দীপান্বীতার বন্ধুত্ব



জাসিন্তা আরেং : 

বন্ধুত্বের অর্থ, মহত্ত্ব ও গভীরতা যখন উপলব্ধি করার বয়স হয়নি, ঠিক তখন থেকেই তার সাথে আমার পথচলা শুরু। তার মায়াবী মুখ ও সহজ-সরল ব্যবহার ও সাধারণ জীবন যাপন আমার দৃষ্টি কেড়েছিল অচিরেই। দুরন্ত বয়সের দোদুল্যমান শিশুমনে স্থান করে নিয়েছিল ছোট্ট দীপান্বতার পবিত্র বন্ধুত্ব। সেই থেকে জীবনের অবিরাম চলার পথে সঙ্গে পেয়েছি তাকে। যদিও দুজনের বেড়ে ওঠা ছিল ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায়। তাছাড়া, দুজনের কথাবার্তা আচার-আচরণ, চলাফেরা থেকে শুরু পারিবারিক গঠনসমূহ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। দুজনের মাঝে ছিল আকাশ-পাতাল ফারাক কিন্তু সে ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু যার প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল প্রবল, ভালবাসা ছিল তীব্র এবং অভিমান ছিল সমুদ্রসম। নানান প্রতিবন্ধকতার মাঝেও দু’জনের বন্ধুত্বের দৃঢ় বন্ধন ও একে অপরের প্রতি শর্তহীন ভালবাসার কারণে আজও টিকে আছে আমাদের বন্ধুত্ব। 

দীপান্বীতার বন্ধুত্ব

এখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিলাম। যদিও আগের মত দুরন্তপনা মনের মধ্যে আর কাজ করে না কিন্তু ফেলে আসা তিক্ত-মধুর স্মৃতির পাতায় বিচরণ করি আজও আনমনে। স্মৃতিময় সে মুহূর্তগুলো পুনরায় ভ্রমণ করা ও তার আনন্দ উপলব্ধি করা, আমার কাছে যেন খালি পায়ে শিশির ভেজা দূর্বাঘাসে হেঁটে বেড়ানোর মতই সুখকর। আজও দখিনা হাওয়ায় সেদিনের স্মৃতিময় দিনগুলো দোলা দিয়ে যায় মনের অতলান্তে। জানি না আজও তার মনে দাগ কাটে কিনা, সেই যে লজ্জাবতী গাছের পাতা ছুঁয়ে বেড়ানো, ভর-দুপুরে টিফিনে পুকুরঘাটে বৃষ্টি গাছের শিকড়ে বসে পানির উপর পা দুলিয়ে মন খুলে গল্প আর হেসে কুটিকুটি হয়ে যাওয়া, খেঁজুর গাছের নিচে পাকা খেঁজুর কুড়ানোর আশায় প্রখর রোদ্দুরে টই-টই করে ঘুরে বেড়ানো, বারণ থাকা সত্ত্বেও মেয়ে হোস্টেলের দোলনায় দুলে দৌঁড়ে পালানো, ছেলে হোস্টেলের গোলপোস্টে গিয়ে ঝুলে থাকা, পলাশফুলের পাপড়ি ছিড়ে বাঁশি বাজানো, খেঁজুর বিচি দিয়ে খেলার নেশায় বিভোর থাকা, টিফিন ভাগাভাগি-কাড়াকাড়ি করে খাওয়া ইত্যাদি। 

বন্ধুত্বের পাশাপাশি সে ছিল আমার প্রিয় একজন সহপাঠী। দুজনই পড়াশুনায় ভাল থাকার ফলে রীতিমত ক্লাশে মৌন প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে টিউশনের অভাবে, সেই ছিল আমার টিউটর। তারকাছ থেকেই নিয়মিত পাঠগুলো থেকে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করতাম। ইংরেজী বিষয়ে বেশ দুর্বল থাকায় এবং পরীক্ষা কাছে এলে চেখে সরষে ফুল দেখতাম বিধায় তার খাতা থেকে দেখে লিখে শিক্ষককে দেখাতাম। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক জন স্যার যখন ক্লাশে টেনস্ এর ব্যবহার লিখতে দিতেন, তখন সেই ছিল আমার একমাত্র সম্বল। কেউ কাউকে ছাড়া বসতে চাইতাম না। কোন কারণে অন্য কোন সহপাঠীর সাথে বসতে হলে বেহায়া মনটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারত না। আর দুজনে একসঙ্গে বসলে শুরু হতো অবিরত কথার বরষণ। মাঝে-মাঝে এই কারণে দুজনকে শাস্তিও পেতে হত, তবুও দুজনের প্রতি দুজনের মনের টান কখনই কম হয়নি। একে-অপরকে বিভিন্ন কারণে বিরক্ত না করলে যেন ভালই লাগত না। ছোট-খাটো কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া হলে অভিমানের কালো মেঘে ছেয়ে যেত আমার মুখমন্ডল। এমনকি অন্য সহপাঠীদের সাথে তার মেলামেশা, ঘুরে বেড়ানো আমার ছোট্ট মনে বিশাল-বিশাল ক্ষতের সৃষ্টি করত। অভিমানী মন নিয়ে নিরব তার চাদর গায়ে দিয়ে আমি শুধু অপলকে অবলোকন করতাম। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠা এসব অপূর্ব মুহূর্তগুলো প্রায়ই ঠোঁটের কোণে হাসির কারণ হয়। কিন্তু তাকে কেউ অবহেলা করলে সেটা আমার দৃষ্টিগোচর হত না কখনও। এমনি এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা আজও আমার স্মৃতির পাতায় অমলিন। চলমান ক্লাশে সুষমা ম্যাডাম তাকে পড়া মুখস্থ বলতে বললেন, কিন্তু সে পারল না। ব্যক্তিগত পরিচয় থাকায় ম্যাডাম তাকে বললেন, “যেখানে মা-বাবাই অশিক্ষিত, সেখানে মেয়ের কাছ থেকে কি-ই বা আশা করা যায়।” আজও মনে পড়ে, এ কথা শুনে সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। যদিও তার কষ্ট কোন অংশে কমাতে পারিনি, তবে সান্ত্বনার বাণী শোনাতে ভুলিনি আমি। তাকে অপমানিত হতে দেখে আমিও নিজেকে সামলাতে পারিনি সেদিন। তার অশ্রুসজল চোখ দেখে আমারও দুচোখ টলটল করছিল। সেদিনও তার অনুভুতির অংশীদার ছিলাম আমি। সেদিন হৃদয় গহীনে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, বন্ধুর কষ্ট আমার হৃদয়কেও কতখানি বিদীর্ণ করে। 

