দ্বীপ জ্বেলে যাই
জাসিন্তা আরেং : হিন্দু এক অজপাড়াগাঁয় ছোট্ট একটা গলি, যেটা দিয়ে একটা রিক্সা বা ঠেলাগাড়ি ঢোকে; সেই গলিটা সোজা মন্দিরের দিকে চলে গেছে। গলিতে ঢোকার শুরুতেই বাশেঁর বেড়া দেয়া বর্গাকৃতির একটা জায়গা। ছোট একটা টিনের গেট, পাশেই একটা বাঁশঝাড়। গেটের ভিতর ঢুকতেই চোখে পড়ে ছোট্ট একটা ঘর, যার দেয়ালটা ঘুনে-ধরা গজারী কাঠের তৈরি আর চালে অনেক বছরের পুরানো ফুটো টিন। ঘরের খুঁটিগুলোও নড়-বড়ে, ঝড়ের সময় যা মনের মধ্যে একটা সংশয় সৃষ্টি করে। বর্ষাকালে ঘরের বেশিরভাগ অংশই ভেজা থাকে। বৃষ্টির পানি পড়ার ফলে কিছু-কিছু জায়গায় ছোট-ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ঘরের মাটি এমনই স্যাঁতস্যাতে যে শীতকালেও এর কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। ঘরের ভেতর একটা পুরানো চৌকি আর দু-একটা চেয়ার আছে। চৌকির ওজনে ঘরের মাটি দেবে যাচ্ছে। বারান্দায় একটা লম্বা বেঞ্চি রাখা, যেটাতে চার-পাচঁ জন বসতে পারে। পরিবেশটা বেশ নিরিবিলি এবং ছায়াঘেরা। উঠানের মাঝখানে পরিণত বৃষ্টিগাছটা তার শাখা-প্রশাখা এমনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে যে এর ফাঁক-ফোকর দিয়ে নীলাম্বরটা সামান্যই চোখে পড়ে। বাড়িটার পরিবেশ দেখে মনে হয় বাড়িতে কোন প্রাণ নেই। বাড়িটিতে শুধু প্রাণ-জুড়ানো সমীরণ সারা দেহে উপলব্ধি করা যায়। সারাদিন এই নিস্তব্ধ বাড়িতে কোনো আওয়াজ শোনা না গেলেও কয়েকটি কাকের ডাক অবশ্যই শোনা যায়। তাই মানুষের অস্তিত্ব বোঝা না গেলেও গাছে-গাছে যে কাকের বাসা আছে তার প্রমাণ মেলে কা-কা ডাক শুনে।
![]() |
দ্বীপ জ্বেলে যাই |
সেই প্রাণহীন বাড়িতে তিনজন লোকের বাস, এক বিধবা মা আর তার দুই মেয়ে। তিনি স্বামীর সঙ্গে আড়াই বছরের বেশি সংসার করার সুযোগ পান নি। স্বামী মারা যাবার পর থেকে সংসারটাকে কোন রকম করে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। স্বামী মারা যাবার কিছুদিন পরেই ঢাকা থেকে কয়েকজন মিশনারীর আগমন ঘটে তার বাড়িতে। তারা বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্য খুলে বলার পর তিনি জানতে পারলেন যে, তারা তার যে কোন এক সন্তানকে দত্তক নিতে আগ্রহী। যদিও সেই সময় তিনি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যদিয়ে প্রতিটা দিন যাপন করছিলেন, তারপরও তিনি তাদের ফিরিয়ে দিলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, আমার দুই সন্তানই আমার কাছে সমান, কেউ কারো চেয়ে অধিক মূল্যবান নয়। তাই আমি কাউকেই আপনাদের কাছে তুলে দিতে পারব না। তিনি আরো বললেন, “আমি কিছু না পারলেও অন্তত দুবেলা দু’মুঠো ভাত তাদের মুখে তুলে দিতে পারব।” তিনি কিন্তু চাইলেই তার যেকোন এক মেয়েকে দত্তক দিয়ে আরেক মেয়েকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে পারতেন। হয়ত এতে তার কষ্ট একটু হলেও কম হত, কিন্তু তিনি তা করলেন না। তিনি তার সিদ্ধান্তে অবিচলিত থাকলেন। যাইহোক, মায়ের মনতো; মায়ের ভালবাসা বোধহয় এমনি নিস্বার্থ হয়। তিনি যা করেছেন সেটা হয়ত মাতৃস্নেহের কারণেই করেছেন। সেদিন হতে তার সন্তানদের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। সেদিন থেকে তার সংসার এবং পৃথিবী বলতে শুধু তার দুই মেয়ে, এবং তাদের নিয়েই তার সমস্ত ভাবনা এবং সপ্ন। তার মেয়েদেরকে শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ করা এবং মূল্যবোধে তাদেরকে গড়ে তোলাই যেন তার একমাত্র লক্ষ্য।
