যান। রাত ৩টায় সামরিক বাহিনীর পাহারায় ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। রফিকের আত্মত্যাগের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরনোত্তর একুশে পদক প্রদান করে। তার গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রফিকনগর করা হয় এবং ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রামে তার নামে ‘ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে প্রাতিষ্ঠানিক ভবন নামকরণ করা হয়। তার স্মৃতির স্বরণে ‘চাঁদের মত চন্দ্রবিন্দু’ নামে একটি নাটক মন্তস্থ হয়। বাংলাদেশে তাকে শহীদ হিসেবে গণ্য করা হয়।

ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর বাদেও আরো বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাতকার, স্মৃতিচারণ, সংবাদ পত্রিকায় প্রকশিত সংবাদ এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিকরে তিন জন ভাষাশহীদের নাম ও পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। উপেক্ষিত সেই তিন ভাষা শহীদদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:  

অহিউল্লাহ: অহিউল্লাহ ছিলেন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি সেনা মোতায়েন করে।  নবাবপুর রোড দিয়ে জনতার ঢল দেখে কৌতূহলবশত তা দেখতে এসেছিলেন অহিউল্লাহ। ঘটনার সময় অহিউল্লাহ মনের আনন্দে নবাবপুর রোডের পাশে ‘খোশমহল’ রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজ চিবুচ্ছিলেন। এমন সময় একটি গুলি তার মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়। গুলিতে মারা যাওয়ার পর পুলিশ অহিউল্লাহর লাশ গুম করে ফেলে। ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদে তার মৃত্যুর খবর ছাপানো হয়। তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।   

আবদুল আওয়াল: ২৬ বছর বয়সী আবদুল আওয়াল পেশায় ছিলেন একজন রিকশাচালক। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে একুশের ভাষাশহীদদের গায়েবানা জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন রিকশাচালক আবদুল আওয়াল। জানাজা শেষে বিশাল শোক মিছিলেও অংশ নেন তিনি। মিছিলটি যখন কার্জন হলের সামনের রাস্তা অতিক্রম করছিল, তখন অতর্কিতে একটি মিলিটারির ট্রাক মিছিলের এক পাশে উঠিয়ে দেয়া হয়। ট্রাকের আঘাতে সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন আওয়াল। সরকারি প্রেস নোটে অবশ্য বলা হয়েছিল, এটা নেহায়েত একটা সড়ক দুর্ঘটনা মাত্র। আওয়ালের বসিরন নামে তার ৬ বছরের একটি কন্যাসন্তানও ছিল। মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিা কন্যা ওই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। 

সিরাজুদ্দিন : সিরাজুদ্দিন নবাবপুরে ‘নিশাত’ সিনেমা হলের বিপরীত দিকে মিছিলে থাকা অবস্থায় টহলরত ইপিআর জওয়ানের গুলিতে মারা যান। সিরাজুদ্দিন ওরফে নান্না মিয়া ছিলেন সিরাজুদ্দিনের মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষকারী একমাত্র সাক্ষী। তার সাক্ষ্যে জানা যায়, সিরাজুদ্দিন থাকতেন তাঁতিবাজারের বাসাবাড়ি লেনে। ভাষাসৈনিক ও গবেষক আহমদ  ১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকাওে  জানান, তিনি বাবুবাজার থেকেই চলমান মিছিলে অংশ নিয়ে সদরঘাটে রাস্তার মোড়ে পৌঁছান। সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া বাহাদুর শাহ পার্ক হয়ে রথখোলায় পৌঁছাতেই দেখেন চকচকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনীর কয়েকজন জওয়ান ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে। তা সত্ত্বেও মিছিল সেøাগানে রাজপথ মুখরিত করে এগিয়ে চলে। সেরাজুদ্দিন মিছিলে চলতে চলতে দেখতে পান উল্টো দিক থেকে সৈন্য বোঝাই একটি ট্রাক ‘চৌধুরী সাইকেল মার্ট, বরাবর এসে থেমে যায়। এদিকে ‘মানসী’ সিনেমা হলের গলি থেকে পুলিশ ও জওয়ানদের একটি অংশ গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। তখনি ট্রাক থেকে গুলি ছুটে আসে মিছিল লক্ষ্য করে।  

এই ভাষা শহীদেরাই ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা। যাদের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি প্রাণের বাংলাভাষা। এই ভাষাশহীদের স্মরণ করতেই মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থ মেলা। এই গ্রন্থ মেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বের হয়ে আসছে নবীন লেখক। সেই সাথে কেউ হচ্ছে প্রবীণ, কেউ বা বুদ্ধিজীবি। আমাদের প্রত্যেকের উচিত বাংলা ভাষাকে বিকৃত না করা। 
পূর্ব প্রকাশ : সাপ্তাহিক প্রতিবেশী, সংখ্যা - 7, 2020
লেখক: হিমেল রোজারিও, সংবাদকর্মী

তথ্যসূত্র: 
  1. দৈনিক সংবাদ,  
  2. হাসান মাহামুদ; 
  3. রাইজিং বিডি.কম, 
  4. উইকিপিডিয়া, 
  5. মুক্ত বিশ্বকোষ 







Post a Comment

Previous Post Next Post