এত বছরে তার জীবনে নানান চড়াই-উৎরাই এসেছে। হয়ত সে কঠিন সময়গুলো তার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে কিন্তু দুহাত ভরে দিয়ে গেছে বাস্তবতার ধূসর ছাপ। যা তার জীবন পথে আলোকময় দিশারী হিসেবে চিরদিন সক্রিয় থাকবে। তার সুসজ্জিত জীবনাঙ্গনে আমার পদচারণা নিতান্তই নগণ্য। সময়ের হাত ধরে হয়ত সে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। হয়ত, অতৃপ্ত চিত্তের সমাধান খোঁজে ক্লান্ত হয়ে শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজেছে একাকী, সম্পর্কের টানাপোড়েনের চাপে পড়ে হয়ত সে গম্ভীর নিরবতাকে লালন করেছে মনে, হয়ত ব্যর্থতার অমানিশায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে বহুদিন, বিপদে প্রিয় বন্ধুর অনুপস্থিতির গ্লানি নিয়ে হয়ত সে আজ মিতালী করেছে বৃষ্টির সাথে, আমার প্রতীক্ষার তিক্ততা হয়ত মনকে তুলেছে বিষিয়ে; হয়ত তার কষ্টের নিলীমায় নীলাভ হতে পারিনি বলেই সে অন্যের সাথে সখ্যতা করে নিয়েছে। হয়ত সে তার চোখের নোনাজলে ভিজিয়েছে তার  কোমল বালিশ, হয়ত সে অভিমান করে তার নরম ঠোঁটের ভাজে অব্যক্ত সব নালিশ সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে। 

তবে সে জানেনা, মৌনতার বোধ আমারও আছে। আসলে, যেদিন থেকে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়েছি, সেদিন থেকে আমি পিছনে ফিরে তাকাইনি। অবিরাম বয়ে চলা বরফগলা নদীর মতই হেঁটে চলেছি কোন এক গন্তব্যের উদ্দেশে, সহস্র স্বপ্ন চোখে নিয়ে। তাকে জানার, বুঝার ও ভালবাসার সমস্ত ব্যর্থতা ও অনুশোচনার ধূসর স্মৃতি আলপনা এঁকে দিয়ে যায় আমার মানসপটে। জানি, সে লুকিয়ে রেখেছে তার কষ্টের পদাবলী, তার জীবনের বিভৎস দুস্মৃতির যন্ত্রণা ও নিশ্চুপ ক্রন্দন; নির্ঘুম নিশীথে লিখে যাওয়া অসংখ্য বিলাপগাথা। হয়ত, আমার প্রতি অবিশ্বাসের দানা বেঁধেছে তার অন্তরে। তবে সময়ের স্রোতে আমি তার বন্ধুত্বকে হারিয়ে ফেলিনি। জীবনে অনেক সুধীজনকেই পাশে পেয়েছি, নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছি এবং বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছি। যদিও আমার জীবনের কষ্টের সময়ে তার প্রয়োজন ছিল, সে আমাকে সময় দিতে পারেনি। তাই বলে তাকে কোনভাবে দায়ী করা যায় না, সেতো ছিল আমার জীবনের নিয়তীর নিষ্ঠুরতম চেপ্টার। 

কোন আক্রোশ, ক্ষোভ ও অভিমান মনে রেখে দিনটির মহত্ত্বকে কোনভাবেই হেয় করতে চাই না। তার প্রতি আমার সহস্র বিরক্তি, অব্যক্ত বেদনা, পাহাড়সম দুঃখ, আকাশসম অভিমান থাকা সত্ত্বেও তাকে বলতে চাই, পাশেই আছি বন্ধু তোর। তাছাড়া, দু-একটি বছর তো নয়, কুড়িটি বছর তাকে এই হৃদয়ে লালন করেছি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে। আজও তোর প্রতি আছে অগাধ বিশ্বাস, সহস্র অভিমান ও তীব্র ভালবাসা। তুই হয়ত জানিস না আমি আজও তোর অনুভূতির অংশীদার। তাই প্রার্থনা করি তোর ও আমার বন্ধুত্ব যেন সুদৃঢ়, সুদীর্ঘ এবং স্থায়ী হয়। দূর হয়ে যাক সকল শূন্যতা, তোর জীবনে আসুক পূর্ণতা॥ 

Post a Comment

Previous Post Next Post