কয়েক বছর পরে তিনি তার দুই মেয়েকে এক স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। বাড়ি থেকে স্কুলের দুরত্ব প্রায় দুই বা আড়াই মাইল হবে। দুই বোন গলা-গলি করে রাস্তার এক পাশ দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেত। সেই সময় একটা চাকুরীর প্রস্তাব পান মা। সেই সময় আর্থিক অবস্থা অনুকূলে না থাকায় একটা চাকুরীর খুব দরকার ছিল, তাই তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। চাকুরীর সুবাদে স্কুলের পার্শ্ববর্তী এলাকায় যেতে হতো। তাই এতে তার সুবিধাই হয়েছিল কারণ তিনি আসা-যাওয়ার পথে মেয়েদেরকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজের কর্মস্থলে যেতে পারতেন। তিনি বয়স্কদের পড়ানোর সাথে-সাথেসেখানকার স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর সুযোগ পান। সকালবেলা শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য তিনি তাড়াতাড়ি গ্রামে যেতেন আর তার পিছন-পিছন চলত দুই মেয়ে। পথ চলার সময় মাকে জিজ্ঞাসা করত মা এটা-ওটা কি, ওটা এমন কেন? রাস্তায় চলার সময় তিনি যে কত রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতেন তার হিসেব কে রাখে! মাঝে-মাঝে বিরক্তিও প্রকাশ করতেন।
গন্তব্যস্থলে পৌঁছে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে-সাথে তার দুই মেয়েকেও পড়াতেন। বাড়ি ফিরে রান্না করতেন কিন্তু দুপুরে আহার করতেন না। তিনি তার মেয়েদের জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন। তারা স্কুল থেকে ফিরলে একসাথে আহার করতেন।
সন্ধ্যে হলেই বারান্দায় চাটাই বিছিয়ে, হারিকেন বা কুপি বাতি জ্বালিয়ে মেয়েদের পড়াতে বসতেন। সেদিন শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক বা শিক্ষিকা কি পড়িয়েছেন তার খোঁজ-খবর নিতেন। এটা ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। তিনি তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে খুবই সচেতন ছিলেন। তার সন্তানেরা স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করলেও তাদের জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষক ছিলেন মা নিজেই। তিনি তার সন্তানদের ইচ্ছে বা সপ্নকে নিজের মত করেই সবর্দা মনে লালন করতেন, যদিও মাঝে-মধ্যে তাদের স্বপ্নকে দুস্বপ্ন বলে মনে করতেন। তিনি ভাবতেন, মাটির ঘরে বসে স্বপ্ন দেখা যে সত্যিই নিছক মরিচীকার খেলা ছাড়া আর কিছু নয়।
বড় মেয়ে অনেক বড়-বড় স্বপ্নের কথা মায়ের সাথে সহভাগিতা করত। মা শুধু মনে-মনে ভাবতেন আদৌ এই স্বপ্নের কি শুধু সাদা মেঘমালার মত আকাশে ভেসে বেড়াবে, নাকি কখনো বৃষ্টি হয়ে মাটি স্পর্শ করবে! তিনি বলতেন, মা, তুমি যে এত বড়-বড় স্বপ্ন দেখ তোমার মায়েরতো সেই স্বপ্ন পূরণের সাধ্য নেই। আমরা যে বড় অসহায় মা, আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মত যে কেউ নেই। আমাদের জীবনের সমস্ত স্বপ্ন যে অভাব-অনটনের শক্ত শিকলে বাধা পড়ে আছে আর তা থেকে বেড়িয়ে আসার ক্ষমতা যে আমাদের নেই। সকলকে আড়াল করে চুপিসারে অশ্রু ঝরাতেন। তাদের চাহিদাগুলো পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় মা মনে-মনে খুবই কষ্ট পেতেন। আর্থিক অস্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের সাধ্যমত তাদের চাহিদাসমূহ পূরণে কোন ক্রটি রাখতেন না। যিনি উপর থেকে সব কিছু অবলোকন করেছেন তিনি হয়ত ভাবতেন যে, এই অতি সাধারণ জীবনও তাদের কাছে কতই না গভীর, কতই না জটিল বলে মনে হয়।
তিনি এমনই এক মা যিনি তার স্বর্বস্ব দিয়ে সকল প্রতিকূলতার বিরূদ্ধে লড়াই করে সন্তানদেরকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করছিলেন। তিনি তাদের বাবার কোন অভাব বুঝতে দিতে চান নি। তিনি কারো সাহায্যের অপেক্ষায় দিন যাপন করেননি, তিনি নিজেই তার সংসারের সম্পূর্ণ ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি প্রতিদিন পায়ে হেঁটে পড়াতে যেতেন। তিনি অসুস্থাবস্থায়ও দশ টাকা খরচ করে রিকসায় উঠতেন না, যেন তার মেয়েরা সেই দশটাকা দিয়ে একদিন বাসে চড়তে পারে। তার এই অসামান্য ত্যাগস্বীকারই তার সন্তানদের ধীরে-ধীরে জীবনের সাথে সংগ্রাম করার শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের কোন কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বা মনে-মনে কোন কিছু পছন্দ হলেও মায়ের কাছে আবদার করত না; বরং মাকে বলত, “মা, তোমার যখন টাকা হবে, তুমি আমাদের এই জিনিসটা কিনে দিও।” এই কথা শুনে মা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন। তার চোখে বাঁধাহীন জোয়ার বইত। মা অবাক হয়ে ভাবতেন, যে তারা ছোট হলেও এতটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে যে, তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য মায়ের কাছে এখন টাকা নেই। তিনি ভাবতেন, তিনি অসহায় বলেই হয়ত ঈশ্বরও তাকে এমন সন্তান দিয়েছেন, যারা তার কষ্ট অনুভব করতে পারে।
আত্মীয়-স্বজন নিকটে না থাকায় মায়ের অন্তরালে লুকিয়ে রাখা কষ্টগুলো কারো সাথে সহভাগিতা করতেও পারতেন না। তিনি এই চিন্তায় নিবিষ্ট থাকতেন যে, তিনি যাদের এত ভালোবেসে বুকে আগলে রেখেছেন এবং যাদের জন্য ত্যাগস্বীকার করেছেন, তারা নিশ্চয় তাকে পর করে দিবে না। শেষ বয়সে তাকে নিশ্চয় বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিতে হবে না। সন্তানদের ওপর তার আস্থা ছিল অবিচল। এই একাকীত্বের জীবনে আজও তিনি নিজের জন্য আর স্বপ্নের জাল বুনেন না এবং নতুন সংসারের কথাও ভাবেন না; তিনি শুধু তার সন্তানদের জন্যই ভাবেন। তিনি তার সন্তানদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেন। তিনি আজও বিশ্বাস করেন যে, তার আদরের মেয়েরা এই হতাশার ঘনঘটা কাটিয়ে আশার আলো দেখাবে, সেদিন এই ত্যাগস্বীকার এবং কষ্ট আর কিছুই মনে হবে না। সেই আশায় তিনি তার মনের ঘরে প্রতিনিয়ত দ্বীপ জ্বেলে রাখেন।
তার প্রিয় সন্তানেরা যে মায়ের কষ্ট অনুভব করতে পারত না, তা কিন্তু নয়। আচঁলের আড়ালে লুকিয়ে রাখা অশ্রুসজল চোখ তাদের কাছে কোনদিনই গোপন থাকত না। তাদের গড়ে তুলতে মাকে যে কত মানুষের অপমান-তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হয়েছে তার নীরক সাক্ষী তো তার সন্তানেরাই। কেউ-কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, “দেখব কিভাবে তুমি তোমার সন্তানদের গড়ে তোল?” মায়ের জীবনে এমনও দিন এসেছে যখন কয়েকজন সুযোগ-সন্ধানী লোক তাদের দারিদ্র্যতার এবং অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি মোটেই নিরাশ হননি, দৃঢ় মনোবল নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তিনি সর্বদাই তার সন্তানদের যোগ্য করে তুলতে চেয়েছেন এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছেন। তার সন্তানেরাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল যে, মাকে তারা কখনোই হারতে দিবে না। প্রতিটি মুহর্তেই তিনি এবং তার সন্তানেরা মনের অন্দরমহলে দ্বীপ জ্বেলে যায় শুধুমাত্র সেই সুদিনের আশায়, যেদিন তাদের দেখা সব অস্পষ্ট স্বপ্ন চোখের সামনে স্পষ্টরূপে বাস্তবায়িত হবে। তারা সেই সুদিনের জন্য দ্বীপ জ্বালে, যেদিন জীবন থেকে সব ব্যার্থতার গ্লানি, হতাশা এবং ভারাক্রান্ত মনের বোঝা হালকা হবে। এভাবেই জীবনের চরম মুহূর্তেও চিরদিনই তারা দীপ জ্বেলে যায় শুধুমাত্র সাফল্যময় আগামীর প্রত্যাশায়।
Tags:
গল্প